আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি: দ্য ইকোনমিস্ট

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুন ২৮, ২০২৫, ০৬:৩৯ পিএম

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি: দ্য ইকোনমিস্ট

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ যখন একটি সংবেদনশীল রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে, তখন দ্য ইকোনমিস্ট সম্প্রতি একটি বিশ্লেষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে অভিহিত করেছে।

পত্রিকাটি বলছে, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের নবজাগরিত গণতান্ত্রিক যাত্রাকে গুরুতর হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে, যেটিকে দ্য ইকোনমিস্টবাংলাদেশের দ্বিতীয় মুক্তিবলে আখ্যা দিয়েছে। 

ওই বিপ্লবের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ২০২৬ সালের শুরুর দিকে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেয়।

তবে ম্যাগাজিনটি সতর্ক করে বলেছে, বাংলাদেশের এই অগ্রগতি এখনো ভঙ্গুর। দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং জনগণের গভীর হতাশার একবিষময় ভারনতুন প্রশাসনের কাঁধে এসে পড়েছে। তরুণদের বেকারত্ব প্রায় ২০ শতাংশে পৌঁছেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক ঋণ প্রাপ্তির মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিলেও দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত সেই অর্জনগুলোকে নষ্ট করার ঝুঁকি তৈরি করছে।

বিশেষ করে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রতি মনোযোগ দিয়েছে ম্যাগাজিনটি। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারসস্তা অস্ত্র বিনিয়োগের আশায়যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ঝুঁকিতে ফেলছে বলে মত দিয়েছে দ্য ইকোনমিস্ট। 

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য সহায়তাদাতা। অপরদিকে, পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোয় প্রতিবেশী ভারত অসন্তুষ্ট হয়েছে, যা বাণিজ্য চুক্তি বাতিল এবং নদী পানি বণ্টন চুক্তি পুনর্বিবেচনার হুমকি ডেকে এনেছে।

বিতর্কিত নিষেধাজ্ঞা

তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হিসেবে ম্যাগাজিনটি তুলে ধরেছে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে।

চলতি বছরের ১০ মে, অন্তর্বর্তী সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। 

২০২৪ সালের আন্দোলন দমন করতে গিয়ে দলটির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরকারের তথ্যমতে, ওই দমন-পীড়নে প্রায় ৮০০ জন প্রাণ হারান। 

এর আগে, একই অভিযোগে ২০২৪ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকেওসন্ত্রাসী সংগঠনহিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হয়।

সরকার জানিয়েছে, দলের বিরুদ্ধে চলমান বিচারিক কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। একইসঙ্গে দলটির নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাগুলো চলমান থাকায় তারা নির্বাচনে প্রার্থী দিতে পারবে না।

কিন্তু দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, এই সিদ্ধান্তআইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধএবং বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রতিপক্ষ দমনের রাজনীতির একটি পরিচিত কৌশল। একটি বড় রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে সরকার একটি প্রতিহিংসার রাজনীতির চক্রকে আবারও সক্রিয় করে তুলতে পারে।

প্রয়োজন অন্তর্ভুক্তির, প্রতিশোধ নয়

দ্য ইকোনমিস্ট স্বীকার করছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তবেসব আওয়ামী লীগ সমর্থক কলুষিত নন।সংখ্যালঘু সংস্কারপন্থী ভোটারদের মধ্যে এখনো দলটির উল্লেখযোগ্য সমর্থন রয়েছে। এই ভোটারদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা নির্বাচন ব্যবস্থার বৈধতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

ম্যাগাজিনটি আরও বলছে, আওয়ামী লীগ বর্তমানে দুর্বল হলেও অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনে তারা পরাজিত হতে পারে। কিন্তু সংসদে তাদের অংশগ্রহণ সরকারকে আরও জবাবদিহিমূলক ভারসাম্যপূর্ণ করবে।

নতুন বাংলাদেশ গঠনে প্রতিশোধ নয়, প্রয়োজন মিলন সমঝোতা,” বলছে দ্য ইকোনমিস্ট।

একটি অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির ডাক

দ্য ইকোনমিস্ট-এর মতে, সংকট সমাধানের পথ হলো আওয়ামী লীগের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া এবং কঠোর নজরদারির আওতায় দলটিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট হবে এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে।

পত্রিকাটির ভাষ্য, “বাংলাদেশি ভোটারদের অধিকার আছে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী প্রার্থী নির্বাচনের।সকল প্রধান দলের অংশগ্রহণে একটি বহুদলীয়, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই পারে ২০২৪ সালের বিপ্লবের চেতনা টিকিয়ে রেখে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে।

দ্য ইকোনমিস্ট বলছেআওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা শুধু একটি আইনগত বা রাজনৈতিক ভুল নয়, বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য একটি ভয়াবহ ঝুঁকি। এর বদলে, দরকার সহনশীলতা, অংশগ্রহণ এবং আপোষের রাজনীতি।

Link copied!