বাংলা চলচ্চিত্রে ব্যতিক্রম এক চরিত্রের নাম উত্তম কুমার। ৫৩ বছর বয়সে মারা যাওয়া এই কালজয়ী শিল্পীর বিদায়ের দিন আজ (২৪ জুলাই)। নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে ওঠার রাস্তায় অনেক বাধা পেরোতে হয়েছে উত্তম কুমারকে।
প্রথম জীবনে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টে কেরানির চাকরি করতে হয়েছিল তাঁকে। সংসারের বড় ছেলে হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য চাকরি করেন তিনি। ১৯৪৮ সালে চলচ্চিত্র জীবনে পা রাখার আগে তিনি পারিবারিক নাট্য গোষ্ঠী 'সুহৃদ সমাজ'-এ অভিনয় করতেন। সেখানে মায়াডোর নাটকে পরিচালক নীতিন বসুর অধীনে অভিনয় করে প্রথম আলোচনায় আসা উত্তম কুমার এই পরিচালকের অধীনে ১৯৪৮ সালে 'দৃষ্টিদান' চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রূপালী পর্দায় যাত্রা শুরু করেন।
এই মহানায়কের শুরুর যাত্রা ছিল বেশ বন্ধুর। কেননা ১৯৪৮ সালে থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তার অভিনয় করা ছয়টি চলচ্চিত্র বক্স অফিসে জমেনি। ফলে তাকে ‘ফ্লপ মাষ্টার জেনারেল’ তকমা শুনতে হয়েছে এ সময়। এক পর্যায়ে অভিনয়ই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে অভিনয় জগতে আবার নতুন জীবন দান করেন পরিচালক নির্মল দে। তার 'বসু পরিবার' ১৯৫২ সালে মুক্তি পায়, যেখানে উত্তম কুমার তার জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
গানের কথার সঙ্গে ঠোট মিলিয়ে গাওয়ায় উত্তম কুমার ছিলেন সেরা। নিজেও গান গাইতেন। গানের প্রতিটি কথা ও সুরের সঙ্গে বদলে যেত উত্তম কুমারের অভিব্যক্তি। আর সে কারণেই 'বসু পরিবার' চলচ্চিত্রের উত্তম কুমারকে বেছে নেন নির্মল বাবু।
তবে উত্তম কুমারের রোমান্টিক ও বাধা ধরা অভিনয়ের বাহিরে থেকে নির্মিত অসাধারণ একটি চলচ্চিত্রের নাম 'নায়ক'। কথায় বলে, পরিচালকই নায়ক তৈরি করেন। সত্যজিৎও তেমনটাই করেছিলেন। সবথেকে বড় উদাহরণ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সৌমিত্রকে নিয়ে অনেকগুলি ছবিই তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ। বরং সেই সময়ের সুপারস্টার উত্তম কুমারকে তাঁর ছবিতে তিনি ততটা ব্যবহার করেন নি। কিন্তু কেন? পরিচালক নাকি ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেন, উত্তমকে নতুন করে বানানোর কিছু ছিল না তাঁর। তবু সেই উত্তম কুমারকে নিয়েই তৈরি করেন ‘নায়ক’, ১৯৬৬ সালে। এই ছবিতে প্রতিষ্ঠিত একজন নায়ককে দিয়েই সত্যজিৎ প্রকাশ করেছেন একজন নায়ক, একজন তারকার অন্দরের-অন্তরের মানুষটিকে। স্টারডম কীভাবে একে একে পরিচিত জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে এক নতুন জগতে পৌঁছে দেয় সাধারণ একজনকে।
'অনেক রকম সিঁড়ি আছে ওঠার এবং নামার'......তারকার অনেক তাড়া থাকে। তাড়াতাড়ি নাম করতে হবে। প্রশংসা, হাততালি কুড়োতে হবে। অর্থ উপার্জন করতে হবে। তার জন্য নানা সিঁড়ি দরকার। যদিও সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায় সেই সব কাহিনী। সত্যজিৎ রায় ৫৫ বছর আগে উত্তম কুমারের মত একজন বড় তারকাকে নিয়ে ছবি বানিয়ে সেই ইঙ্গিতই দিয়ে গেছেন।
এই সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতের সকল নায়কের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের স্থানটি যেভাবে অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন উত্তম কুমার, তা সত্যিই ছিল অতুলনীয়।
মহানায়ক উত্তম কুমারের আসল নাম অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। কলকাতায় জন্ম ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বরে। কলকাতার সাউথ সাবার্বান স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং পরে গোয়েঙ্কা কলেজে ভর্তি হন। কলকাতার পোর্টে চাকরি নিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও গ্রাজুয়েশন শেষ করতে পারেননি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসে চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে।
বসু পরিবার চলচ্চিত্র দিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা উত্তম কুমার এরপর 'সাড়ে চুয়াত্তর'-এ অভিনয় করে চলচ্চিত্র জগতে স্থায়ী আসন লাভ করেন। সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে তিনি প্রথম অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের বিপরীতে অভিনয় করেন। এই ছবির মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সফল উত্তম-সুচিত্রা জুটির সূত্রপাত হয়। উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন বাংলা চলচ্চিত্রে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে অনেকগুলি ব্যবসায়িকভাবে সফল এবং একই সাথে প্রশংসিত চলচ্চিত্রে মুখ্য ভূমিকায় একসাথে অভিনয় করেছিলেন। এগুলির মধ্যে প্রধান হল - হারানো সুর, পথে হল দেরী, সপ্তপদী, চাওয়া পাওয়া, বিপাশা, জীবন তৃষ্ণা এবং সাগরিকা।
উত্তম কুমার বহু সফল বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। তার অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্রের মধ্যে ছোটিসি মুলাকাত, অমানুষ এবং আনন্দ আশ্রম অন্যতম। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় দু’টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। প্রথমটি নায়ক এবং দ্বিতীয়টি চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানা চলচ্চিত্রে তিনি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
এই মহানায়ক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই মারা যান।