দেখতে দেখতে বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু সেইদিনের জোড়া গোলের স্মৃতি এখনো পিয়াস আহম্মেদ নোভার স্মৃতিতে ভাস্বর। ডায়েরি লেখার অভ্যাস তরুণ স্ট্রাইকার নোভার না থাকলেও স্মৃতিশক্তি যে তার প্রখর সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই! গুণে গুণে দিন-তারিখ একেবারে মুখস্থ বলে দিলেন। ২৭ জুলাই, ২০২২। দিনটি আমৃত্যু মনে থাকবে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সন্তান নোভার। ওইদিন সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপে শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ যে ২-১ গোলের ব্যবধানে জয় পায়, সেখানে জোড়া করে করেছিলেন নোভা। সেটা আবার ভারতের মাটিতে ওড়িশার কালিঙ্গা স্টেডিয়ামে। ওই ম্যাচের পর দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দিলেও ঘরোয়া ফুটবলে সেভাবে আর আলোচনার জন্ম দিতে পারেননি। ক্লাব কর্তাদের মন ভরাতে পারেননি নোভা!
বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবল সংস্কৃতি একটু ভিন্ন ধাঁচের। দেশি স্টাইকারদের এখনো সুযোগ খুব সহজে মেলে না। অনেক লড়াই-সংগ্রাম করে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়; জায়গা করে নিতে হয় মূল একাদশে। সদ্য শেষ হওয়া ২০২২-২৩ ফুটবল মৌসুমে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবে ছিলেন নোভা। বড় ক্লাবে থাকলেও মাঠে নামার তেমন একটা সুযোগ পাননি। ৬/৭টা ম্যাচে খেলেছেন। ক্লাবগুলো বিদেশি ফরোয়ার্ডদের যেভাবে সুযোগ দেন, দেশি ফরোয়ার্ডরা সেভাবে সুযোগ পান না বললেই চলে। দু’চার ম্যাচে যাও সুযোগ মেলে কিন্তু সেখানে সময়ের ব্যপ্তি থাকে কম। তবে ঘরোয়া ফুটবলে অবহেলিত হলেও জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছেন এ মেধাবী ফুটবলার। আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে চীনের হ্যাংজু শহরে অনুষ্ঠিত হবে এশিয়ার অলিম্পিক খ্যাত এশিয়ান গেমস বা এশিয়াড। বাফুফে ঘোষিত ২২ সদস্যের চূড়ান্ত দলের একজন হলেন কুষ্টিয়ার নোভা।
বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে নোভা যে শুধু সাফ অনূর্ধ্ব-২০ টুর্নামেন্টেই ভালো খেলেছেন এমন কিন্তু নয়। এর আগে ২০১৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত উয়েফা অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টে যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ, সেখানেও ফাইনালে গোল করেছিলেন নোভা। এছাড়া অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ, অনূর্ধ্ব-১৬ এএফসি কাপ কিংবা গত বছর বাহরাইনে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-২০ এএফসি কাপ বাছাইপর্বেও দারুণ পারফরম্যান্স ছিল নোভার। সেসব বিবেচনায় রেখেই এবারের এশিয়াডে সুযোগ দেয়া হয়েছে এ মেধাবী ফুটবলারকে। প্রথমবার এশিয়ার বড় মঞ্চে খেলতে যাচ্ছেন এই খবরে যারপরনাই খুশি তিনি। হ্যাংজুতে ভারত, স্বাগতিক চীন এবং শক্তিশালী মিয়ানমারের বিপক্ষে খেলবে বাংলাদেশ। গতবার এশিয়ান গেমসের দ্বিতীয় রাউন্ডে গিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল বাংলাদেশ। এবার নতুন ইতিহাস রচনার ঘোষণা দিয়ে রাখলেন নোভা।
নোভা একজন সাহসী ফুটবলার। শুধু মুখেই তিনি সাহসের প্রমাণ রাখতে চান না; খেলার মাঠেও সেটা করে দেখাতে চান। এশিয়ান গেমসে ভালো খেলে জায়গা করে নিতে চান মূল জাতীয় দলে। বাংলাদেশকে শুধু এশিয়ার মঞ্চেই সেরা হিসেবে নয়; নিয়ে যেতে চান বিশ্বকাপের রঙিন মঞ্চে। এটা কোনো স্বপ্নের কথা নয়। বাস্তবে করে দেখাতে চান নোভা। এ ব্যাপারে তিনি জানান, ‘বাংলাদেশ আর আগের দল নেই। আমাদের দল এখন যে কোনো দলের বিপক্ষে ১২০ মিনিট সমানতালে খেলার যোগ্যতা রাখে। দলে এখন অনেক তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড় খেলছেন। ভারতের মাটিতে সাফে দুর্দান্ত খেলে এসেছি আমরা। সামনে আরো চমক দেখতে পাবেন। যত বেশি ফ্রেশ লেগ দলে সুযোগ পাবে ততই উন্নতি করবে দল। তবে একটাই আফসোস নম্বর ৯-কে বেশি করে সুযোগ দিতে হবে। সাফে সেটা আমরা খুব ভুগেছি। আমাদের ক্লাব ফুটবল সংস্কৃতিটা একটু পরিবর্তন হলে সেদিন দূরে নয় যেদিন আমরা বিশ্বকাপে লাল-সবুজ দলকে দেখতে পাব।’
বিকেএসপির সাবেক শিক্ষার্থী পিয়াস আহম্মেদ নোভা এখন শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়। গত বছরের মতো আসন্ন ২০২৩-২৪ মৌসুমেও থাকছেন ধানমন্ডির ক্লাবটিতে। এর আগে প্রিমিয়ার লিগে নিজের শুরুটা করেছেন দেশসেরা ক্লাব বসুন্ধরা কিংস দিয়ে। শুরু থেকেই নোভা তার ক্যারিয়ারটা দারুণভাবে গুছিয়ে নিজেকে একটু একটু করে এগিয়ে নিচ্ছেন। আর নোভাকে সামনে এগিয়ে নেয়ার কাজটা পেছন থেকে করে যাচ্ছেন তারই আপন বড় ভাই পিয়াল আহম্মেদ শিভা। ক্যারিয়ারে আজ যতটা অর্জন নোভার; তার সবটুকুই হয়েছে বড় ভাইয়ের উৎসাহ আর প্রেরণায়। কুষ্টিয়ার মিরপুরের সেই ঈদগাঁ মাঠের অখ্যাত নোভাকে বিকেএসপিতে নিয়ে আসা থেকে ফুটবলে লাথি দেয়াটা তো শিখিয়েছেন শিভাই।
নোভা একজন পরিপূর্ণ স্ট্রাইকার। শারীরিক গঠন থেকে স্কিল, বল নিয়ে ছুটে চলার ক্ষিপ্রতা- সব দিক থেকে এগিয়ে ৬ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতার এ ফুটবলার। অনেক স্বপ্ন নিয়ে ফুটবলে এসেছেন তিনি। ক্লাব ফুটবলে অনেকদিন ধরেই শিরোপা বঞ্চিত শেখ জামাল। সামনে সেই খরা ঘোচাতে চান নোভা। মাঠে সুযোগ পেলে সেটা অবশ্যই বাস্তবে করে দেখাতে চান। ক্লাব ফুটবল আর বয়সভিত্তিক জাতীয় দলগুলোতে ভালো খেলে জায়গা করে নিতে চাই স্বপ্নের মূল জাতীয় দলে। সেটাকেই যে এখন পাখির চোখ করছেন তিনি।