ঘটনার রাতে চারটি স্থানে কেন ঘুরলেন ফারদিন, জবাব খুঁজছে ডিবি

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

নভেম্বর ১৮, ২০২২, ১২:২২ এএম

ঘটনার রাতে চারটি স্থানে কেন ঘুরলেন ফারদিন, জবাব খুঁজছে ডিবি

ঘটনার সেই মধ্য রাতে চারটি স্থানে ঘুরেছেন বুয়েট ছাত্র ফারদিন নূর পরশ। যাত্রাবাড়ী থেকে তিনি উঠেছিলেন লেগুনায়। তাঁর এই বিক্ষিপ্ত ঘোরাঘুরির কারণ কী ছিল; খুন কেন, কোথায় হলেন, সেসব প্রশ্নের উত্তর এখনও জানতে পারেনি ডিবি। এখন সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজছে তাঁরা। এই প্রশ্নের জবাব মিললে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অনেকটাই সত্য উদঘাটন হবে বলে ডিবি মনে করছে।

বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরার রিকশা থেকে রামপুরায় নেমে যাওয়ার পর মধ্যরাতে বুড়িগঙ্গা পাড়ে কেরানীগঞ্জে ফারদিন নূর পরশের অবস্থান শনাক্তের কথা আগেই জানিয়েছিল গোয়েন্দা পুলিশ; এখন গুলিস্তান হয়ে তাঁর যাত্রাবাড়ী যাওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত হয়েছে তাঁরা।

রাত ২টার পর যাত্রাবাড়ী থেকে রূপগঞ্জের তারাবমুখী একটি লেগুনায় এই বুয়েটছাত্রের ওঠার দৃশ্য একটি সিসি ক্যামেরায়ও ধরা পড়েছে বলে দাবি করেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান, অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ।

শীতলক্ষ্যা নদীর যে পাড়ে তারাব, তার বিপরীত পাড়ের চনপাড়া এরই মধ্যে এসেছে আলোচনায়। চনপাড়ায় মাদক বিক্রেতাদের পিটুনিতে ফারদিন মারা যান বলে র‌্যাবের বিভিন্ন সূত্র উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমে খবর এসেছে।

তবে ডিবি কর্মকর্তা হারুন বলছেন, চনপাড়াতেই ফারদিনকে হত্যা করা হয়েছে কি না, তা এখনও তাঁরা নিশ্চিত নন। আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের দায়িত্ব ডিবির উপর ন্যস্ত হলেও র‌্যাবও এর ছায়া তদন্ত করছে।

ফারদিনের অত রাতে চনপাড়ায় যাওয়ার কোনো কারণ নেই, বলে আসছেন তাঁর বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা। রামপুরার পর ফারদিন কেন চারটি স্থান ঘুরে যাত্রাবাড়ী গেলেন এবং সেখান থেকে কেন তারাবর লেগুনায় উঠলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও জানতে পারেনি ডিবি।

এই যে সে বিভিন্ন জায়গাগুলোতে যাচ্ছে, আসলে সে কেন যাচ্ছে? আসলে তাঁর মন-মানসিকতা খারাপ ছিল কি না বা সে কোনো চিন্তায় ছিল কি না, কোনো টেনশনে ছিলেন কি না, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন কি না? সবকিছুই আমরা তদন্ত করছি। বলেছেন ডিবি কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ।

বুয়েটের পুরকৌশলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফারদিন (২৪) থাকতেন পরিবারের সাথে ঢাকার ডেমরার কোনাপাড়ায়। পরিবারে তিন ছেলের মধ্যে তিনিই ছিলেন সব থেকে বড়।

৪ নভেম্বর রাত থেকে নিখোঁজ ফারদিন। তিন দিন পর ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে পাওয়া যায় তাঁর লাশ।

ফারদিন নিখোঁজ হওয়ার পর জিডি করেছিলেন তার বাবা নূরউদ্দিন রানা; লাশ উদ্ধারের পর তিনি হত্যা মামলা দায়ের করেন, যাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বুশরাকে আসামি করা হয়।

৪ নভেম্বর দুপুরে বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর বুশরার সাথেই ছিলেন ফারদিন, রাতে এক রিকশায় তাঁরা রওনা হয়েছিলেন বনশ্রীতে বুশরার মেসের পথে।

রামপুরায় রিকশা থেকে নেমে যাওয়ার পর পরিচিত আর কেউ ফারদিনকে দেখেনি। তাঁর বুয়েটের হলে যাওয়া কথা থাকলেও সেখানে ফিরেননি ফারদিন। পরদিন পরীক্ষায় অনুপস্থিত দেখে সহপাঠিরা তাঁর বাসায় খবর দেয়।

তখন পরিবার জিডি করার পর রামপুরা থানা পুলিশ ফারদিনের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে তার সদরঘাটের দিকে যাওয়ার তথ্যটি পায়। জানা যায়, রাতে ফারদিনের মোবাইলের অবস্থান ছিল কেরানীগঞ্জে। এরপর তাঁর ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়, যা পরে তাঁর লাশের সাথে উদ্ধার হয়।

ঢাকা মহানগর ডিবির প্রধান হারুন বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, ৪ নভেম্বর রাত ৯টা থেকে সোয়া ২টা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন ফারদিন।

ডিবি প্রধানের ভাষ্য অনুযায়ী, রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে আমাতুল্লাহ বুশরার রিকশা থেকে রামপুরায় নামার পর ১১টার দিকে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় ছিলেন তিনি। সেখান থেকে তিনি পুরান ঢাকার জনসন রোডে আসেন সোয়া ১১টার কাছাকাছি সময়ে। রাত ১টার দিকে তার অবস্থান ছিল গুলিস্তান এলাকায়। এরপর তাকে রাত সোয়া ২টায় দেখা যায় যাত্রাবাড়ীতে।

“যাত্রাবাড়ী এলাকায় আমরা তাঁকে হাঁটতে দেখেছি। কিছুক্ষণ হাঁটার পরে সাদা গেঞ্জি পরা একটি ছেলে এসে তাকে নিয়ে গেল। সাদা লেগুনায় উঠলেন ফারদিন। সেই লেগুনায় তিন-চারজন লোক ছিল। তখন আনুমানিক সোয়া ২টা বাজে। ফারদিনকে তুলেই লেগুনাটি বিশ্ব রোড হয়ে তারাবোর দিকে চলে গিয়েছিল। আমরা সেই লেগুনা এবং তার চালককে নজরদারিতে রেখেছি। তাঁদের সাথে আমরা কথা বলব।” যোগ করেন হারুন।

ফারদিনকে কি জোর করে লেগুনায় তোলা হয়েছিল- জানতে চাইলে হারুন বলেন, “আমাদের কাছে দেখে মনে হয়েছে স্বাভাবিক কথাবার্তা বা কোনো বিষয় তাঁকে কোন প্ররোচনা দিয়েছে। আর সে একাই ছিল।”

হারুন বলেন, “এই যে সে বিভিন্ন জায়গাগুলোতে যাচ্ছে, আসলে সে কেন যাচ্ছে? আসলে তার মন-মানসিকতা খারাপ ছিল কি না বা সে কোনো চিন্তায় ছিল কি না অথবা কয়দিন পর তার বিদেশ যাওয়ার কথা, তার টাকা-পয়সা সংগ্রহ হয়েছে কি না, এরকম কোনো টেনশনে ছিলেন কি না, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন কি না? সবকিছুই আমরা তদন্ত করছি। রাত-দিন এক করে ডিবির টিম কাজ করছে।”

পুলিশেরই আরেক ইউনিট র‌্যাবকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, রাত আনুমানিক ২টা ৩৫ মিনিটে ফারদিনের অবস্থান ছিল চনপাড়া বস্তি এলাকায়।

চনপাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও তার অবস্থান শীতলক্ষ্যা নদীর ডেমরার পাড়ে সুলতানা কামাল সেতুর উত্তর পাশে। এটি নদীর মাঝে উপদ্বীপের মতো একটি এলাকা। ডেমরা থেকে সেখানে যাওয়ার পথ আছে, একটি সেতু দিয়ে সেখানে যেতে হয়। আর যাত্রাবাড়ী থেকে রওনা হলে ফারদিনের বাড়ি কোনাপাড়া ডেমরার খানিকটা আগে।

ফারদিন কোথায় যেতে তারাবর লেগুনায় উঠেছিল?— এমন বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবি কর্মকর্তা হারুন বলেন, আসলে কীভাবে ঘটনাটি ঘটেছিল, সে বিষয়ে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে জানতে পারিনি। একটা লেগুনা গাড়িতে যেখানে ১৮ জন যাত্রী থাকার কথা, সেখানে ৩ থেকে ৪ জন লোকসহ ফারদিনকে তুলে তাকে বিশ্বরোডের দিকে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে ঘটনাটি ঘটেছে কি না, সেটা আমরা তদন্ত করছি। 

ফারদিন চনপাড়ায় মাদক বিক্রেতাদের হাতে নিহত হয়েছিলেন, এমন তথ্য আসার বিষয়টি তুলে ধরা হলে হারুন বলেন, “আমি আমারটাই বলছি। অন্যরা কে কী বলল, তা জানি না।”

হত্যার ঘটনা কি চনপাড়াতেই ঘটেছিল- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমাদের কাছে এখনও এমন মনে হচ্ছে না। আমরা আমাদের তদন্তটা করছি।”

বুশরাকে ইতোমধ্যে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে গোয়েন্দা পুলিশ; কিন্তু তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে খুনের বিষয়ে কোনো তথ্য না পাওয়ার কথা জানান ডিবি কর্মকর্তা হারুন।

Link copied!