অবশেষে পতন ঘটতে যাচ্ছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে চলা নেতানিয়াহুর শাসনের অবসান ঘটিয়ে এবার ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে নাফতালি বেনেট। সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে ইসরাইলে এখনো চলছে বিক্ষোভ মিছিল। বিক্ষোভকারীদের অধিকাংশরা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অপসরণের দাবি করলেও তার পক্ষেও আন্দোলন করছেন কিছু সমর্থক। এবার ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে ৮ দলের কোয়ালিশন যেখানে প্রথমবারের মত সরকারি ক্ষমতায় যাবে আরবদের (মুসলিম) একটি দল।
দীর্ঘদিন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর শেষ কয়েকটি বছর মোটেও ভালো যায়নি। বিশেষত গত দুই বছর চারবার নির্বাচন ডাকতে হয়েছে তাকে। সেই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে উঠেছে দুর্নীতির অভিযোগ। এমনকি সম্প্রতি হঠাৎ করে ফিলিস্তিনে হামলা নিয়েও তাকে দুষছে বিশ্ব।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য যোগ্য হিসেবে নাফতালি বেনেটের নাম উচ্চারিত হলেও এই পদ দীর্ঘদিন ধরে রাখা বেশ কঠিন হবে তার জন্য। কেননা ইসরাইলের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলের সদস্য তিনি। তাকে ডান, বাম ও মধ্যপন্থী সকল রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। এখানে ৮টি রাজনৈতিক দল রয়েছে যার মধ্যে আরব গোষ্ঠীদের একটি দলও রয়েছে যারা প্রথমবারের মতো নাফতালির মাধ্যমে সরকার গঠন করে ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। তারা ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংঘর্ষ বন্ধ এবং কোন নতুন ঝামেলা সৃষ্টি না করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়।
অন্যদিকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত নেতানিয়াহু দেশটির বৃহত্তম রাজনৈতিক দল লিকুদের প্রধান হিসেবেই থাকছে এবং তিনি নতুন সরকারে বিরোধী দলীয় নেতা হবেন। এই আট দলের মধ্যে কোন একটি দলও যদি বিচ্যুত হয়, তাহলে এই সরকারের পতন ঘটবে। সেই সঙ্গে আরো একবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী হবার সুযোগ পাবেন নেতানিয়াহু।
দুই বছরে চারটি নির্বাচন, গাজায় ১১ দিনের যুদ্ধ, করোনা মহামারী এবং মহামারীর কারণে বিপর্যস্ত অর্থনীতির প্রভাব মোকাবেলা করা ইসরাইলের মানুষের জন্য নতুন সরকার স্বাভাবিক পরিস্থিতি বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্ষমতায় আসছে। আর এই কোয়ালিশন সরকার তৈরির পেছনে সবচাইতে বড় ভূমিকা রেখেছেন ইয়ার ল্যাপিড। এই কোয়ালিশন সরকার আগামী দুই বছর ক্ষমতায় থাকলে তিনি এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে জানা গেছে।
নেসেট নামে পরিচিত ইসরাইলের পার্লামেন্টের এই ভোটাভুটি শুরু হবে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায়। ১২০ সদস্যের পার্লামেন্টে মাত্র ৬১ ভোটে এই কোয়ালিশন পাশ করতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরপর সেখানে তারা শপথ গ্রহণ করবেন। একই দিনে ইসরাইলের স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় এই সরকার মিটিংয়ে বসবে।
অবশ্য এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে নেতানিয়াহু থাকবেন কিনা, বা কবে তিনি তার বাস ভবন ত্যাগ করবেন, এ বিষয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি। অবশ্য ভোটের আগেই নাফতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, তারা ডানপন্থীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে তাদের সমর্থন আদায়ের পর ঠকবাজী করে বামপন্থীদেরও দলে ভিড়িয়েছে।
এদিকে নেতানিয়াহুর পতনে তার সমর্থকরা বিরোধী দলীয় নেতাদের বাস ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছ। সেই সঙ্গে তাদের পরিবারের নাম নিয়ে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে বলেও দাবি করছেন এই আইন প্রণেতারা। ইসরাইলের 'শিন বেট' (অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী) এই মাসের শুরুতে জানিয়েছে, সরকার পরিবর্তন নিয়ে সহিংসতা ছড়িয়ে যেতে পারে।
এদিকে সমর্থকদের এমন হুমকি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিষয়টি কিছুই নয় বলে জানিয়েছেন নেতানিয়াহু। উল্টো তিনি নিজে হামলার শিকার হতে পারেন বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। প্রায় চারবার ক্ষমতায় এসে প্রায় ১৫ বছর ইসরাইলের ক্ষমতায় ছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে ইসরাইলের ২৭তম কেবিনেটে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন নেতানিয়াহু। পরবর্তীতে আবারো ২০০৯ সালে ৩২ তম কেবিনেটে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তিনি। এরপর টানা ১২ বছর দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শাসন করেছেন নেতানিয়াহু। ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড বেন-গুরিয়নের থেকেও দীর্ঘ সময় দেশটিকে শাসন করেছেন তিনি।
কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে লিকুদ পার্টিতেও শীর্ষ নেতার পদ হারাতে পারেন নেতানিয়াহু। কেননা ২০১৯ সালে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনের পর বিষয়টি তদন্তে কোন সহায়তা করেননি তিনি। উল্টো এ বিষয়ে বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিরোধী দলের ওপর চড়াও হয় ইসরাইলের এই প্রধানমন্ত্রী। পরবর্তীতে তাকে পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করে ইসরাইলের সাধারণ জনগণ। ধারনা করা হচ্ছে ডানপন্থী রাজনীতিবিদদের মধ্যে জনপ্রিয়তা থাকরেও ইসরাইলের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিলে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছেন এই নেতা। এই রাজনীতিবিদের সমালোচনায় বলা হচ্ছে, দেশটিতে বিভক্তি সৃষ্টির মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকেছেন তিনি। আর সে কারণেই মুক্তমনা ইহুদিরা এবং আরবরা কোনভাবেই তাকে সমর্থন করছে না। আর সে কারণেই লিকুদ পার্টিতে নেতানিয়াহুর থেকে উদারপন্থী কোন নেতা এলে খুব সহজে সকল দলকে একত্রিত করে সরকার গঠন করা সম্ভব হবে যা বর্তমান কোয়ালিশন থেকে আরো শক্তিশালী হবে। এমন কোন নেতা এগিয়ে এলে লিকুদ পার্টির শীর্ষ পদ থেকেও ইস্তফা দিতে হবে নেতানিয়াহুকে।
সূত্র: এসোসিয়েট প্রেস