ডিজিটাল ক্যাশ মিডিয়াম হিসেবে বাংলাদেশে বিকাশ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাক্তির আর্থিক লেনদেন এখন বিকাশের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। কিন্তু যতই এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, বিকাশ নিয়ে অনেককেই বিভিন্ন ধরণের প্রতারণা এবং ধোঁকাবাজির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এমনকি এই প্রতারণা ঠেকাতে বিকাশ কর্তৃপক্ষ কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। পুলিশ প্রশাসন এই প্রতারণা ঠেকাতে জনগণকে আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
থাইরয়েড ক্যান্সারের চিকিৎসা করতে সুদূর পঞ্চগড় থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল এসেছে মুস্তাকিমা মিতু(১৫)। দিনমজুর বাবার কষ্টেসৃষ্টে জমানো টাকায় অস্ত্রোপচার করতে পিজিতে চিকিৎসাধীন দশম শ্রেণীর এই শিক্ষার্থী। জাতীয় শিক্ষাবোর্ড ঢাকা পরিচয়ে মিতুর নাম্বারে একটি বাংলালিংক নাম্বার (০১৯৬৯৭৮৯৬৩৩)থেকে ফোন আসে। মিতুকে জানানো হয় বাংলাদেশ সরকার থেকে একটি বিশেষ অনুদানের জন্যে মিতু নির্বাচিত হয়েছে। এই অনুদানের টাকার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার। মিতুর নাম ঠিকানা এবং সর্বশেষ উত্তোলিত টাকার পরিমাণ উল্লেখ করে এই পঞ্চাশ হাজার টাকা আসার জন্যে তার বিকাশ একাউন্টে পঁচিশ হাজার টাকা থাকার কথা জানায় কথিত শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা। এই টাকা খুব অল্প কিছু শিক্ষার্থীকে দেয়া হবে উল্লেখ করে মিতুকে বলা হয় তার বিকাশ একাউন্টে পঁচিশ হাজার টাকা ক্যাশ ইন করার সাথে সাথেই সে অনুদানের টাকা মিতু তুলতে পারবে। ফোনে কথা বলতে বলতে কোন বিকাশের দোকানে গিয়ে টাকা পাঠানোর নির্দেশনা দেয়া হয়। মিতুকে নিশ্চিত করা হয় যে পঁচিশ হাজার টাকা বিকাশ একাউন্টে ক্যাশ ইন হওয়ার সাথে সাথেই সে বিকাশের এজেন্টকে সেই টাকা ফেরত দিয়ে দিতে পারবে। নিজের কাছে টাকা না থাকলেও পিজি হাসপাতালের তিন নাম্বার গেইটে একটি বিকাশের দোকানে সে অনুযায়ী টাকা ক্যাশ ইন করে মিতু। তার মিনিট কয়েক পরেই মিতু বুঝতে পারে তার টাকা কৌশলে উঠিয়ে নিয়েছে প্রতারক। নগদ টাকা না পেয়ে অসুস্থ মিতুকে আটকে রাখে বিকাশ এজেন্ট। খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে নগদ টাকা পরিশোধ করে মিতুকে উদ্ধার করে তার ভাই। এই ঘটনায় শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়রি করেছে মিতুর ভাই রওশন কবির বিপুল(৩০)।
ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে অফিস সহায়কের কাজ করেন মোহাম্মদ কাশেম ভুইয়া(৩৫)। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে দশ হাজার টাকা এক ব্যক্তির কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে লেনদেন করেন কাশেম ভুইয়া। রাজধানীর একটি আনন্দ বাজারের আলম বিকাশ এজেন্টের দোকান থেকে এই টাকা পাঠানো হয়। একটু পরেই আলম বিকাশ এজেন্টের দোকান থেকে বলছি 'এই পরিচয়ে' কাশেম ভুইয়াকে ০১৮৮২১৯৬৮৯২ এই নাম্বার থেকে ফোন করা হয়। ফোন করে জানানো হয় বিকাশের দোকানে ভুল করে একটি নাম্বারে বিশ হাজার টাকা লেনদেন হয়েছে। ভুল করে পাঠানো টাকা বিষয়ে বিকাশ প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ করতে গিয়ে ভুলে আপনার নাম্বারে অভিযোগ করা হয়েছে। এখন এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের জন্যে আপনার বিকাশ একাউন্টটি বন্ধ করে দিতে পারে বিকাশ কাস্টমার সার্ভিস।
এই তথ্য জানতে পেরে কাশেম ভুইয়া, তড়িঘড়ি করে আলম বিকাশ এজেন্টের মাধ্যমে যে ব্যক্তি টাকা পাঠিয়েছিল তার কাছে তাকে ফোন করেন। তিনিও একই নাম্বারে ফোন করে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। যেহেতু কাশেমকে পাঠানো টাকার পরপরই বিশ হাজার টাকার লেনদেন হয় সেই অনুযায়ী ভুল নাম্বারটি লিখতে গিয়ে খতায় লিখিত থাকা ঠিক তার উপরে থাকা কাশেমের নাম্বারটি লিখাটা অবিশ্বাস্য মনে হয়নি। এখন কাশেমের বিকাশ একাউন্টন্টি বন্ধ থেকে বাচাতে চাইলে তাকে আরেকটি নাম্বারের (০১৬২০৭২৬৫৩৮) কথা বলা হয় এবং সে নাম্বার বিকাশ কাস্টমার সার্ভিসের বলে কথিত ব্যক্তি উল্লেখ করেন।
এমতাবস্থায় কথিত কাস্টমার সার্ভিসের লোকটি কাশেম ভূইয়াকে ফোন দিয়ে তার একাউন্টের সুরক্ষার কথা বলে পিন নাম্বার এবং ওটিপি নাম্বার নিয়ে যান এবং প্রথমে ১৮ হাজার টাকা নেওয়ার পর বলে যে আর ২০ হাজার টাকা ঢুকালেই তার বিকাশ নাম্বারটি সম্পূর্ণ সুরক্ষিত হয়ে যাবে।কাশেম ভূইয়া ক্ষণিকের জন্য সবকিছু বিশ্বাস করে তার বিকাশে থাকা ১৮ হাজার টাকা এবং পরবর্তীতে আরও ২০ হাজার টাকা ঢুকানোর পর যখন দেখে তার একাউন্ট শূন্য তখন সে বুঝতে পারে তার কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে। পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে দুইটি নাম্বার থেকে কথিত বিকাশ এজেন্টের দোকান পরিচয়ে কথা বলেছিল দুইটি নাম্বারই প্রতারকের। বিকাশ এজেন্টের নাম্বার পরিচয়ে ফোন দেয়া ব্যক্তির নাম্বার এবং তার পরবর্তী বিকাশ কাস্টমার সার্ভিসের নাম্বারটিও ছিল প্রতারকের।দুটি ঘটনাই ঘটে ২৮ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার বিকেল ও সন্ধ্যায় যথাক্রমে শাহবাগ এবং আনন্দ বাজার।
এইভাবেই বিকাশ ব্যবহার করে নিত্যনতুন কৌশলে প্রতারণা করে যাচ্ছে প্রতারকরা। মানুষের সরল বিশ্বাসকে আশ্রয় করে এই প্রতারণা চক্র দিন দিন হয়ে উঠিছে ভয়ংকর। প্রথম ঘটনায় শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়রি করেছে মিতুর ভাই আর দ্বিতীয় ঘটনার সাধারণ ডায়রি নেয়া হয়নি।
পুলিশ বলছে এই ধরণের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে তদন্তের পর দেখা যায় নির্দোষ মানুষ হয়রানির স্বীকার হয়। কথা বলতে চাইলে ভুক্তভোগী মিতুর ভাই রওশন কবির বিপুল দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন,সাধারণ ডায়রি করার পর দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তাসহ আমরা ঘটনাস্থলে যাই। কোন সুরাহা হয়নি পুলিশ বলছে এর কোন সমাধান নেই। কিন্তু এইভাবে মানুষের অর্থ হাতিয়ে নেয়াতো অপরাধ, এই অপরাধের কি কোন সমাধান নেই তিনি প্রশ্ন রাখেন।
এই প্রতারণা সম্পর্কে আইনি সুরক্ষা কি হতে পারে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপির উপপুলিশ কমিশনার (ডিবি রমনা জোনের ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, আমাদের জীবনের গভীরতম অংশে তথ্য প্রযুক্তির প্রভাব খুবই কম মানুষের ঘটেছে এবং এই ব্যবহার অতন্ত সামান্য। যারা প্রতারণা করছে তারা কিন্তু প্রতারণার শিকার যারা তাদের চেয়ে অনেক বেশি তথ্য প্রযুক্তির জানা-বোঝায় এগিয়ে। তথ্য প্রযুক্তির যে নেতিবাচক দিকগুলো আছে সেগুলোকে তারা ব্যবহার করছে প্রতারণার কৌশল হিসেবে। মানুষের ভিতরে যখন তথ্য প্রযুক্তির জ্ঞান আরও বাড়বে তখন এই ধরনের আর্থিক প্রতারণা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। আমি মনে করি মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন। এই ধরণের প্রতারণা অভার নাইট রোধ করা যাবে না। এই ক্ষেত্রে তথ্য মন্ত্রণালয় এবং গণমাধ্যম কর্মীদের আরও সচেতন ভূমিকা রাখতে হবে।
এই লাগামহীন প্রতারণার কারণে বিকাশ কর্তৃপক্ষের উপর অনাস্থা তৈরি হচ্ছে, সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বিকাশ সেবা নিয়ে। এমতাবস্থায় কাষ্টমার স্বার্থসুরক্ষায় বিকাশ কর্তৃপক্ষের কি ভাবছে জানতে চাইলে বিকাশের হেড অব কর্পোরেট কমিউনিকেশন্স জনাব শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, এমএফএস খাতের প্রতারণার সব ঘটনাই সামাজিক কৌশল (Social Engineering) করেই করা হয়ে থাকে। প্রতারকরা গ্রাহকদের লোভ-ভয় দেখিয়ে এবং অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে গ্রাহকের এমএফএস অ্যাকাউন্টের পিন-ওটিপি নিয়ে কাজটি করে থাকে। তাই প্রতারণা প্রতিরোধে গ্রাহক সচেতনতার কোন বিকল্প নেই।
তিনি আরও বলেন, বিকাশ শুরু থেকেই গ্রাহক সহ সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতনতা বাড়াতে নিয়তিম পদক্ষেপ নিয়ে আসছে। বছর জুড়ে বিকাশই কেবল গণমাধ্যম সহ বিভিন্ন মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে, যা অব্যাহত থাকবে। তার সুফলও পাচ্ছেন গ্রাহক। গ্রাহক সচেতনতা বাড়ার কারণে প্রতারণার হারও কমছে। লক্ষ-কোটি গ্রাহক প্রতিদিন নির্ভরতার সাথে নিরাপদে বিকাশের মাধ্যমে লেনদেন করছেন।