যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের দোসর পশ্চিমা শক্তিগুলো সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তালেবানদের হাতে। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সে দেশের সাধারণ জনগণের ভাগ্য নিয়ে চলছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ছিনিমিনি। গ্যাঁড়াকলে পড়েছেন দেশটির হতদরিদ্র মানুষ। দুর্ভিক্ষ কড়া নাড়ছে তাদের দুয়ারে।
বর্তমানে দেশটিতে চরম অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকট শুরু হয়েছে। দেশের লাখো মানুষ এখন চরম খাদ্য সংকটে ভুগছে। চার দশকের যুদ্ধ ও দুঃখ-দুর্দশার পর দেশটি একটি গুরুতর বিপর্যয়ের মুখোমুখি। দেশটির উষর মরুর-পাহাড়-গিরিখাদে লুকিয়ে থাকার জায়গা থেকে দিগন্তে ইরান সীমান্তের দিকে আলোর আভাটুকুই শুধু দেখতে পাচ্ছেন আফগানরা।
অনেকে দেশ থেকে পলায়নের কথা ভাবছেন। অনেকেই খাবার কিনতে গিয়ে কয়েক সপ্তাহ আগে তাদের সঞ্চয়ের সবটুকু শেষ করে ফেলেছেন। আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার করে সীমান্তের কাছে চলে এসেছেন এই আশায় যে এবার হয়ত আফগানিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতি থেকে মুক্তি মিলবে। সীমান্তের দিকে তাকিয়ে তারা স্বপ্ন দেখছেন কাজ, টাকা আর খাবারের। কিন্তু কোথায় কাজ, কোথায় অর্থ, কোথায় খাদ্য?
কাজের সন্ধ্যানে হণ্যে হয়ে ঘুরছে মানুষ। পালিয়ে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে মানুষ। ২৬ বছর বয়সী নাজাফ আখলাকি এমনই একটি দলের একজন। তার ভাষায়, “আমার জন্য আর কোনো বিকল্প নেই; আমার আর ফিরে যাওয়ারও পথ নেই।”
আখলাকি যখন কথা বলছিলেন, পাচারচক্রের দালালরা তখন নজর রাখছে সীমান্তে। তালেবানের টহল দল সরে যেতেই দালালরা নির্দেশ দিল- ‘দৌঁড়াও’। আখলাকিও আর অপেক্ষা করলেন না।
আখলাকিদের এই গল্প তুলে ধরা হয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার এবং তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর ভেঙে পড়েছে দেশটির অর্থনীতি। আগে থেকেই চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা লাখ লাখ আফগানের এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে।
অর্থনীতির চাকা থমকে যাওয়ায় আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে, দেশজুড়ে খাবারের অভাবে অনেকের বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে উঠেছে। তালেবান কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে আটকে আছে জরুরি সহায়তা।
গত মাসে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, আফগানিস্তানের অর্ধেকের বেশি বাসিন্দা ‘চরম ক্ষুধার ভেতর দিয়ে’ দিন পার করছে। আফগানিস্তানের জীবন তাদের জন্য একটি ‘শীতল নরকে’ পরিনত হয়েছে।
আর এই পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তনের আশা না দেখে হাজার হাজার আফগান নাগরিক প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালাচ্ছেন।
অক্টোবর থেকে জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত সময়ে শুধু আফগানিস্তানের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের দুটি সীমান্ত দিয়েই ১০ লাখের বেশি আফগান ইরানে ঢুকেছে বলে অভিবাসন গবেষকদের ধারণা। দাতা সংস্থাগুলোর হিসাবে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার আফগান সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইরানে প্রবেশ করছে।
আফগান অভিবাসন নিয়ে কর্মরত একজন গবেষক ডেভিড ম্যানসফিল্ড বলেন, “এই পথ দিয়ে আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়াদের সংখ্যা অস্বভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, বিশেষ করে চরম ঠাণ্ডা আবহাওয়ার মধ্যেও।”
তার হিসাবে, এ বছর জানুয়ারিতে যত আফগান নাগরিক ইরান ও পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে, তাদের সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চারগুন। এই অভিবাসনের ঢল ওই অঞ্চলে এবং ইউরোপে সতর্কঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে, রাজনীতিবিদরা আবারও ২০১৫ সালের মত অভিবাসন সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করছেন। ওই সময় ১০ লাখের বেশি অভিবাসী, যাদের বেশিরভাগই সিরিয়ার নাগরিক, ইউরোপে আশ্রয়ের জন্য জড়ো হয়েছিল।
গত কিছুদিনে তাপমাত্রা বাড়ায় বরফাচ্ছাদিত পথগুলোতে চলাচল সহজতর হয়েছে, যার ফলে আফগানরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্তে পৌঁছে যেতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ওই অঞ্চলেই আটকে রাখতে বদ্ধপরিকর ইইউ আফগানিস্তান এবং এর প্রতিবেশী দেশগুলোকে ১০০ কোটি ডলারের মানবিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
কিন্তু পশ্চিমা দাতারা এখনও পথ খুঁজে বেড়াচ্ছেন, কীভাবে নতুন তালেবান সরকারকে এড়িয়ে সাধারণ আফগানদের কাছে ওই সহায়তা পৌঁছানো যায়। তালেবান কর্মকর্তারা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পশ্চিমা কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে তাদের ‘গলাটিপে ধরা’ অর্থনীতিকে কিছুটা শ্বাস নিতে দেওয়া হয়। এজন্য তারা মেয়েদের শিক্ষা ও অন্যান্য শর্ত পূরণের বিষয়ে কিছু প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন আন্তর্জাতিক দাতাদের।
যুক্তরাষ্ট্রও নতুন করে ৩০ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সহায়তা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতি যেখানে ভঙ্গুর, সেখানে সহায়তা খুব বেশি কাজে আসবে না। পশ্চিমা দেশগুলো শেকল আলগা না করলে, এবং সেখানকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে চালু করতে না দিলে, কাজের খোঁজে থাকা নিরুপায় আফগানরা অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। এতে তারা জীবন বিপন্ন হলেও পরোয়া করবে না।
সূত্র: বিবিসি ও নিউইয়র্ক টাইমস