আইভী: দলের উর্দ্ধে উঠা জনতার কাতারের এক রাজনীতিক

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জানুয়ারি ২৩, ২০২২, ০১:২৪ এএম

আইভী: দলের উর্দ্ধে উঠা জনতার কাতারের এক রাজনীতিক

গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতিতে একটি নীতিকথা প্রচলিত আছে যা নেতানেত্রীরা প্রায়শঃ মুখে আউড়ে থাকেন, সেটি হল: ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। অর্থাৎ ব্যক্তি গৌণ, দল বৃহৎ। তাই ব্যক্তিকে দলের মুখাপেক্ষী বা অনুগ্রহের ছায়ায় থাকতে হবে। কিন্তু নিজ আদর্শিক শক্তিতে কখনো কখনো ব্যক্তিও বৃহৎ হয়ে উঠতে পারেন। নিজেই প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারেন। তাকে আর তখন দলের পরিচয়ে পরিচিত হতে হয় না। ইতিহাসে এরকম উদাহরণ আমরা দেশে-বিদেশে বহু রাজনৈতিক নেতার ক্ষেত্রে দেখেছি।

গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতিতে দল গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, এই সত্য অস্বীকার করবার জো নেই। কিন্তু এরমধ্যেও দলের নেতাও কখনো কখনো দলকে ছাপয়ে উঠেন। নারায়ণগঞ্জের সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর ক্ষেত্রে যেমনটা দেখা যায়। লড়াকু এই নারী রাজনীতিক তৃতীয়বারের মতো আলোচিত শহরটির মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, বরাবরের মতো বিপুল ভোটের ব্যবধানেই। ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন টিকিট ছিল তার। যদিও দলীয় মনোনয়ন তার জয়ের পাল্লা ভারী করার ক্ষেত্রে অনুঘটক হয়নি বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা। কারণ তিনি স্বতন্ত্র হিসেবেও এই নগরে বিজয় কেতন উড়িয়েছিলেন, সেটা সেই ২০১১ সালেই। তা-ও আবার নিজ দলের হেভিওয়েট প্রার্থীকে ধসিয়ে দিয়ে।

নারায়ণগঞ্জ সিটিতে এ নিয়ে টানা তৃতীয়বার মেয়র হলেন পেশায় চিকিৎসক, নেশায় রাজনীতিক সেলিনা হায়াৎ আইভী। দেশের রাজনৈতিক চর্চায় সাধারনত দেখা যায়, ভোটের ফল ঘোষণার পরই পরাজিত প্রার্থী নানা অভিযোগ তুলে ধরে সেটি প্রত্যাখ্যান করে। এখানে সেটি দেখা গেল না। বরং আইভী বিজয় লাভের পরদিনই ছুটে গেলেন পরাজিত প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের বাসায়। হলো মিষ্টিমুখও। আপ্লুত তৈমূর বিজয়ী আইভীর মাথায় স্নেহের হাতও ছুঁইয়ে দিলেন পরম মমতায়। আইভীর হায়াৎ বৃদ্ধির দোয়া করে তৈমুর বললেন, আমি সব সময় আইভীর সাথে আছি।

সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে নানাজন নানা হিসাব-নিকাশ কষছেন। নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকেই। আমার মতে, এই নির্বাচন থেকে সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর এভাবে পরস্পরের পাঁশে থাকবার অঙ্গীকার। এই চর্চাটা দেশে শেষ কবে আমরা দেখেছি, ঠিক মনে পড়ে না। 

ভোট শুরুর আগে প্রায় তিন সপ্তাহের প্রচার-প্রচারণাকালে কোনো দাঙ্গা-ফ্যাঁসাদের খবরও চোখে পড়েনি। তবে নানা খবর-অখবরের উত্তেজনা ছিল ভোটের মাঠে। যার কারণে প্রশাসন মিডিয়ার খবরের ওপর ভিত্তি করে ১৮৭টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩০টিকে ঝুঁকিপূর্ণও ঘোষণা করে। কিন্তু এসব জল্পনা যে শুধু মিডিয়ার হিট বাড়ানোর কৌশল ছিল, তা ভোটের দিনই প্রমাণ হয়ে যায়। ৩০টি ত দূরে থাক, একটি কেন্দ্রেও ঝুঁকির ঝ-ও খুঁজে পাওয়া গেল না! প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকরা ভোট দিয়ে হাসিমুখে লাইভরত সাংবাদিকদের বললেন, এরকম শান্তিপূর্ণ নির্বাচন তারা বহুকাল দেখেননি! 

সেলিনা হায়াৎ আইভী একজন মেয়র। নারী মেয়র। সংসদ সদস্যের চেয়ে নগর মেয়র বড় কোনো পদ নয়। কিন্তু আইভীর মতো একজন প্রার্থী আছেন বলেই এই পদটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে বারবার। একজন ব্যক্তি আইভী, একজন লড়াকু নারী আইভী আমাদের মনোযোগ কেড়ে চলেছেন একদশক ধরেই। বিশেষ করে তিনি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে রাজনীতি করেন, সেই নারায়ণগঞ্জকে দেশের মানুষ চেনে একটু ভিন্নভাবে। এই সিটির মেজাজ একেবারেই আলাদা।  

যারা এই শহরের বাইরে থাকেন, তাদের মনে হতে পারে এটি দেশের বাইরের একটি অংশ! সন্ত্রাসের জনপদের তকমা আঁটা এ নগরের মানুষজন বরাবরই শান্তির জন্য লড়াই করে চলেছেন। ২০১১ সালে গঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে সে বছরই প্রথম সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হেভিওয়েট প্রার্থীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সেলিনা হায়াৎ আইভী লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে ধরাশায়ী করেন। সেই বিজয় লাভের পর থেকেই তিনি নানা চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছেন সামনে।

নানা সময়ে নিজ দলের প্রতিপক্ষরা তাকে কোনঠাঁসা করতে দুর্নীতি দমন কমিশনে নালিশ করেছে, বায়বীয় অভিযোগে তার কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে, তার ছবির সঙ্গে অশ্লীল বাক্যের ব্যানার দিয়ে শহর ছেয়ে ফেলেছে। কিন্তু আইভী থেমে থাকেননি। জনগণও মুখ বুজে এই অনাচার সহ্য করেছে, আইভীর পাশে থেকেছে। পরে ভোটের বাক্সে সেই ক্ষোভের জবাব দিয়েছে তারা। নগরের বাসিন্দারা জানেন, এরা নারায়ণগঞ্জে হত্যা, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ভূমি দখল, পরিবহন সিন্ডিকেট সবকিছুতেই জড়িত। আইভী তাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলেন। এরকম একরোখা একজন নারীকে তাই তারা নিজেদের নেতা হিসেবে বেছে নেন। তার প্রতিদানও দিয়ে চলেছেন আইভী।

আইভী নগরের পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোতে দৃশ্যমান উন্নয়ন করেছেন। সরকারের সহায়তা ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন ও দাতা সংস্থা সিটি করপোরেশনে অর্থায়ন করেছে। দেশের অন্য কোনো সিটি করপোরেশনে তারা এভাবে করেনি। আইভী সততা ও নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন বলেই বারবার তার এই বিজয়।

আইভীর ভাষায়, ‘নারায়ণগঞ্জ যে বাণিজ্যিক পরিচয়ে পরিচিত ছিল সেই ধারাটা ফিরিয়ে আনতে আমি কাজ করছি। অর্থনীতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, খেলাধুলায় নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস ছিল। নারায়ণগঞ্জবাসী শুধু কাজের জন্য আমাকে মনে রাখবে না। কাজ বললে, ১০ তলা নগরভবন, যেটা দেখলে নারায়ণগঞ্জবাসী বলবে, এই ভবনটি আইভী করে দিয়েছিল। শেখ রাসেল পার্ক—শহরে তো হাঁটার জায়গা ছিল না। একটা বস্তি ছিল, সব সময় মাদকের ব্যবসা হতো। সেই মাদকের ব্যবসা গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে একটা বড় লেক হয়েছে। আধুনিক ড্রেনেজ সিস্টেমের জন্যও আইভীকে মনে রাখতে হবে। আমি বলব, এই শহরের মানুষ অনেক সাহসী। জিম্মি অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে এ শহরের মানুষ সাহস করে কথা বলে এখন। সাহসী হওয়ার জন্য তাদের জাগাতে হয় মাঝে মাঝে, সেই জাগরণটা কি আইভী দেয়নি? দিয়েছে। সে জন্যই আইভীকে মানুষ মনে রাখবে বলে মনে করি।’

রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও জনকল্যাণমূলক কাজের মধ্য দিয়ে আইভী নিজেকে দলের ঊর্দ্ধে নিয়ে যেতে পেরেছেন। জনতার কাতারের নেতা হয়ে উঠতে পেরেছেন। একজন রাজনীতিকের জন্য খুব সম্ভবত এটিই সর্বোত্তম পাওয়া। দলও এরকম একজন রাজনীতিক পেয়ে খুশি হয়। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আগে এরকম বহু নেতা দেখা যেত। এখন সেই সংখ্যাটা নেই বললেই চলে। প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা ও গাজীপুরের প্রয়াত সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার, ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ আরও অনেকের নাম আমরা জানি। লিখতে শুরু করলে প্রয়াত এমন আরও অনেকের নাম চলে আসবে যারা স্মরণীয়-বরণীয়।

তারা এলাকার মাটি ও মানুষের প্রিয় নেতা ছিলেন। তাদের কর্ম, তাদের জীবনাদর্শ ছিল। তারা ছিলেন সৎ, নির্লোভ-নিরহংকার একেকজন নীতিবান মানুষ। তারা সারাজীবনই সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ এমপি-মন্ত্রীর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে মেয়রের পদ আঁকড়ে ধরে থাকতেন যাতে সর্বক্ষণ নিজের এলাকার মানুষদের পাশে থাকা যায়। এদেরকে জনগণ ভালবেসে ‘নগর পিতা’ আখ্যা দিতেন। একজন আইভীর মধ্যে এমন আদর্শ দৃশ্যমান।

রাজনীতিকরা সাধারনত প্রতিপক্ষ দলের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। কিন্তু একজন আইভীকে লড়াই করতে হয় নিজ দলের স্থানীয় নেতাদেরকেও। এ কারণে অন্য রাজনীতিকদের তুলনায় ডাবল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় তাকে। তবে সেই চ্যালেঞ্জে বারবার তিনি জয়ী হন। নিজ দলের নেপথ্য মারপ্যাঁচে তাকে একবারও কাবু করতে পারেনি। কারণ আইভী অদম্য, আইভী দুর্দমনীয়, আইভী দুঃসাহসী।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল এমন একটি দেশের একটি নগরের একজন নারী রাজনীতিকের এমন দৃঢ়পায়ে পথচলা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে।

 

লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট।  ইমেল: lutforrrahmanhimel@gmail.com

 

 

 

 

 

Link copied!