ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২২, ১১:২১ পিএম
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি খুন হয়েছিলেন। সাগর তখন মাছরাঙা টিভিতে আর রুনি এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের সময় বাসায় ছিল তাদের সাড়ে চার বছরের ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘ। এই মামলায় আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ ৮৫ বার পিছিয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের স্পেশাল প্রসিডিউরস থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, উচ্চ আদালত ২০১২ সালেই র্যাবকে এই মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেন। গত বছর ২৪ নভেম্বর আদালত ৮৪তম বারের মতো র্যাবকে তাদের তদন্তের ফলাফল জমা দিতে বলেন; যা এখনো সম্পন্ন হয়নি।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে অন্তত ১৫ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের বিনা বিচারে আটক, আক্রমণ, অপহরণ, অনলাইন ও অফলাইনে ভীতি প্রদর্শন এবং আইনি হয়রানির শিকার হওয়ার বহু খবর পেয়েছেন।
এসব ঘটনার তদন্ত বা বিচার হয়নি বললেই চলে। নিপীড়নের কিছু ঘটনায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সরাসরি জড়িত বলে ধারণা করা হয়। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন অভিযোগ বাংলাদেশ সরকারের নজরে আনলেও প্রায়ই কোনো জবাব দেওয়া হয় না। ২০১২ সালে সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের পর জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের পাঠানো চিঠির কোনো জবাব সরকারের কাছ থেকে কখনই পাওয়া যায়নি।
এক দশকেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষ না হওয়া এবং দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে না পারায় উদ্বেগ জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশে দায়মুক্তির সংস্কৃতির কারণেই এই বিচার হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন তাঁরা।
আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের দশকপূর্তির দিনে শুক্রবার জেনেভা থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তাদের এই উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচার না হলে অপরাধীরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে এবং তা সংবাদমাধ্যমকে ভয় দেখিয়ে চুপ করানোর উদ্দেশ্যে আরও আক্রমণ, ভীতি প্রদর্শন ও হত্যাকাণ্ডে উৎসাহ জোগায়। আমরা বাংলাদেশে গভীর উদ্বেগের সেই লক্ষণগুলো দেখছি।’
এই বিশেষজ্ঞরা হলেন জাতিসংঘের মতপ্রকাশ ও বাক্স্বাধীনতাবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান, মানবাধিকারকর্মীদের অবস্থাবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার মেরি লঅলার, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা ও সমিতি গঠনের অধিকারবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ক্লেমেন্ট এন ভৌল, নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অসম্মানজনক আচরণ বা শাস্তিবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার নিলস মেলজার এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা বা বিধিবহির্ভূত হত্যাবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার মরিস টিডবল–বিঞ্জ। এসব বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ও স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের স্পেশাল প্রসিডিউরসের (জাতিসংঘের মানবাধিকারব্যবস্থায় স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের সর্ববৃহৎ পর্ষদ) অংশ।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে গুলিতে নিহত সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী আবদুল হাকিম শিমুলের মামলার বিচারকার্য বারবার বিলম্বিত হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। শাহজাদপুরের তৎকালীন মেয়রের বিরুদ্ধে এই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের আওতায় মামলার সব আসামি বর্তমানে জামিনে আছেন।
এ ছাড়া ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কারাবন্দী অবস্থায় মারা যাওয়া লেখক মুশতাক আহমেদের কথাও বিশেষজ্ঞরা স্মরণ করেছেন। করোনা মহামারি মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের সমালোচনা করেছিলেন মুশতাক আহমেদ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে ৯ মাসের মাথায় মৃত্যু হয়েছিল তার।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় মুশতাক আহমেদ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন এবং অসুস্থ হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নিতে তিন ঘণ্টা দেরি হয়েছিল বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হলেও তার মৃত্যুর বিষয়ে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ। তার বদলে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় গঠিত অভ্যন্তরীণ একটি তদন্ত কমিটি পরিবারের দাবির বিষয়ে তদন্ত না করেই তার মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলেছে। এ বিষয়ে উদ্বেগ জানানোর পরেও জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা সরকারের কাছ থেকে কোনো জবাব পাননি।
তারা বলেছেন, ‘আক্রমণ, ভয়ভীতি ও হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার সহজাত ঝুঁকি থেকে সাংবাদিকতা মুক্ত থাকা উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেটাই বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও সুশীল সমাজের সদস্যদের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি এবং বাংলাদেশের অন্যান্য সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার দ্রুত পরিপূর্ণ, স্বাধীন ও কার্যকর তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা।