মার্চ ৩০, ২০২১, ০২:১৫ পিএম
বাংলা শিশুসাহিত্যের ধারায় সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাম দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। প্রধানত ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ শীর্ষক অবিস্মরণীয় গ্রন্থের জন্য বাঙালি পাঠকসমাজে তিনি সমধিক পরিচিত। লোক-সাহিত্যের সংগ্রাহক ছড়াকার, চিত্রশিল্পী, দারুশিল্পী এবং কিশোর কথাকার হিসেবেও দক্ষিণারঞ্জন বিশিষ্ট অবদান রেখে গেছেন। বস্তুত, তার হাত ধরেই বাঙালি কিশোর শিক্ষার্থীরা সর্বপ্রথম সাহিত্যের অভ্যন্তরলোকে প্রবেশ করে প্রথম লাভ করে শব্দশিল্পের আস্বাদ। পশ্চিমে হ্যান্স এন্ডারস কিংবা গ্রীম ভ্রাতৃদ্বয় কিশোরদের সাহিত্যমুখী করার জন্য যে ভূমিকা পালন করেছেন, বাংলাদেশে তা পালন করেছেন দক্ষিণারঞ্জন।
এই ভূমিকার কথা স্মরণ করে একথা আজ নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, হাজার বছরের বাংলাদেশ যেসব শ্রেষ্ঠ সন্তান বাঙালিকে উপহার দিয়েছে, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার তাদের অন্যতম।
১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ এপ্রিল (১২৮৪ বঙ্গাব্দের ২ বৈশাখ) ঢাকা জেলার সাভারের অন্তর্গত উলাইল গ্রামের সম্ভ্রান্ত মিত্র মজুমদার বংশে দক্ষিণারঞ্জন জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০২ সালে দক্ষিণারঞ্জনের পিতা রমদারঞ্জন মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর তিনি মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে পিসিমা রাজলক্ষ্মীর কাছে টাঙ্গাইল চলে আসেন। এ কারণেই তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখায় সমাপ্তি ঘটে। টাঙ্গাইলে এসে দক্ষিণারঞ্জন কৃষিকাজে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। ভাইপোর উৎসাহ দেখে রাজলক্ষ্মী দেবী তাকে জমিদারী দেখাশোনার দায়িত্ব দিলেন। এর ফলে পল্লীবাংলাকে জানার সুযোগ ঘটলো দক্ষিণারঞ্জনের। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে তিনি ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। রাখাল বালকের বাঁশির সুরে, মাঝিদের উদাসকরা ভাটিয়ালী গানে আর গ্রাম-বৃদ্ধাদের মুখে ‘পরণকথা’ শুনে তার রসপিপাসু মন ভরে উঠলো।
দীর্ঘদিন ধরে তিনি এসব গ্রামীণ ব্রতকথা গীতিকথা-রূপকথা দিয়ে ভরে তুলেছেন তার খাতার পাতা। উত্তরকালে এসব উপাদানই তিনি উপহার দিয়েছেন বাঙালি পাঠককে। কাজেই পিসিমার আশ্রয় এবং তার জমিদারি দেখাশোনার ভার কেবল দক্ষিণারঞ্জনের জীবনের জন্যই নয় রসপিপাসু বাঙালি পাঠকের জন্য ছিল এক ঐতিহাসিক আশীর্বাদ।
ইতিমধ্যে দক্ষিণারঞ্জনের লেখা ও সংগৃহীত রূপকথা কলকাতার বিখ্যাত সব পত্রিকায় ছাপা হতে আরম্ভ করে। ক্রমে তিনি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এভাবে এক সময় প্রস্তুত হয়ে যায় ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র পান্ডুলিপি। প্রকাশক না পেয়ে নিজের অর্থেই পান্ডুলিপি প্রকাশে উদ্যোগী হন দক্ষিণারঞ্জন। এ সময়ই আকস্মিকভাবে রূপকথা-লোকগীতি সংগ্রহের আরেক কিংবদন্তী দীনেশচন্দ্র সেনের নজরে আসে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র প্রুফ কপি। অবশেষে দীনেশচন্দ্র সেনের উদ্যোগেই সেকালের বিখ্যাত প্রকাশক ভট্টাচার্য অ্যান্ড সন্স থেকে ১৯০৭ সালে আত্মপ্রকাশ করে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। বাংলাসাহিত্যে সৃষ্টি হয় অভূতপূর্ব আলোড়ন। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ইয়োরোপেও লাগে সে আলোড়নের ঢেউ।
‘ঠাকুরমার ঝুলি’ প্রকাশের পর একে একে দক্ষিণারঞ্জনের অনেক বই প্রকাশিত হতে থাকে। তার প্রতিটি বই-ই বাংলা সাহিত্যের অক্ষয় সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত। উত্থান এবং ঠাকুরমার ঝুলি ছাড়া তার যেসব বই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, সেগুলো নিম্নরূপ- মা বা আহুতি (১৯০৮), ঠাকুরমার ঝুলি (১৯০৯), আর্যনারী (প্রথম ভাগ ১৯০৮, দ্বিতীয় ভাগ ১৯১০), চারু ও হারু (১৯১২), দাদামশায়ের থলে (১৯১৩), খোকাখুকুর খেলা (১৯০৯), আমাল বই (১৯১২), সরল চন্ডী (১৯১৭), পুবার কথা (১৯১৮), ফার্স্ট বয় (১৯২৭), উৎপল ও রবি (১৯২৮), কিশোরদের মন (১৯৩৩), কর্মের মূর্তি (১৯৩৩), বাংলার সোনার ছেলে (১৯৩৫), সবুজ লেখা (১৯৩৮), চিরদিনের রূপকথা (১৯৪৭), আশীর্বাদ ও আশীর্বাণী (১৯৪৮) ইত্যাদি। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র মতো চারু ও হারুও সেকালে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ বই-ই বাংলা ভাষার প্রথম কিশোর উপন্যাস।
রূপকথাধর্মী নিজের মৌলিক সাহিত্যকর্ম সবুজ লেখা (১৯৩৮) দক্ষিণারঞ্জনের আর একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বঙ্গীয় সাহিত্য মন্দির (১৯৩৯) শীর্ষক তার একটি মৌলিক কবিতা সংকলন ও সেকালের বাঙালী পাঠকের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছিল। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের কর্মজীবন ও সাহিত্যজীবন অভিন্ন। সাহিত্যজীবনই মূলতঃ তার কর্মজীবন। সারাজীবনই তিনি লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা করেছেন। তবে পিসীমার বাড়িতে কৃষিকাজ তদারকি তার কর্মজীবনের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। দক্ষিণারঞ্জনের প্রতিভার আর দুটো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতেন। নিজের বইয়ের ছবিগুলো তিনি সব সময় নিজেই আঁকতেন। বইয়ের প্রচ্ছদও করতেন তিনি নিজের হাতে। দক্ষিণারঞ্জন ছিলেন একজন অসাধারণ দারুশিল্পী। কলকাতা পূর্ণদাস রোডে তার যে বাসভবন, সেখানকার দরজা-জানালা কাঠের শিল্পকর্ম তিনি নিজের হাতে করেছেন।
১৩৬৩ বঙ্গাব্দের ১৬ চৈত্র (১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ) দক্ষিণারঞ্জন মিত্র-মজুমদার আশি বছর বয়সে কলকাতার নিজ বাসভবন ‘সাহিত্যাশ্রম’ এ চিরনিদ্রায় শায়িত হন। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী পুরুষ। এ দেশের কিশোর-কিশোরীদের স্বপ্নমুখী, সাহিত্যমুখী এবং জীবনমুখী করার ক্ষেত্রে তিনি পালন করেছেন অবিস্মরণীয় ভূমিকা।
সূত্র: উইকিপিডিয়া