জুন ২২, ২০২৫, ০১:৩৪ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব ‘পালন না করে’ উল্টো ‘ভয়-ভীতি দেখিয়ে’ জনগণের ভোট ছাড়াই নির্বাচন সম্পন্ন করার অভিযোগে মামলা করেছে বিএনপি।
রোববার, ২২ জুন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় দায়ের করা এ মামলার আসামির তালিকায় দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালন করা তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট ১৯ জনের নাম রয়েছে।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং মামলা, গুম, খুন ও তথ্য সংরক্ষণ সমন্বয়ক সালাহ উদ্দিন খান এ মামলার বাদী, যিনি একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ওই তিন নির্বাচনে ‘গায়েবী মামলা, অপহরণ, গুম খুন ও নির্যাতনের’ ভয় দেখিয়ে, বিএনপি নেতাকর্মীদের ‘গণগ্রেপ্তার’ করে নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়।
“সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে থাকা সত্বেও সংবিধান লঙ্ঘন, নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন, সরকারি কর্মচারী হয়েও অবৈধভাবে ভোটে হস্তক্ষেপ, ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোটের কাজ সম্পূর্ণ করা ও জনগণের ভোট না পেলেও সংসদ সদস্য হিসেবে মিথ্যাভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
“উক্ত ঘটনার সাক্ষী সকল ভোট কেন্দ্র এলাকার ভোটাররা এবং ভোটারদের মধ্যে যারা ভোট প্রদান করতে বঞ্চিত হয়েছেন তারাসহ ভোট কেন্দ্রে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্যরা। এছাড়া ভোট কেন্দ্রে অনেক সৎ প্রিজাইডিং অফিসার, পুলিংশ অফিসারসহ স্থানীয় লোকজনসহ আরো অন্যান্যরা ঘটনার সাক্ষী হবে।
“এছাড়া ব্যালট পেপারে যে সিল ও স্বাক্ষর রয়েছে, তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই প্রকৃতভাবে তারা ভোট দিয়েছে কিনা সে বিষয়ে উল্লেখিত ঘটনার সঠিক রহস্য তদন্তে সত্য উদঘাটিত হবে।”
সালাউদ্দিন খানের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল বেলা ১১টার দিকে শেরেবাংলা নগর থানায় গিয়ে মামলার কপি ও দস্তাবেজ ওসি ইমাউল হকের কাছে হস্তান্তর করেন।
কাগজগুলো হাতে পাওয়ার পর ওসি ইমাউল হক বলেন, “বাদীদের ভাষ্যমতে বিগত সময়ে নির্বাচন কমিশনে যে কর্মকর্তারা ছিলেন, তারা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেননি। উল্টো তারা ভয় ভীতি দেখিয়ে ভোট সম্পন্ন করেছেন এবং জনগণের ভোট ছাড়াই প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করেছেন বলে বাদীর অভিযোগ।
“এভাবে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের বিজয় ঘোষণা করা বাদীর দৃষ্টিতে দণ্ডনীয় অপরাধ। সে সমস্ত অপরাধের একটা ফিরিস্তি নিয়ে ১৯ জনের নাম উল্লেখ করে একটা অভিযোগ দায়ের করেছেন বাদী।”
কোন আইনের কোন ধারায় মামলাটি হচ্ছে জানতে চাইলে ওসি বলেন, “আমরা পর্যালোচনা করে মামলাটি রেকর্ড করার ব্যবস্থা করছি।”
মামলার অভিযোগের কাগজ হাতে পেয়ে ওসিকে সেগুলোর ছবি তুলে কাউকে পাঠাতে দেখা যায়। ফোনে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মামলার বিবরণের কিছুটা পড়ে শোনান।
২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে সিইসি, ইসি ও সচিবদের ভূমিকা তদন্তে অন্তবর্তীকালীন সরকারের কমিটি গঠনের ঘোষণার এক সপ্তাহের মাথায় বিএনপি মামলার পদক্ষেপ নিল।
বিএনপি প্রতিনিধি দল থানায় আসার আগে নির্বাচন কমিশনে গিয়ে মামলার আবেদনের কপি এবং দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত একটি চিঠি প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসিরুদ্দিনের কাছে পৌঁছে দেন।
সালাহ উদ্দিন খান পরে সাংবাদিকদের বলেন, “এখানে সিইসি ও ইসি সচিব ছিলেন। আমরা তাদের কাছে অভিযোগ জমা দিলাম। আমরা জানি বর্তমান কমিশন এ অভিযোগের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। তারা (আগের কমিশন) যেহেতু সংবিধান লঙ্ঘন করে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন, এজন্যে তাদের বিরুদ্ধে শেরেবাংলা থানায় এজহার করা হবে।”
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কী আশ্বাস দিয়েছেন জানতে চাইলে এ বিএনপি নেতা বলেন, “প্রধান নির্বাচন কমিশনার আমাদের বলেছেন, এখন কপি রিসিভ করেছেন, যা পারেন আইনি ব্যবস্থা নেবেন। সিইসি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, তারা নিরপেক্ষ। ‘আমরা আপনাদেরও নয়, কারো পক্ষে নয়। আমরা নিরপেক্ষ, যে আইনি ব্যবস্থা সেটা আমরা করব’।”
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে।
সে অনুযায়ী ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা হয় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়।
বিএনপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের বর্জনের মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে যান। সেই সংসদকে ‘বিনা ভোটের সংসদ’ আখ্যা দেয় ভোট বর্জন করা বিএনপি।
কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন ওই কমিশনে নির্বাচন কমিশনার ছিলেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আবু হাফিজ, সাবেক যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ আব্দুল মোবারক, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাবেদ আলী এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা দায়রা জজ মো. শাহনেওয়াজ।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠে। অধিকাংশ ভোট আগের রাতে হয়ে যাওয়ার অভিযোগের মধ্যে বিরোধীরা মাত্র সাতটি আসনে জয় পায়। সে নির্বাচনের নাম হয় ‘নীশিরাতের নির্বাচন’।
কেএম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন এ কমিশনের সদস্য ছিলেন সাবেক সচিব রফিকুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ কবিতা খানম ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারিতে বিএনপি ও সমমনাদের বর্জনে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে শরিক ও বিরোধীদল জাতীয় পার্টির জন্য আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের সঙ্গে দলের বিদ্রোহীদের। এ নির্বাচনের নাম হয় ‘আমি আর ডামি’ নির্বাচন।
কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন এ কমিশনে চার নির্বাচন কমিশনার ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ রাশেদা সুলতানা ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান।
প্রশ্নবিদ্ধ ওই তিন নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ জয়ী হয় এবং ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করে যায়। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে।
গতবছর ডিসেম্বরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিল করে রায় দেয় হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ। তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর পথ তৈরি হয়।
অবাধ ও নিরপেক্ষতা ‘নিশ্চিত করতে না পারায়’ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিন জাতীয় নির্বাচনে ‘জনগণের আস্থা ধ্বংস করা হয়েছে’ বলে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয় ওই রায়ে।
এরপর গত ১৬ জুন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক বৈঠক শেষে সরকারপ্রধানের দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হওয়া ‘বিতর্কিত’ তিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে জড়িত সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিবদের ভূমিকা তদন্তে অবিলম্বে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।