এভারেস্ট জয় করা কি আসলেই গৌরবের

গোলাম রাব্বানী

মে ২১, ২০২৪, ০৩:৫৬ পিএম

এভারেস্ট জয় করা কি আসলেই গৌরবের

এভারেস্ট জয়ের বিষয়ে সহসাই নিয়ন্ত্রণের পক্ষে নয় নেপাল সরকার। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি বাবর আলী নামে একজন চিকিৎসক এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছে। আর এই নিয়েই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে আদৌ এখন এভারেস্ট জয় করা গৌরবের কিছু কিনা। অনেকেই এর পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে করছেন তর্ক-বিতর্ক। তবে এখন প্রায় ১ লাখ লোক এভারেস্ট ভ্রমণে যায়। ফলে পুরো এভারেস্ট মলমূত্রসহ নানা ময়লা আবর্জনার স্তুপ হিসেবে থাকে।

এভারেস্ট জয় করতে একাধিকবার নিয়ন্ত্রণের কথা থাকলেও নেপাল সরকারের আয়ের অন্যতম বড় উৎস এই এভারেস্ট। ফলে সহসাই তারা এটি নিয়ন্ত্রণের পক্ষে নয়।

মলমূত্রে ভরা এভারেস্ট
প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১ লাখ মানুষ হিমালয়ে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তবে সবাই এভারেস্টের চূড়ায় পৌছায় না অনেকেই ছোট ছোট ক্যাম্প করে থাকে। ফলে সেই ক্যাম্পগুলোর তাঁবুসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র সেখানে ফেলে রাখা হয়। মাউন্টিয়ারিং ট্যুরিজমের মতে এভারেস্টে বছরে গড়ে ৫০ টন ময়লা আবর্জনা পর্যটক ও ভ্রমণ পিপাসুরা রেখে যায়।

এভারেস্টে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে মলমূত্র। ছবি: সংগৃহীত

শুধু তাঁবু ও অন্যান্য সরঞ্জামের ময়লাই নয় বরং আউডসাইড ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় এভারেস্ট জয় করতে এসে পর্যটকরা ২ লাখ ৬০ হাজার পাউন্ড ওজনের পায়খানা ও প্রসাব ত্যাগ করে। যেহেতু এটি পুরোটাই ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় অবস্থিত ফলে পুরো বছরই সেগুলো সতেজ থাকে। এমনটি মল মূত্র নিচে পরে হিমালয়ের নিচে থাকা বসতি ও পশুপাখির জীবনযাপন ব্যহত করেছ। মাঝেমধ্যেই গৃহপালিত গরু ও অন্যান্য পশু এই মলে আটকা পরে যাওয়ার মতো ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছিল ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে।

এদিকে স্থানীয়দের ভূ-পৃষ্ঠের পানির উৎসগুলো এখন পান করার যোগ্য নেই। এমনকি বাতাসের সাথে মল মূত্রের গন্ধ আসার অভিযোগ করেছে। এদিকে এভারেস্টে যাওয়া পর্যটকদের মলমূত্র নিয়ে আসারও নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। এভারেস্টে এত মলমূত্র থাকে যে গাইডরা কোনো ধরনের হলুদ-কমলা রংয়ের বরফ খেতে নিষেধ করে থাকে।

লাশ ব্যবহার হয় সঠিক রাস্তা হিসেবে
আধুনিক প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি থাকলেও এভারেস্টে জয় করাটা এখনও কষ্টকর। ফলে প্রতি ১০টি সাফল্যের পাশাপাশি একটি মৃত্যু হয়ে থাকে। আর প্রতি বছর গড়ে ৮০ জন মারা যাচ্ছে এই এভারেস্ট জয় করতে গিয়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই লাশ বহন করে নিচে নিয়ে আসা হয় না। আর বরফে আচ্ছ্বাদিত এলাকা থাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই লাশগুলো পঁচে যায় না।

ফলে এত বেশি লাশ এখন এভারেস্টে রয়েছে সেগুলো এখন পর্যটকরা যাতায়াতের রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করছে। অর্থাৎ লাশ ধরে ধরেই সঠিক পথে আগাচ্ছে ভ্রমণ পিপাসুরা।

এভারেস্টে আবর্জনার স্তূপ বেমানান। ছবি: সংগৃহীত

একাধিকবার এভারেস্ট জয় করা ভারতের পর্বতারোহী টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানান যে, দক্ষতা অর্জন না করে এভারেস্ট জয়ের চিন্তা করা উচিৎ নয়। অনেক প্রতিষ্ঠান কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য না রেখে অপ্রস্তুত পর্বতারোহীদের উৎসাহিত করছে। এগুলোর আগে নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য রেখে বিভিন্ন সামিট আগে জয় করে এভারেস্ট জয় করতে যাওয়া উচিত।

তিনি আরও বলেন, আপনাকে শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য শেরপার ওপর নির্ভর না করে নৈপুণ্য শিখতে এবং স্বাধীন নিরাপদ আরোহণের অনুশীলন করতে উৎসাহিত করুন।

ঝুঁকিতে বেশি গাইড শেরপারা
তবে এভারেস্ট জয়ের জন্য বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে স্থানীয় শেরপারা। যারা এভারেস্ট জয় করতে আসা পর্যটকদের গাইড দিয়ে থাকে। বর্তমানে ৯০০ শেরপা এই গাইডের কাজ করছে। নিরাপদ সড়ক, তাবু বসানো, দড়ি টানা থেকে শুরু করে সকল কাজগুলো মূলত তারাই করে থাকে। ফলে পর্যটকদের চেয়ে তাদের পরিশ্রম এবং ঝুঁকিও বেশি। এমনকি পর্যটকদের ছবি তোলার কাজও তাদের হয়।

কাজটা এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে এভারেস্টে মারা যাওয়া এক-তৃতীয়াংশই স্থানীয় শেরপারা হয়ে থাকে। অর্থাৎ বছরে গড়ে ৩০ জন শেরপা এভারেস্টে গাইড হিসেবে গিয়ে মারা যাচ্ছে।

নেপাল কেন এভারেস্ট ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ করছে না
প্রতি বছরই এভারেস্ট জয় করতে যদি এত মৃত্যু হয় তাহলে কেন নেপাল সরকার এই ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসছে না। মূলত এভারেস্ট নেপালের পর্যটন শিল্পে একটি বড় অবদান রাখছে। নেপালের জিডিপি মাত্র ৪০ বিলিয়ন ডলার। ফলে দেশটির অন্যতম আয়ের উৎস এই মাউন্ট এভারেস্ট।

এখন এভারেস্ট আরোহণের আগে জনপ্রতি ১২ হাজার ডলার ফি দিতে হয় নেপালের সরকারকে। যা বাংলাদেশের টাকায় প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি বছরে এভারেস্ট জয় করার জন্য আগত পর্যটকদের মাধ্যমে দুটো বেস ক্যাম্প থেকে নেপালের আয় হচ্ছে ১০ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রায় ১২০ কোটি টাকা। তবে শুধু এভারেস্ট জয় করা নয় বরং হিমালয়ের অন্যান্যস্থানে ক্যাম্প বাবদও পর্যটন শিল্প চাঙ্গা নেপালের। বর্তমানে এভারেস্ট ওঠার নিবন্ধন ফি ১৫ হাজার ডলার করার পরিকল্পনাও করছে দেশটির সরকার।

অত্যাধিক খরচ
দিন দিন ব্যয়বহুল হয়ে ওঠেছে এভারেস্টে আরোহণ। এভারেস্ট হুট করে জয় করা নয় বরং এজন্য দুই থেকে তিন বছরের পরিকল্পনা নিতে হয়। এ জন্য মাসের পর মাস যে শারীরিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন, তাতেও প্রচুর টাকা খরচ হতে পারে।

তবে শুধু এভারেস্ট আরোহণের জন্য একজন ব্যক্তির ন্যূনতম ২৫ লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে। শুধু পর্বতে ওঠার জন্য জনপ্রতি ১২ হাজার ডলার রয়্যালটি ফি নেপাল সরকারকে দিতে হয়। এই টাকার বিনিময়ে ক্লাইম্বিং পারমিট অর্থাৎ পর্বতে ওঠার অনুমোদন পাওয়া যায়। নেপাল সরকার শুধু পর্বতারোহীর নাম তালিকায় রাখে চূড়ায় আরোহণ করতে পারলে তা ঘোষণা করা হয়। পর্যটকদের যাবতীয় সরঞ্জাম, খাবার, গাইড সব কিছুর খরচ ‍গুনতে হয়।

অক্সিজেন ট্যাংক ও উচ্চতায় বিভিন্ন যন্ত্রর তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ, জ্যাকেট, বুট, থাকা খাওয়া, শেরপার গাইড ফি ১০-২০ লাখ টাকা খরচ হয়ে থাকে। সে সাথে যোগ হচ্ছে অন্য দেশ থেকে যাতায়াতের খরচসহ বিভিন্ন আনুসাঙ্গিক ফি।

তবে এভারেস্ট আরোহণের সামগ্রিক আয়োজন ও লেনদেনের সব কাজ মূলত এজেন্সিরাই করে থাকে। তারা অনেকটা ট্রাভেল এজেন্সির মতো। সর্বশেষ বাবর আলী এভারেস্ট জয় করেছে সেখানে খরচ হয়েছে ৪৫ লাখ টাকা। যেখানে সাতটি প্রতিষ্ঠান স্পন্সর করেছিল।

Link copied!