সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২, ০৪:৫০ এএম
দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে যখন ব্রিটেনের প্রভাব ক্রমশ কমেছে, সমাজে আমূল পরিবর্তন এসেছে, রাজতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তখনও অনেকের কাছে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জনপ্রিয়তা কমেনি। ব্রিটেনের রাজসিংহাসনে নিজ কর্তৃত্বে তিনি অটল থেকেছেন। অথচ তাঁর জন্মের সময়ও কেউ ভাবেন নি তাঁর ভাগ্যে রয়েছে ব্রিটেনের সিংহাসনে আরোহণ।
এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি উইন্ডসর জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৬ সালের ২১শে এপ্রিল। তাঁর বাবা অ্যালবার্ট, ডিউক অফ ইয়র্ক এবং মা সাবেক লেডি এলিজাবেথ বোওজ -লিওন-এর তিনি ছিলেন প্রথম সন্তান।
অ্যালবার্ট ছিলেন পঞ্চম জর্জের দ্বিতীয় সন্তান।
রানি এবং তাঁর বোন মার্গারেট দুজনেই লেখাপড়া শিখেছেন বাড়িতে। রানির যখন ছয় বছর বয়স তখন তাঁর ঘোড়ায় চড়া বিষয়ক প্রশিক্ষককে তিনি বলেছিলেন তিনি "গ্রামের গৃহিণী হতে চান যার অনেকগুলো ঘোড়া ও কুকুর থাকবে।"
বলা হয় খুবই ছোটবেলা থেকেই তিনি অসাধারণ দায়িত্ববোধের পরিচয় দেন । ব্রিটেনের ভাবী প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন "তাঁর চরিত্রে যে কর্তৃত্ববোধ ছিল, তা একজন শিশুর পক্ষে ছিল খুবই আশ্চর্যজনক।"
প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলে শিক্ষা না পেলেও ভাষার প্রতি এলিজাবেথের ভাল দখল ছিল, তিনি সাংবিধানিক ইতিহাস পড়েছিলেন বিস্তারিতভাবে।
সিংহাসনে উত্তরাধিকারের পথ
তাঁর সর্বজ্যেষ্ঠ পুত্র ডেভিড, ১৯৩৬ সালে রাজা পঞ্চম জর্জের মৃত্যুর পর তৃতীয় এডওয়ার্ড উপাধি পান। তবে দুবার বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া আমেরিকান এক ধনী রমণী ওয়ালিস সিম্পসনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় সে বছরই তাঁকে সিংহাসন ত্যাগ করতে হয় ।
এলিজাবেথের বাবা ডিউক অফ ইয়র্ক অনিচ্ছার সঙ্গে সিংহাসনে বসেন রাজা ষষ্ঠ জর্জ হিসাবে এবং তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠান কিশোরী এলিজাবেথকে দারুণভাবে মুগ্ধ করে।
রাজা ষষ্ঠ জর্জ, তাঁর স্ত্রী ও দুই কিশোরী কন্যাকে নিয়ে যখন রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে ইউরোপে ঘুরছেন, তখন ১৯৩৯ সালে, ইংল্যান্ডেই এলিজাবেথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে গ্রিসের যুবরাজ প্রিন্স ফিলিপের, যিনি ছিলেন সম্পর্কে তাঁর কাজিন।
প্রণয় পর্ব
সেটাই যে তাদের প্রথম সাক্ষাৎ ছিল তা নয়, তবে সেই প্রথম এলিজাবেথ, ফিলিপ সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
এলিজাবেথের বয়স যখন ১৮, তখন ১৯৪৪ সালে ফিলিপের প্রতি তাঁর প্রণয় গভীর হয়ে ওঠে। তিনি ঘরে ফিলিপের ছবি রাখতেন, দুজন দুজনকে চিঠি লিখতেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে তরুণী প্রিন্সেস এলিজাবেথ আধাসামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে লরি চালানো ও লরির সার্ভিস করার শিক্ষা নেন।
যুদ্ধ শেষে প্রিন্স ফিলিপকে তিনি বিয়ে করতে চাইলে তাঁকে বেশ বাধার মুখে পড়তে হয়। এলিজাবেথ ছিলেন রাজার অনেক আদরের কন্যা। ফিলিপের বিদেশি বংশ পরিচয়ের কারণে রাজা তাঁর হাতে মেয়েকে তুলে দিতে রাজি হন নি।
পিতার মৃত্যু
কিন্তু তাঁদের ইচ্ছারই জয় হয় শেষ পর্যন্ত। ১৯৪৭ সালের ২০শে নভেম্বর এলিজাবেথ ও ফিলিপ ওয়েস্টমিনস্টার গির্জায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফিলিপের উপাধি হয় ডিউক অফ এডিনবারা। তিনি নৌবৈাহিনীর কর্মকর্তা পদেই বহাল থাকেন।
বিয়ের পর প্রথম কয়েক বছর তাঁরা স্বাভাবিক বিবাহিত জীবন কাটান। এ সময়ই তাঁদের প্রথম পুত্র চার্লস ও কন্যা অ্যান জন্ম নেন।
উনিশশ' ৫২ সালে যখন এলিজাবেথের বয়স ২৫, তখন রাজা ষষ্ঠ জর্জ ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শয্যা নেন। এলিজাবেথ তাঁর স্বামীকে নিয়ে বিদেশ সফরে যান বাবার হয়ে দায়িত্ব পালন করতে। চিকিৎসকের পরামর্শ উপেক্ষা করে রাজা তাঁকে বিমানবন্দরে বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন। সেটাই ছিল পিতা ও কন্যার শেষ সাক্ষাত।
এলিজাবেথ কেনিয়ায় বসে পিতার মৃত্যু সংবাদ পান। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসেন তিনি ব্রিটেনের রানি হিসাবে। সেই মুহূর্তের কথা স্মরণ করে তিনি বলেছিলেন, "এক অর্থে আমার কোনো শিক্ষানবিশী হয় নি। আমার বাবা মারা যান খুব অল্প বয়সে। কাজেই অনেকটা হঠাৎ করেই দায়িত্ব নিতে এবং সাধ্যমত দায়িত্ব পালনে উদ্যোগী হতে হয়েছিল আমাকে।"
সিংহাসনে অভিষেক
উনিশশ' ৫৩ সালের জুন মাসে তাঁর আনুষ্ঠানিক অভিষেকে দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসন আরোহণ ও শপথ গ্রহণ লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখেন টেলিভিশনের পর্দায়।
যুদ্ধের পর ব্রিটেন তখন কঠিন অর্থনৈতিক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ভাষ্যকাররা তাঁর অভিষেককে ব্যাখ্যা করেছিলেন 'নতুন এলিজাবেথান যুগ' হিসাবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ উপনিবেশ তখন গুটিয়ে এসেছে। নতুন রানির দায়িত্ব নিয়ে তিনি যখন ১৯৫৩ সালে কমনওয়েলথ দেশগুলোতে দীর্ঘ সফরে বেরলেন, তখন ভারতীয় উপমহাদেশ সহ অনেক দেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে।
রাজতন্ত্র থেকে রাজপরিবার
ক্রমশ রাজতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের অবিচ্ছিন্ন আনুগত্যে বদল আসতে শুরু করে। সমাজের মধ্যে নানা ধ্যানধারনাও দ্রুত বদলাতে থাকে।
রানিও যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলান। ক্রমশ 'রাজতন্ত্র'-এর জায়গা নেয় 'রাজ-পরিবার'।
রানির রাজত্বকালের মূল স্তম্ভ হয়ে ওঠে সাংবিধানিক সততা রক্ষা ।
তবে সরকারের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড থেকে দূরে চলে যান রানি। রানির দায়িত্ব সীমিত থাকে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন, দেশের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত থাকা, সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার মধ্যে।
উনিশশ' ৬০-এর দশকের শেষ দিকে, বাকিংহাম প্রাসাদ সিদ্ধান্ত নেয় যে রাজপরিবারকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। রানি এবং তাঁর পরিবারও যে আর পাঁচটা সাধারণ পরিবারের মত ঘরকন্নার নানা কাজ করেন তা দেখাতে বিবিসিকে 'রয়াল ফ্যামিলি' নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়।
রানির দৈনন্দিন ঘরসংসারের নানা ছবি ক্যামেরায় ধারণ করা হয়। অনেকে বলেন ওই তথ্যচিত্র রাজপরিবারের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা ও ভালবাসা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে, তবে সমালোচকরা কেউ কেউ বলেন রাজপরিবারকে নিয়ে মানুষের মনে যে দীর্ঘদিন একটা রহস্য ও রোমাঞ্চ ছিল এই ছবি তা ধ্বংস করে দেয়।
কেলেংকারি ও বিপর্যয়
রানি এলিজাবেথ তাঁর দায়িত্ব পালনে নানা দেশে ভ্রমণ অব্যাহত রাখেন। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর তিনি আমেরিকা সফরে যান। তিনিই ছিলেন প্রথম ব্রিটিশ রানি যিনি অ্যামেরিকান কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেন।
এর এক বছরের মধ্যে তাঁর পরিবারে নানা ধরনের কেলেংকারি ও দুর্যোগের ঘটনা শুরু হয়। রানির দ্বিতীয় ছেলে ডিউক অফ ইয়র্ক ও স্ত্রী সারা আলাদা হয়ে যান। মেয়ে প্রিন্সেস অ্যান ও স্বামী মার্ক ফিলিপস্-এর বিয়ে ভেঙে যায়। প্রিন্স ও প্রিন্সেস অফ ওয়েলস্, অর্থাৎ চালর্স ও ডায়ানা বিয়েতে যে গভীর অসুখী এ খবর জানাজানি হয় । তারাও আলাদা হয়ে যান।
রানির প্রিয় বাসভবন উইন্ডসর কাসেলে ওই বছরই বিরাট অগ্নিকাণ্ড হয়। ওই ভবন মেরামতের খরচ সাধারণ মানুষ জোগাবে নাকি তা রানির তহবিল থেকে ব্যয় করা উচিত তা নিয়ে চলে তুমুল বিতর্ক।
রানি ১৯৯২ সালকে ব্যাখ্যা করেন "অ্যানাস হরিবিলিস্" অর্থাৎ "দুর্যোগের বছর" হিসাবে।
ডায়ানার মৃত্যু
একদিকে ইউরোপের সঙ্গে নতুন জোট গঠনের মধ্যে দিয়ে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে ব্রিটেনের যোগাযোগ কিছুটা শিথিল হয়ে আসা, অন্যদিকে ব্রিটেনে রাজতন্ত্রের ভবিষ্যত নিয়ে জনমনে অব্যাহত বিতর্ক- এর মধ্যেও যখন রানি রাজপরিবারের উজ্জ্বল স্তম্ভ হিসাবে তাঁর দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট, তখন প্রিন্সেস ডায়ানার আকস্মিক মৃত্যু ব্রিটেনের রাজপরিবারের জন্য বড়ধরনের ধাক্কা হয়ে আসে।
উনিশশ' ৯৭ সালের অগাস্টে প্যারিসে গাড়ি দুর্ঘটনায় ডায়ানা মারা যাবার পর রানির বিরুদ্ধে ওঠে সমালোচনার ঝড়। যখন প্রাসাদের বাইরে বিশাল মানুষের ঢল- ফুলের শ্রদ্ধার্ঘ্যে ভরে উঠেছে প্রাসাদের ফটকের বাইরের রাস্তাঘাট, তখন সেই শোকের মুহূর্তের সঙ্গে রানির আপাতদৃষ্টিতে একাত্ম হতে না পারায় মানুষ সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে।
মানুষের উত্তাল সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত রানিকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে হয়- যে ভাষণে তিনি পুত্রবধূ ডায়ানার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন এবং সময়ের সাথে রাজ-পরিবারকে বদলানোর অঙ্গীকার দেন।
উৎসবের বছরগুলো
রাজপরিবারের প্রতি ব্রিটেনের মানুষের আগ্রহ, উদ্দীপনা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ২০০২ সালে মহাসমারোহে উদযাপিত হয় রানির সিংহাসন আরোহণের সুবর্ণ জয়ন্তী, এরপর রানির ৮০ বছরের জন্মদিনে উইন্ডসরের রাস্তায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সাক্ষাত-সফর, রানি ও প্রিন্স ফিলিপের বিয়ের ৬০তম বার্ষিকী উৎসব, এবং ২০১১ সালে রানির নাতি উইলিয়াম ও ক্যাথরিনের বিয়ে ও ২০১২য় রানির সিংহাসন আরোহণের হীরক জয়ন্তী।
সবশেষ ২০২২-এর জুন মাসে মহা সমারোহে উদযাপিত হয়েছে রানির সিংহাসন আরোহণের ৭০তম বার্ষিকী বা প্লাটিনাম জয়ন্তী।
এসব উদযাপন উপলক্ষে জনতার উচ্ছ্বাস ও অংশগ্রহণ রাজপরিবারকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিল যে ব্রিটেনের বহু মানুষ এখনও রাজপরিবার নিয়ে আগ্রহী। রাজপরিবারের প্রতি জনগোষ্ঠির অন্তত এক অংশের আনুগত্য লোপ পায় নি।
দু হাজার ১৫ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ব্রিটিশ রাজসিংহাসনে আসীন থাকার গৌরব অর্জন করেন। তাঁর বাবার প্র-পিতামহী রানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকালের মেয়াদ ছিল এর চেয়ে কম।
রানির দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গী প্রিন্স ফিলিপ প্রয়াত হন ২০২১-এর এপ্রিল মাসে।রানির রাজত্বকালের শুরুর সময় ব্রিটিশ রাজতন্ত্র যে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, যে রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের তখন প্রবল আনুগত্য ছিল, তাঁর রাজত্বকালের শেষ সময়ে সেই উচ্ছ্বাস ও আনুগত্যে কিছুটা ভাঁটা পড়েছিল বটে, কিন্তু ব্রিটিশ জনগণের হৃদয়ে রাজপরিবারের প্রতি ভালবাসা যাতে চিরস্থায়ী হয়, তা নিশ্চিত করতে সারা জীবন সচেষ্ট ছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।