সৈয়দ শামসুল হক। বাংলাসাহিত্যের এক ক্ষণজন্মা সাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যের এমন কোনও শাখা নেই, যা তাঁর সৃষ্টিতে সমৃদ্ধ হয়নি। কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, গীতি কবিতা, উপন্যাস, নাটক, কাব্যনাট্য, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, শিশু-কিশোরসাহিত্য, সায়েন্স ফিকশন, সাহিত্য-কলাম, অনুবাদ, আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনি—সব ক্ষেত্রেই তাঁর সদর্প পদচারণা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতে, রবীন্দ্রনাথের পরে সৈয়দ হকই একমাত্র বাঙালী সাহিত্যিক, যিনি সফলভাবে সাহিত্যের সব শাখায় স্বীয় অবদানের কারণে প্রবলভাবে আলোচিত ও সমালোচিত। তিনি আরও বলেন, “সৈয়দ হক যৌবনে এক অসাধারণ সাহসিকতার সঙ্গে পেশা হিসেবে লেখালেখিকেই বেছে নিয়েছিলেন। আমরা আশঙ্কা জানিয়েছিলাম, এটা কি সম্ভব হবে সে সময়ের প্রেক্ষাপটে। কিন্তু তিনি সেটাকে সম্ভব করে ছেড়েছেন।”
সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে। ১৯৫০ সালে গণিতে লেটার মার্কস নিয়ে সৈয়দ শামসুল হক ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। গণিতসহ বিজ্ঞান বিষয়গুলোতে ভাল দখল থাকায় বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে ডাক্তার হোক। বাবার এই দাবি এড়াতে পালিয়ে বম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) পাড়ি দেন।
মুম্বাইয়ে একটি সিনেমা প্রডাকশন হাউসে সহকারি হিসেবে এক বছর চাকরি করার পর বাবার অনুরোধে ফিরে আসেন, ভর্তি হন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। কলেজ জীবন শেষ করে ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হলেও দুই বছর পর অসমাপ্ত রেখে বেরিয়ে আসেন।
আশি বছরের বর্ণাঢ্য জীবনে সব সময় সন্ধান করেছেন সাহিত্যের নতুন প্রকরণ। গল্পপ্রবন্ধ, গল্পপট, গাথাকাব্য-এর মতো নিজস্ব সাহিত্যশাখা তৈরি করেছেন। সাহিত্যকর্মের সমান্তরালে রচনা করেছেন স্মরণীয় কিছু চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য এবং কালজয়ী বাংলা গান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতোই তাঁর সৃষ্টিপ্রতিভা বিস্তৃত হয়েছে চিত্রকর্মেও। নিজের বেশকিছু রচনার ইংরেজি অনুবাদও করেছেন তিনি।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সবচেয়ে কম বয়সে (২৯ বছর) বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই লেখক শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ বাংলায় রূপান্তরসহ লিখে গেছেন তিনটি কবিতার বই, একটি গল্পের বই এবং ‘ভাবনার ডানা’ নামের ব্যতিক্রমী ভাবনাগুচ্ছ।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত না করে পৃথিবীর পাঠশালায় শিক্ষিত হয়েছেন; আজ দেশ-বিদেশে তিনি নিজেই প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার বিষয়। ‘সব্যসাচী’ অভিধায় অভিষিক্ত সৈয়দ শামসুল হকের মঞ্চনাটক ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশে মঞ্চস্থ হয়েছে। তাঁর কাব্য ‘পরানের গহীন ভিতর’ বাংলা কবিতার অমৃত সম্পদ।
সৈয়দ শামসুল হকের বড়গল্প ‘রক্তগোলাপ’ বিশ্বসাহিত্যের জাদুবাস্তব ধারার পথিকৃৎ সংযোজন। তিনি নগরজীবন ও নাগরিকদের জীবনচিত্র তুলে ধরেন তাস (১৯৫৪) গল্পগ্রন্থে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেমন এককালে চরিত্রহীন উপন্যাস লিখে বাংলা সাহিত্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন, তেমনি সৈয়দ শামসুল হক ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন খেলারাম খেলে যা (১৯৬২) উপন্যাস লিখে।
আধুনিকতার প্রধান কথাটি হচ্ছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। আত্মসচেতনতা মানুষকে সমাজ-শরীর থেকে আলাদা করেছে, বিচ্ছিন্ন করেছে, স্বভাবের অবিকল অনুসারী করেছে। একই সঙ্গে ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘নীল দংশন’ বা ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ উপন্যাস বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেছে অনন্য ব্যঞ্জনায়।
সৈয়দ হকের প্রাবন্ধিক গদ্যগ্রন্থ ‘মার্জিনে মন্তব্য’, ‘কথা সামান্যই’ এবং ‘হৃৎকলমের টানে’ গোটা বাংলা সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতেই অভিনব। বাংলা সাহিত্যের ভূগোলে তিনি ‘জলেশ্বরী’ নামের কল্পিত ভূখণ্ডের স্রষ্টা। সমস্ত অন্যায়-অসাম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি ‘জাগো বাহে কোনঠে সবাই’ বলে জাগরণের ডাক দেন।
১৯৭১ সালে লন্ডনে যেয়ে বিবিসি বাংলায় খবর পাঠক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসর্মপণের খবরটিবিবিসিতে তিনিই পাঠ করেছিলেন। পরে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বিবিসি বাংলার প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার ভরাট কণ্ঠ ও সাবলীল উচ্চারণের জন্য তিনি জনসাধারণ্যে পরিচিতি লাভ করেন।
২০১৬ সালের ১৫ এপ্রিল ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিলে সৈয়দ শামসুল হককে লন্ডন নিয়ে যাওয়া হয়। রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে পরীক্ষায় তার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়লে সেখানে চিকিৎসকরা তাকে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি দেন। চার মাস চিকিৎসার পর ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।