অনেক বাঙালি হিন্দু নারী এ বছরও দুর্গাপুজোয় অংশ নিতে পারবেন না, যে রীতি চলে আসছে বহু যুগ ধরে। হিন্দু শাস্ত্রে বলা আছে রজঃস্বলা নারী, অর্থাৎ পিরিয়ড চলছে এমন নারীরা কোনও ধরনের পুজো অর্চনা করতে পারেন না, কারণ ওই কয়েকটা দিন তাদের ‘অশৌচ’।
তবে এবারে কলকাতার একটি সর্বজনীন দুর্গাপুজো রজঃস্বলা নারীদেরও পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। যদিও হিন্দু শাস্ত্র বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটা শাস্ত্র-বিরোধী।
এর আগে কোনও কোনও নারী বিচ্ছিন্নভাবে পিরিয়ডের সময়ে পুজো করার ছবিসহ পোস্ট করেছেন সামাজিক মাধ্যমে এবং ট্রলের শিকার হয়েছেন।
কিন্তু দুর্গাপুজোর মতো একটা সর্বজনীন উৎসবের মাঝে ঋতুস্রাব নিয়ে খোলামেলা আলোচনা এবং ঋতুকালীন স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে প্রচার, বেশ সাহসী উদ্যোগ বলেই অনেকে মনে করছেন।
ছোট থেকেই শেখানো হয় ‘অশুচি’
দুর্গাপুজো কবে পড়েছে, সেই তারিখটা দেখে নিয়ে কোনও বছর নিশ্চিন্ত হন ইংরেজির অধ্যাপিকা মহুয়া ভৌমিক।
আবার কোনও বছর এমনও হয়েছে যে পুজোর মধ্যেই তার ঋতুচক্রের সময় পড়ে গেছে। সেইসব বছরে তিনি পুজো দেন না।
“যদিও আমার শিক্ষা, নারী সচেতনতা আর নারী অধিকার নিয়ে কাজ, আমার চিন্তাভাবনা বা লেখা আমাকে সব ধরনের কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসার শিক্ষাই দিয়েছে।
কিন্তু আমি এই একটা জায়গায় ব্যর্থ হয়েছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মহুয়া ভোৗমিক।
তার কথায়, “আসলে ছোটবেলা থেকে মা-দিদিমা এটা মনের ভেতরে গেঁথে দিয়ে গেছেন যে পিরিয়ডের সময়ে পুজো-অর্চনা করা যায় না, আমি অশুচি, এই সংস্কার থেকে আমি বেরিয়ে আসতে পারি নি এখনও।
তিনি বলেন, “মানসিকভাবে আমি যে দ্বিধাবিভক্ত, সেটা অবশ্য আমি লুকিয়ে রাখি না। আমার ছাত্রীদের যখন নারী অধিকার বা লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে কিছু শেখাই বা পড়াই, তখন এটাও বলে দিই যে আমি নিজে এই সংস্কার থেকে বেরতে পারি নি।”
“আমি বলতেই পারতাম যে আমি এইসব সংস্কার মানি না এবং সবাই সেটা নিয়ে কোনও সন্দেহও করত না কারণ আমার কাজকর্ম বা চিন্তাভাবনার সঙ্গে এটাই খাপ খায়। কিন্তু আমি আমার ব্যর্থতাটাও তুলে ধরি,” বলছিলেন কলকাতার এক কলেজের ইংরেজির ওই অধ্যাপিকা।
তার মতো একই ধারণা মা-ঠাকুমার কাছ থেকে পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী প্রীতিও।
“পিরিয়ড যে একটা খুব স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, এটা যে নিষিদ্ধ কোনও বিষয় নয়, সেই ধারণাটা অনেকটাই ভেঙ্গেছে, তবে সবাই পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারি নি।
আমি নিজেও পারি নি, কারণ একটা সাধারণ পরিবারের মেয়ে হিসাবে আমাকেও ছোটবেলা থেকে এই ব্যাপারটা মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে ঋতু-কালীন অবস্থায় ঠাকুর ছোঁয়া যাবে না,” বলছিলেন প্রীতি।
তিনি বলছিলেন, “তাতে অমঙ্গল হতে পারে, এরকম একটা ধারণা দেওয়া হয় আমাদের। কে আর বলুন যেচে অমঙ্গল ডেকে আনতে চায়।”
রজঃস্বলা নারীদের পুজোয় আহ্বান
প্রীতির সঙ্গে উত্তর কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলের একটি সর্বজনীন দুর্গাপুজো মণ্ডপে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল, আয়োজকেরা অবশ্য বলছে যে রজঃস্বলা নারীরা স্বচ্ছন্দে তাদের মণ্ডপে এসে অঞ্জলি দিতে পারেন, কোনও বাধা নেই।
তবে হিন্দু শাস্ত্র বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন শাস্ত্র মেনে পুজো করলে এটা করা যায় না।
এই সর্বজনীন পুজোর এবছরের থিম বা বিষয়-ভাবনার নাম ‘ঋতুমতী’। পাথুরিয়াঘাটা পাঁচের পল্লির ওই পুজোটি পরিচালনা করেন নারীরা।
মণ্ডপের ভেতরের অঙ্গসজ্জায় বোঝানো হয়েছে ঋতুচক্র বা মাসিক একটি খুব প্রাকৃতিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, এটা কখনই অশুচি করে না নারীদের।
ওই পুজো কমিটির প্রধান এবং এলাকার পুর-প্রতিনিধি ইলোরা সাহা বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “ঋতুচক্রের কারণেই তো নারীরা সন্তানের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা পায়, মা হতে পারে। অথচ সেটা নিয়েই যত ট্যাবু, লুকোচুরি আর কুসংস্কার চলে আমাদের সমাজে।``
“এটা যে একটা খুবই স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া, সেটা না বুঝিয়ে সমাজ আমাদের বোঝায় যে ওই সময়টাতে আমরা অশুচি হয়ে যাই, নোংরা হয়ে যাই।
কিন্তু দেখুন কামরূপ-কামাখ্যা মন্দিরে যে শক্তির আরাধনা হয়, সেটা তো যোনি-রূপেরই পুজো। সেই লাল জল আমরা পবিত্র হিসাবে মনে করি, অথচ নারীদের ঋতুচক্রের সময়ে অপবিত্র মনে করা হয়,” বলছিলেন মিজ সাহা।
তারা দুর্গাপুজোর মতো বিশালাকার সামাজিক প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে তাই ঋতুকালীন স্বাস্থ্য সচেতনতা আর এর সঙ্গে জড়িত কুসংস্কারগুলোকেই ভাঙ্গার চেষ্টা করছেন।
মিজ সাহার কথায়, “কয়েক লক্ষ মানুষ হয়তো আমাদের পুজো প্যান্ডেলে আসবেন, তাদের মধ্যে একশো জনও যদি ওই কুসংস্কারগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন বা ঋতুচক্রের সময়ে কী ধরণের স্বাস্থ্যবিধি পালন করা উচিত তা জানতে পারেন, সেটাকেই আমাদের সার্থকতা বলে মনে করব।”
যেভাবে সাজানো হয়েছে মণ্ডপ
মাসিকের সময়ে যে সব শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ রয়েছে, সেগুলো যে আসলে কুসংস্কার তা তুলে ধরার সঙ্গেই ঋতুকালীন স্বাস্থ্য সচেতনতার বিভিন্ন দিকও তুলে ধরা হয়েছে মণ্ডপটিতে।
প্যান্ডেলে প্রবেশপথের ঠিক পাশেই রয়েছে ঋতুস্রাবের দাগ সহ স্যানিটারি ন্যাপকিনের বড়সড় একটি মডেল লাগানো একটি শিবির, যেখান থেকে স্যানিটারি প্যাড বিলি করা হচ্ছে, দেওয়া হচ্ছে প্রচারপত্রও।
মূল মণ্ডপের ভেতরে যেখানে প্রতিমা রয়েছে, সেখানে কয়েকটি মূর্তি রয়েছে – দুই কন্যাশিশুকে নিয়ে এক মা মন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, আর মন্দিরের ভেতরে পুজোর কাজে অংশ নিচ্ছে তার দুই পুত্র শিশু।
ওই মা সহ সন্তানদের মূর্তিগুলি যেন দুর্গা এবং দুই কন্যা ও দুই পুত্রকে নিয়ে যে রূপে পূজিত হন দুর্গা, তাদেরই প্রতীক। অসুরকে দেখানো হয়েছে এমন এক প্রতীকরূপে, যেন তিনি নীতি পুলিশ হিসাবে ঋতুমতী নারীদের মন্দিরে প্রবেশ আটকিয়ে দিচ্ছেন।
“আমাদের মণ্ডপ জুড়ে আছে চিকিৎসক বা শিক্ষিকা বা যুদ্ধবিমান চালক নারীদের হাতে আঁকা ছবি। আরও রয়েছে আমাদের পাড়ারই অনেক নারীর মুখের ফটো, যারা নিজেদের ‘গর্বিত ঋতুমতী’ বলছেন। যোনিকে পবিত্র হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে,” বলছিলেন মিজ সাহা।
আবার এমন একটি শিল্পকর্ম রয়েছে মণ্ডপের মাঝখানে, যা দিয়ে বোঝানো হচ্ছে এক নারী ঋতুচক্র সম্বন্ধীয় কুসংস্কারগুলিকে হাত দিয়ে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন।
বন্ধুদের সঙ্গে ওই মণ্ডপে এসেছিলেন কলেজ ছাত্রী শ্রীপর্ণা মুখার্জি।
তিনি বলছিলেন, “এরকম একটা থিম খুবই জরুরি। এখনও বহু মানুষ পিরিয়ডের সময়ে কী কী স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা উচিত সেগুলো যেমন জানে না, তেমনই পুজো করতে না দেওয়ার মতো কুসংস্কারও এখনও অনেকেই মেনে চলেন।
পিরিয়ড নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করলেই ওগুলো থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব।”
আবার এক শিক্ষিকা মানসী সাহা-সরকার বলছিলেন, “ব্যাপারটা পুরোটাই তো বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানকে তো মেনে নিতেই হবে। তার সঙ্গে কুসংস্কারকে জড়িয়ে ফেললে তো চলে না।
আমরা যদি মনে করি যে ঈশ্বরের কাছে যাব, সেখানে আমার শরীরের পবিত্রতাটাই বড় কথা, সেখানে ঋতুচক্র একটা ফ্যাক্টর হয়ে ওঠার কথা নয়।”
শুধু নারী নয়, পুরুষও হতে পারে ‘অশুচি’
পিরিয়ডের সময়ে পুজো করা যাবে না, সেই সময়টায় নারীরা অশুচি, অর্থাৎ নোংরা থাকেন, এইসব ধারণা কোথা থেকে এল?
হিন্দু শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ ও পশ্চিমবঙ্গ বৈদিক অ্যাকাডেমির সচিব নবকুমার ভট্টাচার্য বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, শাস্ত্রে কোথাও ঋতুচক্র নিয়ে কিছু বলা নেই। যেটা রয়েছে তা হল ক্ষতাশৌচ বলে একটি শারীরিক অবস্থা নিয়ে কিছু নির্দেশ।
“শরীর থেকে রক্তপাত হলে সেই সময়ে অশুচি হয়ে যায় মানুষ। সেটাই ক্ষতাশৌচ।“
“নারী পুরুষ নির্বিশেষে ক্ষতাশৌচ অবস্থা চলাকালীন কোনও ধরনের পুজো অর্চনার কাজে নিষেধ রয়েছে শাস্ত্রে। পুরুষদের যদি দাড়ি কামাতে গিয়ে কেটে যায়, তাহলেও সে ক্ষতাশৌচের অবস্থায় চলে যায় এবং পুজো করতে পারে না।
একইভাবে নারীদের মাসিকের সময়ে যেহেতু রক্তপাত হয়, তাই তারাও ক্ষতাশৌচে পড়ে যান,” ব্যাখ্যা করছিলেন মি. ভট্টাচার্য।
তার কথায়, ক্ষতাশৌচের মধ্যে দুর্গাপুজো সহ কোনও পুজোই করার অনুমোদন নেই শাস্ত্রে।
“তাই কোনও সর্বজনীন পুজো যদি এরকম আহ্বান করে থাকে যে রজঃস্বলা নারীরা তাদের পুজোয় গিয়ে অঞ্জলি দিতে পারবেন, সেটা শাস্ত্র সম্মত নয়,” বলছিলেন মি. ভট্টাচার্য।
কিন্তু নারীদের ঋতুচক্রের সময়ে যে রক্ত নিঃসরণ হয়, সেটা তো কোনও চোট আঘাতের কারণে নয়। স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া এটি।
"সেই রক্তপাতও কীভাবে চোট-আঘাতের রক্তপাতের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে?"
পুজো নয় কেন?
শাস্ত্র অনুযায়ী ক্ষতাশৌচ তিন দিন ধরে চলার কথা।
কিন্তু কেন তিন দিনের উল্লেখ, কেন কোনও নারী যতদিন রজঃস্বলা থাকবেন, ততদিনই তাকে দূরে সরিয়ে রাখার বিধান দেয় না হিন্দু শাস্ত্র?
অধ্যাপিকা ও লেখিকা রোহিনী ধর্মপাল ব্যাখ্যা করছিলেন, “আমি নিজে পুজো অর্চনায় বিশ্বাস করি না, কিন্তু মনু সংহিতায় যেখানে তিন দিন অশৌচ পালন করার বিধি রয়েছে, সেটা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে যে ঋতুস্রাব নিঃসরণ সবথেকে বেশি হয় তিনদিন ধরে। তাই ওই তিন দিন শুধু পুজো অর্চনা নয়, সব কাজ থেকেই নারীদের সরিয়ে রাখার কথা বলা হয়েছে।”
“ঋতুচক্রের সময়ে নারীদের শরীর দুর্বল হয়ে যায় আর তিনদিন সবথেকে বেশি নিঃসরণের ফলে ওই তিনদিন বেশি করে বিশ্রাম দরকার।”
তিনি বলছেন, “উদ্দেশ্যটা সম্ভবত ছিল ঋতুচক্রের সময়ে নারীদের বিশ্রাম দেওয়া। তাই পুজো, রান্না সহ সংসারের সব কাজ থেকে দূরে রাখার কথা বলা হয়েছিল।”
“এটা ঠিকই যে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে রজঃস্বলা নারীদের সব শারীরিক কষ্টগুলো আটকানো যায় না। কিন্তু সেক্ষেত্রে তো যতদিন পিরিয়ড চলবে, ততদিনই বিশ্রাম দেওয়া উচিত নারীদের,” বলছিলেন মিজ ধর্মপাল।
তার আরও প্রশ্ন, “আজকাল যদি পিরিয়ডের সময়ে সবধরনের কাজ করতে পারি, তাহলে পুজো কেন করা যাবে না?”