পল্লীকবি জসীম উদদীন ১ জানুয়ারি ১৯০৩ সালে ফরিদপুর শহরের কুমার নদ বিধৌত ফরিদপুরের তাম্বুলখানায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ বাংলার এই কবি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ফরিদপুরের তাম্বুলখানায় নিজ বাড়িতে ডালিম গাছের তলায় কবিকে সমাহিত করা হয়।
জসীম উদদীন কবি, গীতিকার, ঔপন্যাসিক। আবহমান গ্রাম-বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে সাহিত্যে প্রয়োগ করেছেন। এক্ষেত্রে অনেক গ্রামের মানুষের মুখে মুখে চলা প্রবাদ পরিমার্জন করে পাঠক উপযোগী করেছেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে একেবারে আঞ্চলিক শব্দগুলোর(যতটা পারা যায়) প্রমিত করার চেষ্টা করেছেন।গ্রামবাংলার বিভিন্ন উপাদানে তাঁর কবিতা বা সাহিত্য ভরপুর। সে সময়ে কেউ কল্পনাই করতে পারেনি! সঙ্গত কারণে তাঁকে ‘পল্লী কবি’ উপাধি দেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে খুব কম লোকই তাঁকে অনুসরণ করতে পেরেছেন।
জসীম উদদীনের আখ্যানমূলক কাব্য চারটি হচ্ছে, ‘নকশীকাঁথার মাঠ’(১৯২৯), ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’(১৯৩৩),‘সকিনা’(১৯৫৯), ‘ও মা যে জননী কান্দে’ (১৯৬৩)। আখ্যানমূলক কাব্যগুলোর শব্দাবলি বা উপাদানগুলো আশেপাশের; সবুজবাংলার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু মাইকেল, নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ কবি আখ্যান বা কবিতায় রামায়ণ-মহাভারত, লোকগপুরাণ বা ধর্মীয় ঐতিহ্যের কাছে হাত পেতেছেন। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম জসীম উদদীন ব্যতিক্রম ও অনন্য। তার আখ্যানকাব্য জনপ্রিয়তা ও নির্মাণশৈলীতে অনন্য।জীবনানন্দ দাশও গ্রামবাংলার উপাদান নিয়ে কবিতা নির্মাণ করেছেন; তবে তার আখ্যানকাব্য নেই। জসীম উদদীনের অন্ত্যমিলের কবিতাগুলো কানে সমধুর ঝংকার তোলে। ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ সর্বাধিক জনপ্রিয় কাব্য। এ দুটি আখ্যানকাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত।
‘নকসী কাঁথার মাঠ’ কাব্য The Field of Embroidered Quilt নামে ইংরেজিতে অনুবাদক করেছেন E.M. Milford। সেসময়ে(এমনকি এখন পর্যন্ত) বাঙালিসাহিত্যিক ও সাহিত্য নিয়ে এমন উপস্থাপন খুব কমই দেখা গেছে। কবি জসীম উদদীনের কাব্যপ্রতিভায় লোকজ উপাদানের ব্যবহারের দক্ষতা।কবিতায় তিনি আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন।কবির কবিতা পড়লে বুঝা যাবে, লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়।
‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য।UNESCO KZ©…K কর্তৃক 'Gypsy wharf' নামে অনূদিত হয়ে আন্তর্জাতিক পাঠক-সমাজে পরিচিতিলাভ করেছে। দুটি আখ্যান কাব্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্র সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বিদেশি অনেক মনীষী কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে। দুটো কাব্যেই অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস। সম্প্রীতির পরিচয় আছে। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ প্রকাশিত হওয়ার পর সাহিত্যসেবক সংঘের অধিবেশনে সভাপতির ভাষনে দীনেশচন্দ্র সেন বলেন, ‘আমি হিন্দু। আমার নিকট বেদ পবিত্র, গীতা পবিত্র কিন্তু সোজন বাদিয়ার ঘাট পুস্তক তাহার চাইতেও পবিত্র। কারণ ইহাতে আমার বাংলাদেশের মানুষগুলির কথা আছে। আমার গ্রামগুলির বর্ণনা আছে।’
কবি জসীম উদদীনের কাহিনীকাব্য একেবারে নতুন। আধুনিক বাংলা কাব্যে যারা আখ্যান-কাব্যের রচয়িতা তারা কেউই জসীম উদ্দীনের মতো এভাবে মৌলিক কাহিনী নির্মাণ করেননি। এসব আখ্যানকাব্যের মূল উপাদান লোকজ থেকে নেওয়া। অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীম উদদীন নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রামবাংলা থেকে।রাখালী, বালুচর, ধানখেত ইত্যাদি কাব্যের ক্ষেত্রেও তাই। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। তবে কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে।
কবি জসীম উদদীন বহু জনপ্রিয় গানের গীতিকার। এমন সব গান কে না শুনেছেন! গান নিয়ে সঙ্গীত গ্রন্থগুলো: ‘রঙিলা নায়ের মাঝি’(১৯৩৫), ‘গাঙের পাড়’(১৯৬৪),‘জারি গান’(১৯৬৮),‘মুর্শিদী গান’(১৯৭৭)।‘বোবা কাহিনী’(১৯৬৪)নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন। তার ভ্রমণকাহিনীগুলো চমৎকার। ‘চলে মুসাফির’(১৯৫২), ‘হলদে পরির দেশ’(১৯৬৭), ‘যে দেশে মানুষ বড়’(১৯৬৮) ও ‘জার্মানীর শহরে বন্দরে’(১৯৭৫)। নাটক ও আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও আছে। ‘রাখালী’(১৯২৭) কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া ‘বালুচর’(১৯৩০), ‘ধানখেত’(১৯৩৩), ‘হাসু’(১৯৩৮), ‘মাটির কান্না’(১৯৫১), ‘এক পয়সার বাঁশি’(১৯৫৬), ‘হলুদ বরণী’(১৯৬৬), ‘জলে লেখন’(১৯৬৯), ‘পদ্মা নদীর দেশে’(১৯৬৯), ‘দুমুখো চাঁদ পাহাড়ি’(১৯৮৭) উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।
কবি জসীম উদদীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমসোক্তি ও অন্যান্য অলংকারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলংকারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ। যুতসই উপমা ও অনুপ্রাসের ব্যবহার কবিতার শিল্পগুণকে উন্নীত করেছে। প্রতিনিধি হিসাবে কিছু উল্লেখ করছি। প্রথমেই ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ থেকে কিছু অলংকারিক(উপমা ও অনুপ্রাস) প্রয়োগ দেখে নিই:‘কাঁচা ধানের পাতার মত কচি মুখের মায়া’, ‘লাল মোরগের পাখার মত ওড়ে তাহার শাড়ী’, ‘কচি কচি হাত-পা সাজুর সোনার সোনার খেলা,(যমক)/তুলসী তলার প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঝের বেলা’, ‘তুলসী ফুলের মঞ্জুরী কি দেব দেউলেত ধূপ’, ‘কালো মেঘা নামো নামো, ফুল তোলা মেঘ নামো’, ‘বাজে বাঁশী বাজে, রাতের আঁধারে, সুদূর নদীর চরে,/উদাসী বাতাস ডানা ভেঙে পড়ে বালুর কাফন পরে’-(সমাসোক্তিসহ), ‘চলে বুনো পথে জোনাকী মেয়েরা কুয়াশা কাফন পরি।/দুর ছাই,কিবা শঙ্কায় মার পরাণ উঠিছে ভরি’।-(উপমা ও অনুপ্রাস প্রয়োগ,পল্লী জননী, রাখালী), ‘হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুফু, সাত বছরের মেয়ে/ রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল বেহেস্তের দ্বার বেয়ে।’-(অনুপ্রাস ও উৎপ্রেক্ষার প্রয়োগ, কবর/রাখালী), ‘হেমন্ত চাঁদ অর্ধেক হেলি জ্যোৎস্নায় জাল পাতি,/টেনে টেনে তবে হয়রান হয়ে, ডুবে যায় সারারাতি।’-(সমাসোক্তির প্রয়োগ, নকসী কাঁথার মাঠ), ‘উদয় তারা আকাশ-প্রদীপ দুলিছে পূবের পথে,/ভোরের সারথী এখনো আসেনি রক্ত-ঘোড়ার রথে’-(সোজন বাদিয়ার ঘাট)।
রূপক, উপমা, প্রতীক, রূপকল্পের বিচিত্র, নৈপুণ্যপূর্ণ ব্যবহার আধুনিক কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আগের যুগেও এর ব্যবহার ছিল। চিরচেনা পরিবেশ নিয়ে জসীম উদদীনের কবিতার চিত্রায়ণ খুব স্বাভাবিক বিষয় বলেই মনে হয়। সাধারণ উপাদানে অসাধারণ বুননের কবিতা অনেক। উল্লেখিত কবিতাংশ তার কবিতার প্রতিনিধি হিসাবেই ধরে নেওয়া শ্রেয় হবে।চরিত্র নির্মাণে(বিশেষত নায়ক-নায়িকা) কবি জসীম উদদীন মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। উপমার প্রয়োগে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। আর অন্ত্যানুপ্রাস তো কবির স্বভাবজাত।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য কবিতাকে অস্ত্র করে তুলেছিলেন জসীম উদদীন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মানুষ হত্যা করেছে, জ্বালিয়ে দিয়েছে ঘর-বাড়ি সংঘটিত করেছে মানব-ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। এই গণহত্যার বিরুদ্ধে কবি জানাচ্ছেন তীব্র ঘৃণা। কবির শক্ত উচ্চারণ: ‘সে বাঙলা আজি বক্ষে ধরিয়া দগ্ধ গ্রামের মালা,/রহিয়া রহিয়া শিহরিয়া উঠে উগারি আগুন জ্বালা/দস্যু সেনারা মারণ-অস্ত্রে বধি ছেলেদের তার,/সোনার বাঙলা বিস্তৃত এক শ্মশান কবরাগার।/বনে জঙ্গলে লুণ্ঠিত গৃহে কাঁদে শত নারী-নর,/কোথায় যাইয়া মিলিবে তাদের পুন: আশ্রয়-ঘর!/প্লাবনের চেয়ে মারিভয় চেয়ে শতগুণ ভয়াবহ,/নরঘাতীদের লেলিয়ে দিতেছে ইয়াহিয়া অহরহ।/প্রতিদিন এরা নরহত্যার যে কাহিনী এঁকে যায়,/তৈমূরলং নাদির যা দেখে শিহরিত লজ্জায়’-(কবির নিবেদন)।‘কবির নিবেদন’ শীর্ষক এই কবিতাটি ‘A Poet’s Appeal’ শিরোনামে সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের নানান প্রচারমাধ্যমে মুদ্রিত হয় কিংবা হয় উচ্চারিত। অনুবাদেও উদ্ভাসিত পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতা নিষ্ঠুরতার ছবি।
কবি জসীম উদদীন বিশ্বাস করতেন, দৃঢ়ভাবে, বিশ্ব-মানবতা পাকিস্তনি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, ঘোষিত হবে বাঙালির বিজয়। বিশ্ববাসীর কাছে কবির আন্তরিক নিবেদন: ‘বিশ্ববাসীরা শোন,/মোদের কাহিনী শুনিয়া কাঁদিবে নাই কি দরদী কোন?/আজিও যাহারা বাঁচিয়া রয়েছি, আছি এই আশ্বাসে,/মানব ধর্মী ভাইরা আসিয়া দাঁড়াবে কখনো পাশে।/তোমাদের কোলে আছে ছেলেমেয়ে, শপথ তাদের লাগে,/স্বামী-পুত লয়ে সুখ-গৃহ মাঝে আছ যারা অনুরাগে;/দেশ-দেশান্তে দয়া ধর্মের শপথ মানবতার;/তোমরা আসিয়া ভাঙ এ নিঠুর এজিদের কারাগার।/প্রতি মুহূর্তে শিশু মার কোলে মরিছে বুলেট ঘায়,/প্রতি মুহূর্তে শত অসহায় দলিত দস্যু পায়।/তাদের দীর্ঘ নিশ্বাসে ভরি উড়ানু পত্রখানি,/এই আশা লয়ে তোমাদের থেকে পাব আশ্বাস-বাণী। (কবির নিবেদন)
কবি জসীম উদদীন ‘কবির নিবেদন’ কবিতাটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ রচনা করেছেন বলে জানা যায়। মুক্তিসংগ্রামে জয়ী হতে হলে অনেক মুক্তিযুদ্ধের শুভাকাঙ্গীদের মতো কবিও উপলব্ধি করেছেন বিশ্ব-জনমত জাগ্রত করতে হবে। ফলে নিজের তাগাদা থেকেই এমন সব কবিতা লেখার প্রয়াস করেছেন তিনি। ১৬ মার্চ ১৯৭১ এ বঙ্গবন্ধু কবিতার ঠিক শুরুতে লেখেন, ‘মুজিবুর রহমান!/ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান।’ আরও কিছু কবিতাংশ তুলে ধরাই যায়Ñ
(১) ‘যেথায় স্বর্গ ম্রিয়মান হয় আপনারে তুলনিয়া/সে দেশের লাগি সাধনা মোদের রহিবে প্রজ্জলিয়া।’-(জাগিয়া তুলিবা আশ)।
(২) ‘এসব কাহিনি কহিবার মানা লিখিবার মানা হায়/কবির কলম বড় অবাধ্য না লিখে বাঁচা যে দায়’।(কি কবিব আর)। এখানে পাকিস্তানি কর্তৃক নির্মম অত্যাচার ও বাকস্বাধীনতা হরণের কথা বলা হয়েছে।
(৩) নির্যাতিত হিন্দুদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে কবি জসীম উদ্দীন লেখেন,‘গীতারা কোথায় যাবে?/কোথায় মমতা কোথা স্নেহ আর মায়া/কাহারা আজিকে এদেশ হইতে মুছিয়া ফেলিছে/সকর শীতল ছায়া’-(গীতারা কোথায় যাবে?)। গীতা হয়ে গেছেন হিন্দুদের প্রতীক। ‘সারা গাঁওখানি দগ্ধ শ্মাশান দমকা হাওয়ার ঘায়/দীর্ঘ নিশ্বাস আকাশ-পাতালে ভষ্ম উড়িয়া যায়’-(দগ্ধ গ্রাম)। দেশীয় দোসরদের সঙ্গে নিয়ে পাকিবাহিনীর অগ্নিসংযোগ ও বাঙালিদের ওপর অমানবিক অত্যাচারের কথার ঈঙ্গিত পাওয়া যায় কবিতায়।
(৪) ‘হয়েছে দুরাশা! আকাশ-ফাটানো ছুড়িয়া বুলেট-গুলি/নরহন্তার বেশে নাচে সেই ধর্মের ভাইগুলি/ভ্রাতৃপ্রেম যে সংহারক রূপে হইয়াছে রূপায়ন/সংহতি আবহমান লভেছে কামানের গরজন।’(ইসলামী ভাই)।
‘আমার হাড় কালা করলাম রে/আমার দেহ কালার লাইগা রে/আরে আমার অন্তর কালা করলাম রে/দুরন্ত পরবাসে...’- জনপ্রিয় এ গানটির রচয়িতা কবি জসীম উদ্দীন। কবি জসীম উদদীনের অমর কিছু গান রচনা করেছেন। তিনি এমন কিছু বাংলা গান এখনো মনের অজান্তে গুনগুন করে ছেলে- বুড়ো-আমরা। লোকজ এবং মাটির গানগুলোকে তুলে দিয়েছেন শহুরে মানুষের মুখে মুখে। আমরা মনের অজান্তে কবি জসীম উদদীনের অনেক গান গেয়ে থাকি। তবে অনেকেই গীতিকারের নাম জানেন না। শিল্পী রথীন্দ্রনাথের কন্ঠের অমর অনেক গানই শিল্পীর সুনাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু পর্দার আড়ালের গীতিকার পর্দার আড়ালেই থেকে গেছেন। কয়েকটি অমর গানের কথা বলতেই পারি- (১)‘প্রাণ সখিরে/ঐ শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে।/বংশী বাজায় কে রে সখি, বংশী বাজায় কে।/আমার মাথার বেনী খুইলা দিমু/তারে আনিয়া দে...’, (২)‘ও আমার দরদী আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না...’,(৩)‘বৈদেশী কন্যা গো...’,(৪)‘আমায় ভাসাইলিরে আমায় ডুবাইলিরে অকূল দরিয়ায় বুঝি কূল নাইরে...’/নদীর কূল নাই কিনার নাইরে...আমি কোন কূল হইতে কোন কূলে যাবো...’,(৫)‘কি বলিব সোনার চাঁদ...’,(৬)‘আমায় এতো রাতে কেন ডাক দিলি...’, (৭)‘যোগী ভিক্ষা ধরো...’,(৮)‘রসুল নামে...’,(৯)‘ও সুজন বন্ধু রে...’,(১০)‘পেটের জ্বালায় জইলা মইলা...’, (১১)‘উজান গাঙ্গেরর নাইয়া...’, (১২)‘আমার সোনার ময়না পাখি...’,(১৩)‘জল ভরিতে যায় গো কন্যা...’, (১৪)‘নদীর কুল নাই কিনার নাই...’,(১৫)‘তোরা কে কে যাবি লো জল আনতে...’,(১৬)‘ছল ছল কল কল নদী করে টলমল...’,(১৭)‘আমারন বন্ধু বিনোদিয়া রে প্রাণ বিনোদিয়া...’, (১৮)‘নিশিথে যাইও ফুল বনে গো ভোমরা...’,(১৯)‘উজান গাঙ্গের নাইয়া...’,(২০)‘আমার সোনার ময়না পাখি/কোন দেশেতে গেলা উইড়া রে/দিয়া মোরে ফাঁকি রে/আমার সোনার ময়না পাখি...’,(২১)‘আমি বাইয়া যাইয়া কোন ঘাটে...’ ইত্যাদি গানের অংশ উল্লেখ করা যেতেই পারে। এরকম অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা কিন্তু কবি জসীম উদদীন। আধুনিক গান, ইসলামি গান, পল্লীগীতি, জারি, সারি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালাগান এবং উর্দুসহ অসংখ্য গান লিখে বাংলা গানের জগতকে করেছেন সমৃদ্ধ এবং উজ্জ্বল।
কবি জসীম উদদীন লোকসাহিত্যের অনেক কিছু উদ্ধার করেছেন বা সংগ্রহ করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স¤পাদনাও করেছেন। সম্পাদনায় অবশ্য তিনি সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন। স¤পাদনার ক্ষেত্রে তিনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৌলিকতা এড়িয়ে বা বলা যায় বিতর্ক এড়ানোর জন্য সতর্ক হয়ে সম্পাদনা করেছেন। কিছুক্ষেত্রে তাঁর মতো করে সম্পাদনা করেছেন। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত, দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে লোক সাহিত্য সংগ্রাহক হিসেবে জসীম উদদীন কাজ করেন। তিনি পূর্ববঙ্গ গীতিকার একজন সংগ্রাহকও। তিনি ১০,০০০ এরও বেশি লোকসংগীত সংগ্রহ করেছেন কিছু অংশ তার সংগীত সংকলন ‘জারি গান’ এবং ‘মুর্শিদা গান’ এ স্থান পেয়েছে। তিনি বাংলা লোক সাহিত্যের বিশদ ‘ব্যাখ্যা এবং দর্শন’ খন্ড আকারেও লিখে গেছেন।
জসীম উদদীন ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার’(১৯৫৮),‘একুশে পদক’ (১৯৭৬) ও ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’(মরণোত্তর, ১৯৭৮) পান। তিনি ১৯৭৪ সালে ‘বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার’ প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবি জসীম উদদীন-কে সম্মান সূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। শুধু লোকসাহিত্যের ক্ষেত্রেই নয়, কবি জসীম উদদীনের সকল লেখা সমসাময়িক ও প্রাণবন্ত। তিনি দেশের মানুষের কথা, তাদের জীবনযাপনের কথা,সংস্কৃতি ও প্রকৃতি নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন।গান ও কবিতায় তুলে এনেছেন লোকজ উপাদানের প্রাচুর্যে। কবি জসীম উদদীন পালাগান, গাজীর গান, লোকগীতি বা জারী-সারির আসরে যোগ দিতেন; এবং তা উপভোগ করতেন। আবার নিজের বাড়িতেও লোকসাহিত্যের বা উল্লেখিত গানের আসর বসাতেন।লোকসগীতের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন তিনি।তাঁর এ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানী, ইংল্যান্ড, তুরস্ক প্রভৃতি দেশে আমন্ত্রিতও হতেন। এসব ক্ষেত্রে আলোচক হিসাবেও উপস্থিত থাকতেন।
তথ্যসহায়ক সূত্র
১. জসীম উদদীন, ‘একুশের গান’, রক্তাক্ত মানচিত্র(সম্পাদক: আবদুল হাফিজ), পুথিপত্র, কলকাতা, ১৯৭১
২. জসীম উদদীন, ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে’, পলাশ প্রকাশনী, ঢাকা
৩. বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও জসীম উদদীনের পঙক্তিমালা, বিশ্বজিৎ ঘোস,কালি ও কলম
৪. কালের ধ্বনিসহ বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা
৫. বিশ্বকোষ