প্রায় বছর ছয়েক আগের কথা। রাজস্থানে বিজেপির একটি কর্মী সমাবেশে দলের তখনকার সভাপতি অমিত শাহ (এখন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) খুব গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, “সত্যিই হোক বা ফেক, জেনে রাখবেন যে কোনও মেসেজকে আমরা নিমেষে ভাইরাল করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি।”
শুধু ফাঁকা বুলি নয় – সেটা কীভাবে বিজেপি করে দেখায়, কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের দৃষ্টান্ত দিয়ে সেটাও সবিস্তারে বর্ণনা করেছিলেন তিনি।
রাজস্থানের বহুল প্রচলিত ‘দৈনিক ভাস্কর’ পত্রিকা অমিত শাহকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছিল, ওই রাজ্যে বিজেপি তখন দুটো হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চালাত – একটায় সদস্য ছিল ১৭ লাখ, অন্যটায় ১৫ লাখ।
“এই ৩২ লক্ষ লোকের কাছে রোজ সকাল আটটায় গুড মর্নিং বার্তার সঙ্গে একটা করে মেসেজ চলে যেত, যেটা তারা আবার নিজেদের পরিচিত মহলে লক্ষ লক্ষ লোকের কাছে ফরোয়ার্ড করে দিতেন”, বলেছিলেন অমিত শাহ।
আর ঠিক এভাবেই নির্বাচনী মওশুমে রাজ্যে রোজকার ‘টকিং পয়েন্ট’ বা ‘ন্যারেটিভ’টা কী হবে, সেটা দিনের শুরুতেই স্থির করে দিত বিজেপি – কারণ তাদের পাঠানো বার্তাটা ততক্ষণে কোটি কোটি ভোটারের কাছে পৌঁছে গেছে এবং তারা সেগুলো নিয়ে তর্কবিতর্কও শুরু করে দিয়েছেন।
অমিত শাহ সেদিন আরও জানিয়েছিলেন, সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব (নিজের বাবা) মুলায়ম সিং যাদবকে থাপ্পড় মেরেছেন, এরকম একটা মেসেজও সেবার কীভাবে ভাইরাল করে তোলা হয়েছিল।
“আরে অখিলেশ আর মুলায়ম তো তখন ছ’শো মাইল দূরে ... কীভাবে চড় মারবেন? মারেননি। কিন্তু আমাদের টিমের কেউ এটা পোস্ট করে দিয়েছে, আর খেয়েও গেছে! সকাল দশটার মধ্যে পুরো রাজ্য জেনে গেছে অখিলেশ নিজের বাবাকেও শ্রদ্ধাভক্তি করেন না!”, বলেছিলেন তিনি।
বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পার্টির যে শাখাটির এই চমকপ্রদ ‘কৃতিত্বে’র কথা অমিত শাহ সে দিন ফলাও করে বলেছিলেন, সেটিই সারা দেশে ‘আইটি সেল’ নামে পরিচিত। এবং সুনাম আর দুর্নাম, তাদের দুটোর পাল্লাই বোধহয় সমান ভারি!
এই বিভাগের পোশাকি নাম অবশ্য ‘ইনফর্মেশন অ্যান্ড টেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট’, জাতীয় স্তরে যার প্রধান এখন অমিত শাহ-রই একজন নেমসেক – তিনি অমিত মালভিয়া।
পেশায় এককালে ছিলেন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার, সে সব ছেড়েছুড়ে এলাহাবাদের ছেলে অমিত মালভিয়া এখন পুরোদস্তুর একজন রাজনীতিক। যে কেন্দ্রীয় নেতাদের বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে দলের কাজকর্ম তদারকির দায়িত্ব দিয়েছে, তিনি তাদেরও অন্যতম।
অমিত মালভিয়া ও তার নেতৃত্বাধীন বিজেপি ‘আইটি সেল’ যে সোশ্যাল মিডিয়াতে রাজনৈতিক প্রচারণাকে একটা অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে তা নিয়ে ভারতে পর্যবেক্ষকরা সবাই একমত।
অনেকেই অবশ্য একে প্রচার না-বলে ‘প্রোপাগান্ডা’ বলে থাকেন, আইটি সেলের প্রচার প্রায়শই বিশুদ্ধ ‘হেইট স্পিচ’ বলেও ভূরি ভূরি অভিযোগ ওঠে – কিন্তু ভারতের রাজনীতির ল্যান্ডস্কেপে এটাই যে সবচেয়ে শক্তিশালী ডিজিটাল হাতিয়ার তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।
কীভাবে এক সময় দিল্লির অশোকা রোডের ছোট্ট কামরা থেকে পরিচালিত একটা অপারেশন দিনে দিনে এত প্রভাবশালী হয়ে উঠল, এই প্রতিবেদনে থাকছে তারই সরেজমিন অনুসন্ধান।
ট্রোলিং আর্মি?
দিল্লির সাংবাদিক স্বাতী চতুর্বেদী ২০১৬ সালে একটি বই লিখেছিলেন, যার নাম ‘আয়্যাম আ ট্রোল : ইনসাইড দ্য সিক্রেট ওয়ার্ল্ড অব বিজেপি’স ডিজিটাল আর্মি’ (আমি একজন ট্রোল : বিজেপির ডিজিটাল বাহিনীর গোপন দুনিয়ার অন্দরমহলে)।
ভারতের শাসক দল বিজেপি কীভাবে দেশময় ছড়িয়ে থাকা তাদের কোটি কোটি সমর্থক ও স্বেচ্ছাসেবীকে অনলাইনে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভাবধারা প্রচার করছে এবং তাদের আদর্শিক প্রতিপক্ষদের জীবন ছারখার করে দিচ্ছে – ওই বইতে তার খুঁটিনাটি বর্ণনা করেছিলেন স্বাতী চতুর্বেদী।
বইটির মুখবন্ধেই স্বাতী লিখেছিলেন, কীভাবে একটি টুইটার হ্যান্ডল থেকে বিশেষ একজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক আছে, ক্রমাগত এই ধরনের নোংরা প্রচার চলতে থাকার পর তিনি খানিকটা বাধ্য হয়েই বই লেখার জন্য এই বিষয়টি বেছে নেন।
“রাত্তিরে আজকাল আমার ‘রেট’ কত যাচ্ছে, কালকে আমার যৌন সম্পর্কগুলো কেমন ছিল, কিছুতেই তৃপ্ত না-হয়ে আমি কীভাবে আরও বেশি বেশি করে চাইছিলাম – তখন রোজ সকালে ঘুম ভেঙেই আমার ফোনে এই সব নোটিফিকেশনগুলো দেখতে পেতাম”, বইটিতে লিখেছেন তিনি।
তাঁর গবেষণা আরও বলছে, বিজেপি তাদের প্রচারণার জন্য এই ‘অনলাইন ট্রোল’-দেরই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকে, যারা মূলত হিন্দু দক্ষিণপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং তার পাশাপাশি উগ্র জাতীয়তাবাদী।
“এরা নিজেদের ডিপি-তে সাধারণত হিন্দু দেবদেবীর ছবি ব্যবহার করেন। কেউ কেউ আবার বেশি ফলোয়ার টানতে বিকিনি-পরা সুন্দরীদের ছবিও দেন।” আর তাদের মূল নিশানা হলেন লিবারাল রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী অ্যাক্টিভিস্ট ও সাংবাদিকরা – তিনি নারী হলে তো কথাই নেই!”, লিখেছেন স্বাতী চতুর্বেদী।
গত মাসে হোয়াইট হাউসে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে ভারতের মুসলিমদের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন করার পর ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক সাবরিনা সিদ্দিকি ছিলেন সেই তালিকায় সবশেষ সংযোজন।
সাবরিনা সিদ্দিকিকে অনলাইনে প্রথম আক্রমণ শানান বিজেপির ‘আইটি সেলে’র বর্তমান প্রধান অমিত মালভিয়া – তারপর তাতে যোগ দেয় শত শত হিন্দুত্ববাদী ও উগ্র দক্ষিণপন্থী হ্যান্ডল।
টুইটারে এদের অনেককে ‘ফলো’ করতেন বা এখনও করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে, আর তারাও নিজেদের টুইটার বায়ো-তে অবধারিতভাবে লেখেন ‘ব্লেসড টু বি ফলোড বাই পিএম মোদী’!
এই বিভাগে কারা কাজ করেন?
এই ‘অনলাইন ট্রোল’রা যে বিজেপির তথাকথিত আইটি সেলের প্রত্যক্ষ ‘কর্মী’ তা হয়তো নয় – কিন্তু তৃণমূল স্তরে ছড়িয়ে থাকা এই লক্ষ লক্ষ ভলান্টিয়ার বা স্বেচ্ছাসেবীদের সুবাদেই দলটি সোশ্যাল মিডিয়াতে এত বিপুল ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে।
দিল্লির দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গে বিজেপির নতুন হেডকোয়ার্টারে আইটি সেলের যে জাতীয় অফিস আছে, তাতে যে ঠিক কতজন কর্মী কাজ করেন সে সম্পর্কেও নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না।
অমিত মালভিয়া বা বিজেপির শীর্ষ নেতারাও কখনো এ বিষয়ে মুখ খোলেন না। বিজেপির অনেক এমপি পর্যন্ত বিবিসি বাংলার কাছে স্বীকার করেছেন, ঘন ঘন পার্টি অফিসে যাতায়াত থাকলেও আইটি সেলের কর্মকান্ড কীভাবে চলে সে সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণাই নেই!
দিল্লির সাংবাদিক মানসী কাউর বছর দুয়েক আগে এই আইটি সেলে সরাসরি কর্মরত বা সদ্য ‘চাকরি’ ছেড়েছেন – এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন।
এখন কানাডা-প্রবাসী মিস কাউর টেলিফোনে এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, “আমি যতটুকু জেনেছিলাম দিল্লির ওই ‘কোর টিমে’ পঁচিশ-তিরিশজন কাজ করেন। কিন্তু দিল্লির পাশাপাশি প্রতিটি রাজ্যে, প্রতিটি জেলায় ও পার্লামেন্টোরি কেন্দ্রে, প্রতিটি মিউনিসিপ্যালিটিতে পর্যন্ত তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত।”
“এদের কেউ কেউ আইআইটি বা আইআইএমের কৃতী ছাত্র, অনেকে আবার ফিনান্স বা কর্পোরেটে মোটা অঙ্কের চাকরি ছেড়ে অনেক কম মাইনেতে দলের কাজে যোগ দিয়েছেন। আবার বিনা মাইনের ভলান্টিয়ারও আছেন, যারা অনেকে অন্য কাজের পাশাপাশি এটা পার্ট-টাইম করেন।”
আইটি সেলে কাজের মাধ্যমেই একদিন সক্রিয় রাজনীতিতে ঢোকার রাস্তা প্রশস্ত হবে – কিংবা দল এমএলএ বা এমপি হওয়ার টিকিট দেবে – এটা তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই মোটিভেশনের কাজ করে।
মিস কাউরের অভিজ্ঞতা বলে, কিছুদিন পরেই ‘মোহভঙ্গ’ হয়ে আইটি সেলের সঙ্গে সব সংস্রব ত্যাগ করেছেন – এমনও অবশ্য বহু দৃষ্টান্ত আছে।
‘সঠিক টাইমিং, প্রবল নিষ্ঠা’
বিজেপির প্রবল সমালোচকরাও একটা কথা মানেন, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষমতা যে কত সাঙ্ঘাতিক – ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সেটা বিজেপিই প্রথম অনুধাবন করেছিল।
বিজেপি তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইট খুলেছিল সেই ১৯৯৫ সালে। কংগ্রেস এখানে তাদের চেয়ে পাক্কা দশ বছর পিছিয়ে, তাদের ওয়েবসাইট চালু করতে করতে সেই ২০০৫!
এমন কী, নরেন্দ্র মোদীও তাঁর ব্যক্তিগত হোমপেজ খুলে ফেলেন ২০০৫ সালেই, টুইটারে ঢোকেন ২০০৯তে। সেই জায়গায় কংগ্রেসের ‘তরুণ তুর্কী’ রাহুল গান্ধীর ২০১৫ সাল পর্যন্ত টুইটারে কোনও অস্তিত্ত্বই ছিল না।
দক্ষিণপন্থী চিন্তাবিদ শুভ্রকমল দত্ত বহু বছর ধরে বিজেপির ঘনিষ্ঠ, তিনি মনে করেন এই দলটি যে এত আগে থেকে ইন্টারনেটকে রাজনৈতিক প্রচারণার কাজে ব্যবহার করে আসতে পারছে, তার কৃতিত্ব প্রাপ্য দলের প্রয়াত নেতা ও বাজপেয়ী জমানার তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী প্রমোদ মহাজনের।
সূত্র: বিবিসি