মডেল তিন্নি হত্যাকাণ্ডের দুই দশক পর মামলার রায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

নভেম্বর ১৫, ২০২১, ০২:৪২ পিএম

মডেল তিন্নি হত্যাকাণ্ডের দুই দশক পর মামলার রায়

একসময়ের জনপ্রিয় মডেল ও অভিনেত্রী সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যা মামলায় একমাত্র আসামি জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে আজ (১৫ নভেম্বর) রায় ঘোষণা করা হবে। ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক কেশব রায়চৌধুরীর আদালত এ রায় ঘোষণা করবেন।  ২০০২ সালে হত্যাকাণ্ডের ১৯ বছর পর এই মামলার রায় ঘোষণা হতে যাচ্ছে।

এর আগে গত ২৬ অক্টোবর ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ কেশব রায়চৌধুরীর আদালতে মামলার রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য ছিল। ওইদিন বিচারক রায় ঘোষণা না করে সোমবার (১৫ নভেম্বর) নতুন দিন ধার্য করেন।

সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী আমিনুল ইসলাম জানান, রাষ্ট্রপক্ষ ২০০২ সালে সংঘটিত মডেল তিন্নি হত্যাকাণ্ডের মামলাটি পুনরায় শুনানি করার জন্য একটি আবেদন করেছেন। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারক মামলার রায়ের পরবর্তী ওই তারিখ ধার্য করেন।

মামলার নথি থেকে জানা যায়, রাজধানীর কেরানীগঞ্জের বুড়িগঙ্গা নদীর ১ নম্বর চীন-মৈত্রী সেতুর পাশে ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর রাতে জবাইকৃত একটি অজ্ঞাত লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। পরের দিন অজ্ঞাত পরিচয়ে আসামির বিরুদ্ধে মামলা করেন কেরানীগঞ্জ মডেল থানার তৎকালীন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. সফি উদ্দিন।

সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. সফি উদ্দিন। এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ওই থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) মো. কাইয়ুম আলী সরদার।

পরবর্তীতে লাশটি তিন্নির শনাক্ত হলে মামলাটি চাঞ্চল্যকর উল্লেখ করে ২০০২ সালের ২৪ নভেম্বর তদন্তভার সিআইডিতে ন্যস্ত হয়। মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির পরিদর্শক সুজাউল হক, সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) গোলাম মোস্তফা, এএসপি আরমান আলী, এএসপি কমল কৃষ্ণ ভরদ্বাজ ও এএসপি মোজাম্মেল হক। সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর সাবেক ছাত্রনেতা ও সংসদ গোলাম ফারুক অভিকে একমাত্র আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।

২০০২ সালের ১০ নভেম্বর বুড়িগঙ্গায় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর নিচে তিন্নির লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ থানা-পুলিশ অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা করে। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর সাবেক সাংসদ গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, গোলাম ফারুক অভির প্ররোচনায় মডেল ও অভিনেত্রী তিন্নি তাঁর স্বামীকে তালাক দেন। অভি পরে তিন্নিকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানালে তিন্নি এসব তথ্য মিডিয়ায় ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর সন্ধ্যার পর রাতের কোনো এক সময় তিন্নিকে হত্যা করে লাশ গুম করার জন্য গাড়িতে করে কেরানীগঞ্জ থানাধীন ১ নম্বর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর নিচে ফেলে রাখে।

অভির কারণে লন্ডভণ্ড তিন্নির পরিবার

মডেল তিন্নির হত্যা তার পুরো পরিবারকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। মৃত্যুর সময় তিন্নি ছিলেন এক কন্যা সন্তানের মা। এই হিসেবে মেয়েটির বয়স এখন ২০ বছর। জানা গেছে, তিন্নির মেয়ে এখন বাবার সাথে বিদেশে থাকেন। তিন্নির দুই বোনের  একজন একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্সে বিমানবালা হিসেবে কর্মরত আছেন। স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে তিন্নির মা বর্তমানে পাকিস্তানে থাকেন।

রাজধানীর কলাবাগানে তিন্নির যে ফুপুর বাড়িতে তিন্নিরা থাকতেন, অভির (তিন্নি হত্যা মামলার একমাত্র আসামি) ভয়ে বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছেন। এভাবেই একটি হত্যাকাণ্ডে তছনছ হয়ে গেছে তিন্নির পরিবার।

কে এই মডেল তিন্নি?

পুরো নাম সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি। মাত্র ২৫ বছর বয়সে হত্যাকাণ্ডের শিকা্র হন এক সময়ের জনপ্রিয় প্রিয় এই মডেল। শোবিজে তার প্রবেশ ১৯৯৯ সালে, ৱ্যাম্প মডেলিং দিয়ে। প্রথম টিভি বিজ্ঞাপন হেনোলাক্স ক্রীম দিয়ে তিনি ব্যাপক পরিচিতি পান।

পরবর্তীতে তিনি স্টারশিপ কনডেন্সড মিল্ক, লিজান মেহেদী, গন্ধরাজ তেল,এলিট পেইন্ট,কোয়ালিটি আইসক্রিম,বম্বে উপটান,ও রিচি জুসের বিজ্ঞাপন করে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। কয়েকটি টিভি নাটকেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। পরিচালক বাদল খন্দকারের একটি চলচ্চিত্রে চুক্তিবদ্ধ হয়েও পরে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন।

কে এই অভি, কোথায় তিনি?

অভির পুরো নাম গোলাম ফারুক অভি। সাবেক এই ছাত্রনেতার উত্থান ঘটে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে। এসএসসি এবং এইচএসসিতে বোর্ড পর্যায়ে মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া এই অসম্ভব মেধাবী শিক্ষার্থী নব্বইয়ের গণআন্দোলন ঠেকাতে এরশাদের নেক নজর পান। ওই সময় অপহরণ ও মুক্তিপণ এবং চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। তিনি নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলেন। এক পর্যায়ে তিনি তিনি গ্রেপ্তার হন। তবে নব্বইয়ের গণআন্দোলনের চরম পর্যায়ে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে তাকে কারাগার থেকে ছাড়া হয়। আর ছাড়া পেয়েই পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। এত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরও তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের হাত ধরে ১৯৯৬ সালে বরিশাল-২ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

চাঞ্চল্যকর তিন্নি হত্যা মামলার ফেরারি আসামি গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন (ইন্টারপোল)। তবে দীর্ঘ ১৯ বছরেও তার কোনো সন্ধান বা কোনো ধরনের তথ্য ইন্টারপোল বাংলাদেশ পুলিশ সদরদপ্তরকে জানাতে পারেনি।

ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারির শর্ত অনুযায়ি, প্রতি পাঁচ বছর পরপর পুনরায় ইন্টারপোলে আবেদন করতে হয়। ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি ফের পুলিশ সদরদপ্তর থেকে অভির বিরুদ্ধে আবেদন করা হলে পুনরায় ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে। কিন্তু ইন্টারপোল তার ব্যাপারে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। পরবতীতে ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি তৃতীয় বার আবেদন করা হলেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।  

সূত্রগুলো বলছে, বর্তমানে  কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বসবাস করা অভি দেশে ফিরতে মরিয়া ছিলেন। যে কোনো উপায়ে তিনি দেশে ফিরতে শুরু করেছিলেন লবিং-তদবির। আর এ জন্য কয়েক বছর ধরে দফায় দফায় তিনি চেষ্টা করেন।  তবে সরকারে বিভিন্ন পর্যায়ে তদবির করেও এ ব্যাপারে এখনো কোনো ইতিবাচক সাড়া পাননি।

এর আগেও ২০০৯ সালে মহাজোট সরকারের যাত্রা শুরুর পর গোলাম ফারুক অভি দেশে ফেরার উদ্যোগ নেন ক্ষমতাসীন দলের কয়েক নেতার সহযোগিতায়। কিন্তু বিষয়টি তখন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের ওই নেতারা অভিকে দেশে ফেরানোর বিষয়ে পিছু হটেন। একপর্যায়ে দেশে ফেরার জন্য ২০০৯ সালের ৯ অক্টোবর অভি রাষ্ট্রপতির কাছেও আবেদন করেন।

Link copied!