আজকে স্মরণে এমন একজন ক্রীড়াবিদকে নিয়ে কথা বলব, যার জন্য খোদ ফুটবল বিশ্বকাপও আফসোস করে। তিনি হলেন ফেরেঙ্ক পুসকাস। হাঙ্গেরির ক্ষণজন্মা এক ফুটবলার। তাকে ভাগ্যাহত ফুটবলারও বলা হয়। সকল যোগ্যতা থাকার পরও হাঙ্গেরি তার সময়ে বিশ্বকাপ জিততে পারেনি শুধু ভাগ্যের ফেরে। এই ভাগ্য জড়িয়ে ছিল পুসকাসের বিধিলিপিতেই। পঞ্চাশের দশকে ছবি বিশ্বাসের একটা সংলাপ বাংলার দর্শকদের বুকে তিরের মতো বিঁধেছিল, ‘ফিরিয়ে দাও আমার জীবনের বারোটি বছর!’ চাইলে একই সংলাপ ফেরেঙ্ক পুসকাসও দিতে পারতেন।
১৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মেক্সিকোর আন্তোনিও কারভাহাল খেলেছেন পাঁচ-পাঁচটি বিশ্বকাপে। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ১৪ বছরে পেলেও অংশগ্রহণ করেন চারটি বিশ্বকাপে। সেখানে ১৯৪৫ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত দুই পর্ব মিলে ১৭ বছর ব্যাপ্ত ফুটবলার জীবনে পুসকাস অংশগ্রহণ করেন মাত্র দুটি বিশ্বকাপে। তাও আবার দুটি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেন দুটি ভিন্ন দলের হয়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত বিশ্বে ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়নি কোনো বিশ্বকাপ। ১৯৫০ বিশ্বকাপ থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেয় পুসকাসের মাতৃভূমি হাঙ্গেরি। এভাবেই ১৯৫৪ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে করতে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেকের পর নয়টি বছর পার হয়ে যায় পুসকাসের।
১৯৫৪-এর বিশ্বকাপে হইচই ফেলে দেওয়া পুসকাসের ‘মাইটি ম্যাগিয়ার্স’ হাঙ্গেরি ১৯৫৮ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করলেও আবার দৃশ্যপটের বাইরে ‘দ্য গ্যালোপিং মেজর’ পুসকাস। ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত আগ্রাসনের কারণে আরও অনেকের মতো দেশ ছাড়তে বাধ্য হন পুসকাসও। ১৯৫৪ বিশ্বকাপের রানার-আপ সেই বিখ্যাত মাইটি ম্যাগিয়ার্স দলের মাত্র চারজন খেলোয়াড়কে নিয়ে গড়া ১৯৫৮-এর হাঙ্গেরি দলটির প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয়। ফেরারি জীবনে দূর থেকে বসে বসে খবর নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না পুসকাসের।
মাঝে ১৯৫৮ বাদ দিয়ে ১৯৬২ সালে আরও একবার বিশ্বকাপে খেলেছিলেন পুসকাস। এবার গায়ে চড়ান আশ্রয়দাতা দেশ স্পেনের জার্সি। ইনজুরির কারণে শেষ মুহূর্তে ছিটকে পড়ায় আরেক যাযাবর ডি স্টেফানোর বদলি হিসেবে ১৯৬২ বিশ্বকাপে মাঠে নামেন পুসকাস। তিনটি ম্যাচ খেলেও গোলশূন্য ছিলেন। এই প্রথমবারের মতো গোলের রাজা পুসকাস নিরাশ করেন সমর্থকদের। স্পেনের হয়ে আরও একটি ম্যাচ খেললেও সেটিতেও গোলশূন্যই ছিলেন পুসকাস।
বুদাপেস্ট হনভেডের হয়ে ৩৪১ ম্যাচে ৩৫২ গোল, রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ১৮০ ম্যাচে ১৫৬ গোল কিংবা হাঙ্গেরি জাতীয় দলের হয়ে ৮৪ ম্যাচে ৮৫ গোল করা পুসকাসের জন্য গোলশূন্য থাকা এই পৃথিবীর বিরল ঘটনাগুলোর একটি।
তাই তো পুসকাসের কথা বললেই সবার মনে যে ছবি ভেসে ওঠে সেই পুসকাস বুদাপেস্ট, রিয়াল কিংবা স্পেনের পুসকাস নয়, সেই পুসকাস ১৯৬২-এর পুসকাস নয়; সেই পুসকাস হাঙ্গেরির, সেই পুসকাস ১৯৫৪-এর। ১৯৫৪ বিশ্বকাপে পুসকাসরা শুধু শিরোপা জয় ছাড়া করেছিলেন সম্ভাব্য সবকিছুই। বিশ্বকাপের আগের পাঁচ বছরে ৩২ ম্যাচে অপরাজিত হাঙ্গেরি বিশ্বকাপেও অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটছিল। ফাইনালের পথে তারা হারিয়েছিল উরুগুয়ে, পশ্চিম জার্মানি, ব্রাজিলের মতো দলগুলোকে। এর মধ্যে প্রথম রাউন্ডে দক্ষিণ কোরিয়াকে ৯-০ এবং পশ্চিম জার্মানিকে ৮-৩ গোলে বিধ্বস্ত করেন পুসকাসরা।
নিয়তির নির্মম পরিহাস! ফাইনালে সেই পশ্চিম জার্মানির সঙ্গেই ৩-২ গোলে হেরে শেষ হয় পুসকাসের স্বপ্নের পথচলা। অথচ ম্যাচের মাত্র আট মিনিটের মধ্যেই পসুকাস এবং চিবরের গোলে ২-০-তে এগিয়ে গিয়েছিল হাঙ্গেরি। বার্নের ওয়াঙ্কডর্ফ স্টেডিয়ামের ফাইনালে পুসকাসরা কেন সেবার বিশ্বকাপটি জিততে পারলেন না, সেটি আজও এক রহস্য। বিশ্ব ফুটবলে যা ‘মিরাকল অব বার্ন’ নামেই বিখ্যাত হয়ে আছে।
বলা হয়ে থাকে হাঙ্গেরির ফুটবল পুরোটাই পুসকাসময়। পুসকাসের আগেও তেমন কিছু নেই, নেই পুসকাসের পরেও। ১৯৫২ সালে অলিম্পিকে সোনা জেতা পুসকাসের হাঙ্গেরি তার সময়ই টানা ৩২ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড গড়েছিল। জিতেছিল ইউরোপিয়ান কাপও। হাতছোঁয়া দল নিয়েও পুসকাসরা সেবার রানার্স আপের সান্ত্বনা নিয়েই দেশে ফিরেছিলেন।
১৯৫৪ বিশ্বকাপে রানার্স আপ হওয়াটাই ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক চরিত্র, জাতীয় দলের হয়ে ৮৪ ম্যাচে অবিশ্বাস্য ৮৫ গোল করা পুসকাসের ‘সেরা’ বিশ্বকাপ সাফল্য।
তবে ইতিহাস যে কেবল প্রাপ্তিতে ভরপুর রোমান্টিক হিরোদেরই মনে রাখে তা নয়, কখনো কখনো মনে রাখে সব প্রতিভা নিয়েও চির বঞ্চিত ট্র্যাজিক হিরোদেরও। ভাগ্য এবং রাজনীতিতে জর্জরিত অমিত প্রতিভাধর পুসকাস তেমনি একজন, যার গোল করার প্রতিভা নতুন প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দিতে ২০০৯ সালে ফিফা চালু করে প্রতিবছর সবচেয়ে সুন্দর গোলের জন্য ফিফা পুসকাস অ্যাওয়ার্ড। বিশ্বকাপ না জেতা পুসকাসের আমৃত্যু আক্ষেপ ছিল। বিশ্বকাপ ইতিহাসও হয়তো আক্ষেপ করে, কেন ট্রফিটা উঠল না ফুটবল ইতিহাসের অনন্য এই সূর্যসন্তানের হাতে!
যুদ্ধ আর রাজনীতির ডামাডোলের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বছর হারিয়ে না গেলে, কে জানে হয়তো বিশ্বকাপ আক্ষেপও ঘুচিয়ে দিতে পারতেন। জীবন নদীর ওপারে চলে যাওয়া পুসকাস তাই বলতেই পারতেন, ‘ফিরিয়ে দাও...!’
অমিত মেধার অধিকারী পুসকাস জন্মেছিলেন হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে, ১৯২৭ সালের ১ এপ্রিল। ২০০৬ সালের ১৭ নভেম্বর এই ‘গ্যালোপিং মেজর’ (বিদ্যুৎ গতির মেজর) এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।