দিল্লি সফরে তুলসি গ্যাবার্ড, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যা বললেন

সোহেল তারেক

মার্চ ১৭, ২০২৫, ০৭:১৭ পিএম

দিল্লি সফরে তুলসি গ্যাবার্ড, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যা বললেন

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের দূরত্ব তৈরি হওয়ার বিষয়টি অনেকটাই প্রকাশ্য। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও যেন সম্পর্কটা আর আগের মত নেই। ইতোমধ্যেই ট্রাম্পের প্রশাসন ইউএসএইডের কার্যক্রম বন্ধ করায় অর্থনৈতিক সহায়তার ক্ষেত্রে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে এই দিকটাকে ইঙ্গিত করেই বলা হয়েছে যে, ইউনূস সরকারের চ্যালেঞ্জ কেবল ভারত নয়, ট্রাম্প প্রশাসনও তার জন্য সমস্যার।

এদিকে মার্কিন ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স-ডিএনআই-এর পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড তিন দিনের এক গুরুত্বপূর্ণ সফরে ১৬ মার্চ সকালে দিল্লিতে এসে পৌঁছেছেন। এই সফরে এসে তিনি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রকাশ্যেই ‘বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও সহিংসতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’ সেই কথা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্বজুড়ে ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদকে’ পরাজিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সোমবার, ১৭ মার্চ সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়েছে।

এনডিটিভি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তুলসি গ্যাবার্ড বলেন, ‘হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতন, হত্যা ও নিপীড়ন যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয়।’

ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন মন্ত্রিসভা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নতুন মন্ত্রিসভা এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তবে এটি আমাদের উদ্বেগের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে।’

এসময় তিনি বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থা ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উত্থানের কথা উল্লেখ করেন।

সাক্ষাৎকারে তুলসি গ্যাবার্ড ‘ইসলামি খিলাফত’-এর আদর্শের কথা উল্লেখ করে বলেন, বিশ্বজুড়ে চরমপন্থি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো এমন একটি ফলাফল অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছে। ইসলামি সন্ত্রাসীদের হুমকি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বৈশ্বিক প্রচেষ্টা একই আদর্শ ও লক্ষ্যে নিবদ্ধযা হলো ইসলামি খিলাফতের মাধ্যমে শাসন বা শাসন করা।

তিনি আরও বলেন, এটি স্পষ্টতই অন্য যে কোনও ধর্মের মানুষকে প্রভাবিত করে, বিশেষ করে যারা তাদের গ্রহণযোগ্য ধর্মের বাইরে। তারা এটিকে সন্ত্রাস ও সহিংসতার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে চায়।

গ্যাবার্ড জানান, ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন আদর্শ চিহ্নিত করে তা পরাজিত করতে এবং তিনি যাকে ‘মৌলবাদী ইসলামি সন্ত্রাসবাদ’ বলে অভিহিত করেন, তার উত্থান বন্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসলামি সন্ত্রাসবাদের পেছনে যে আদর্শ কাজ করে তা চিহ্নিত করতে এবং এই আদর্শ ও তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে পরাজিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

দিল্লিতে তিন দিনের এই সফরে তুলসি গ্যাবার্ড বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা-প্রধানদের এক শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেবেন। এছাড়া আলাদা করে একান্ত বৈঠক করবেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা-এনএসএ উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গেও।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর ভারত-মার্কিন সবোর্চ্চ স্তরে টেলিফোনে বা মুখোমুখি বৈঠকে যত আলোচনা হয়েছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ তাতে ছায়াপাত করেছে অনিবার্যভাবে। অজিত ডোভাল ও তুলসী গ্যাবার্ডের মধ্যে আলোচনাতেও তার কোনও ব্যতিক্রম হবে না নিশ্চিতভাবেই।

এর আগে নরেন্দ্র মোদী যখন টেলিফোনে বিগত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন, তখন ভারতের পক্ষ থেকে সে দেশে কথিত হিন্দু নির্যাতনের প্রসঙ্গ তোলা হয়েছে। এরপর যখন গত মাসে মোদি হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেন, বাংলাদেশ নিয়ে সেখানেও দুজনের মধ্যে কথা হয়েছে।

তা ছাড়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও তার মার্কিন কাউন্টারপার্ট মার্কো রুবিও কিংবা মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক উলজের সঙ্গে বৈঠকেও একাধিকবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন।

ঢাকা ও দিল্লির বর্তমান সরকারের মধ্যে এই কথিত হিন্দু নির্যাতনের ইস্যু একটি অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ হিসেবে দেখা দিয়েছে, তা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, ভারত সরকার ও ভারতীয় মিডিয়া ক্রমাগত এ বিষয়ে অতিরঞ্জিত ‘প্রোপাগান্ডা’ চালিয়ে যাচ্ছে, বাস্তবের সঙ্গে যার কোনও মিল নেই। যেসব হামলার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোর প্রায় সবই যে চরিত্রে ‘রাজনৈতিক’, সেটিও তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন।   

তুলসী গ্যাবার্ড নিজে একজন ‘প্র্যাকটিসিং হিন্দু’ যদিও তিনি আদৌ ভারতীয় বংশোদ্ভূত নন। তার মা ক্যারোল পোর্টার গ্যাবার্ড হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, নিজের সন্তানদেরও রেখেছিলেন হিন্দু নাম। তুলসী গ্যাবার্ডদের ভাইবোনদেরও নাম সে কারণে ভক্তি, জয়, আর্য ও বৃন্দাবন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন ডিএনআই পদে তুলসী গ্যাবার্ডকে মনোনীত করেন, তখন তার ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ’ গাইবার একটি পুরনো ভিডিও ভাইরালও হয়েছিল।

সারা বিশ্বে হিন্দুরা যেখানেই নির্যাতিত, সেখানে তাদের প্রতি সংহতি ও সমবেদনা প্রকাশে তুলসী গ্যাবার্ড কখনোই দ্বিধা করেননি। ভারতে এসে সম্পূর্ণ হিন্দু রীতি মেনে নিজের বিয়ে করেছিলেন তুলসী গ্যাবার্ড।

এছাড়া পাকিস্তানে ও আফগানিস্তানে হিন্দু ও শিখদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধেও সব সময় সরব ছিলেন তিনি। বস্তুত, মার্কিন কংগ্রেসে তিনিই ছিলেন প্রথম হিন্দু ধর্মাবলম্বী কংগ্রেস-উইম্যান। তবে রাজনৈতিক জীবনের বেশিটা ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে থাকলেও ২০২২ সালে তিনি রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেন।

বিশ্বের ‘নির্যাতিত হিন্দু’দের জন্য মার্কিন ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্সের যে একটা ‘সফট কর্নার’ বা দুর্বলতার জায়গা আছে, তা সুবিদিত – আর ভারতও সেটিকেই কাজে লাগাতে চাইছে।

মার্কিন এই গোয়েন্দা-প্রধান তার ভারত সফরের প্রথম দিনেই ১৬ মার্চ অংশ নিয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানদের একটি হাই-প্রোফাইল সম্মেলন বা সিকিউরিটি কনফারেন্সে, যেটির সভাপতিত্ব করছেন ভারতের এনএসএ অজিত দোভাল।

এই সম্মেলনে ‘কোয়াড’ জোটের চার শরিক- অস্ট্রেলিয়া, ভারত, আমেরিকা ও জাপানের গোয়েন্দা-প্রধান বা ইনটেলিজেন্স চিফরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী সাতটি দেশের জোট জি-সেভেনের অন্য প্রতিনিধিরাও। যেমন- কানাডার গোয়েন্দা প্রধান ড্যানিয়েল রজার্স, ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই সিক্সের প্রধান রিচার্ড মুর, নিউজিল্যান্ডের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা প্রমুখ।

পরবর্তী তিন দিন, ১৭-১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে স্ট্র্যাটেজিক আলোচনার প্ল্যাটফর্ম ‘রাইসিনা ডায়ালগ’ যুগ্মভাবে যেটির আয়োজন করছে ভারতের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন-ওআরএফ ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

তুলসী গ্যাবার্ড অংশ নিচ্ছেন এই রাইসিনা ডায়ালগেও। সেখানে তার ভাষণও প্রকাশ্য মঞ্চেই অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা যাচ্ছে।

Link copied!