ওটিটি: যা যা থাকছে সরকারের খসড়া নীতিমালায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২২, ০৫:১৪ এএম

ওটিটি: যা যা থাকছে সরকারের খসড়া নীতিমালায়

সারাবিশ্বেই ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্ল্যাটফর্ম তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তি ও যুগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশেও ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চালু হয়েছে। দেশীয় সেসব প্ল্যাটফর্মের কনটেন্টগুলো জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ওটিটি সেবা প্রদান ও পরিচালনা বিষয়ে একটি নীতিমালা করতে যাচ্ছে সরকার। সম্প্রতি সেই নীতিমালার একটি খসড়া তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

খসড়া নীতিমালায় ওটিটি প্ল্যাটফর্মের নিবন্ধন থেকে শুরু করে কনটেন্ট প্রচারের ক্ষেত্রে নানা নির্দেশনা দেওয়া আছে। খসড়ার সূচনায় বলা হয়, দেশি–বিদেশি মালিকানায় পরিচালিত ওটিটি প্ল্যাটফর্মে প্রচারিত কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা ও বিজ্ঞাপনে যাতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পরিপন্থী, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী, রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী কোনো কনটেন্ট প্রচারিত না হয়, তা নিশ্চিত করা এবং দেশীয় সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধকে রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই এই নীতিমালা।

নীতিমালাটির নাম হবে ‘ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান এবং পরিচালনা এবং বিজ্ঞাপন প্রদর্শন নীতিমালা ২০২১’।

খসড়া অনুযায়ী কনটেন্ট বলতে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ইন্টারনেট বা সমজাতীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচারিত কোনো তথ্য, অনুষ্ঠান, বিজ্ঞাপন ও অশ্লীল তথ্য উপকরণের কথা বলা হয়েছে। এখানে অশ্লীল কনটেন্ট হচ্ছে প্রচলিত আইন ও এই নীতিমালা এবং তার অধীনে প্রণীত সংশ্লিষ্ট সব নির্দেশিকাবহির্ভূত কনটেন্ট। ইন্টারনেট ব্যবহার করে ডিজিটাল কনটেন্ট সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠানই ওটিটি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হবে।

ওটিটি নিবন্ধন কর্তৃপক্ষসংক্রান্ত আইন, বিধিমালা না হওয়া পর্যন্ত তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন কোনো দপ্তর বা সংস্থা নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করবে। ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর কার্যক্রম তদারকি করবে এই কর্তৃপক্ষ।

নিবন্ধন পাওয়ার জন্য যা করতে হবে

নিবন্ধনের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হবে। কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান একাধিক ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য আবেদন করতে পারবে। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ইকোসিস্টেমে উপস্থাপিত প্রকাশক, কিউরেটেড কনটেন্ট প্রোভাইডার, আনকিউরেটেড কনটেন্ট প্রোভাইডারদেরও নিবন্ধন নিতে হবে।

পাশাপাশি এই নীতিমালার নিয়ম মেনে চলতে হবে। উল্লেখ্য, কিউরেটেড কনটেন্ট প্রোভাইডার বলতে, যে প্রতিষ্ঠান নিজের নির্মিত বা অন্যের নির্মিত কনটেন্ট বিতরণ চুক্তির অধীনে প্রচার করে, তাদের বোঝানো হয়েছে। অন্যদিকে কোনো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজের অ্যাকাউন্ট বা পেজ (ইউটিউব, ফেসবুক, গুগল ইত্যাদি) থেকে কনটেন্ট প্রচার করে, তাদের আনকিউরেটেড কনটেন্ট প্রোভাইডার বলা হয়েছে।

অফেরতযোগ্য পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে আবেদনপত্র নিতে হবে। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে টাকা দিতে হবে না। এ ছাড়া ফেরতযোগ্য আর্নেস্টমানি বাবদ দেশি প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ লাখ টাকা ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ২৫ লাখ টাকা আবেদনের সঙ্গে দিতে হবে। এখানেও সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড় পাচ্ছে। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ওটিটি চালানোর জন্য নিজ বিভাগের অনুমোদন থাকতে হবে। কী কী প্রচার করা হবে, তার উদ্দেশ্য ও তথ্য উপকরণের ধরন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য আবেদন যাচাইয়ে ছাড়পত্রের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে পাঠানো হবে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো হবে। নিবন্ধন ছাড়া কনটেন্ট কোনো প্রতিষ্ঠান প্রচার করতে পারবে না।

নিবন্ধন ফি ও নবায়ন

নিবন্ধন গ্রহণের সময়ে ফি হিসেবে দেশি প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ লাখ টাকা এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ২০ লাখ টাকা দিতে হবে। নিবন্ধনের মেয়াদ তিন বছর। নবায়নে দেশি প্রতিষ্ঠানকে তিন লাখ টাকা ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ টাকা দিতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নবায়নে ব্যর্থ হলে জরিমানাও দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য ৫০ হাজার এবং বিদেশির ক্ষেত্রে ১ লাখ টাকা।

নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিল প্রক্রিয়া

সরকারের কোনো পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে, নীতিমালার কোনো উদ্দেশ্য ব্যাহত হলে, বিটিসিএল বা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের শর্ত ভঙ্গ করলে, প্রচার তিন মাস বন্ধ থাকলে।

কনটেন্টের বয়সসীমা

প্রতিটি কনটেন্ট প্রচারের আগে তা কোন বয়সী দর্শকের জন্য উপযুক্ত সে বিষয়ে অবহিত করতে হবে। প্ল্যাটফর্মে দর্শক প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণে পাসওয়ার্ডের ব্যবস্থা থাকবে। অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সাধারণ দর্শকের জন্য, পিতামাতার তত্ত্বাবধানে প্রদর্শনযোগ্য, অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে (১২ থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত), ১৫ বছর থেকে ১৭ বছর বয়সীদের জন্য এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রদর্শনযোগ্য—এভাবে শ্রেণিবিন্যাস করে কনটেন্ট প্রচার করতে হবে।

যা সম্প্রপ্রচার করা যাবে না

জাতীয় সংগীত ও পতাকা, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অসম্মান করে, এমন কনটেন্ট প্রচার করা যাবে না। শিশুর অংশগ্রহণে যৌনাচার কোনো কনটেন্ট; সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কনটেন্ট, জঙ্গিবাদকে উৎসাহিত করে বা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে, এমন কনটেন্ট; রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন বা আদালত কর্তৃক নিষিদ্ধ কোনো কনটেন্ট এবং সংবাদ ও টক শো প্রচার করা যাবে না। এ ছাড়া অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অবনতি হয়, এমন কোনো কনটেন্টও প্রচার নিষিদ্ধ।

নীতিমালায় নিষিদ্ধঘোষিত কোনো কনটেন্ট প্রচার করলে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ তা অপসারণে নির্দেশ দেবে এবং তা পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সহায়তা করবে। কোনো কনটেন্টের বিষয়ে অভিযোগ এলে তা যাচাই করতে ওই কনটেন্ট অন্তত এক বছর সংরক্ষণ করতে হবে।

ওটিটি প্ল্যাটফর্মের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন, বিটিআরসি ও বিটিসিএলের নীতি ও মানদণ্ড অনুসরণ করা হবে।

অভিযোগের বিষয়ে

ওটিটি প্রতিষ্ঠান একজন অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তা নিয়োগ দেবে। যার সঙ্গে যোগাযোগের সব ঠিকানা প্রকাশ করতে হবে। অভিযোগের ২১ কর্মদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হলে অভিযোগকারী নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে পারবে। কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮–এর ধারা ৮ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।

মালিকানা বিষয়ক

ওটিটির মালিক হতে গেলে ন্যূনতম ১৮ বছর হতে হবে। ফৌজদারি বা নৈতিক স্খলনের কারণে দণ্ডিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, কর ও ঋণখেলাপি ওটিটির মালিক হতে পারবে না। যৌথ মালিকানায় শেয়ারের হার উল্লেখ থাকতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো কোম্পানি আইন ১৯৯৪–এর অধীনে নিবন্ধনিত হবে।

Link copied!