ওয়েব সিরিজ রিভিউ: কেমন ছিল মহানগর ২

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

এপ্রিল ২৭, ২০২৩, ০৩:৫৫ এএম

ওয়েব সিরিজ রিভিউ: কেমন ছিল মহানগর ২

আবারও ফিরে এসেছে ওসি হারুন। এবার যেন ওসি হারুন আরো সাবলীল, আরও ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করেছেন। কেনইবা নয়। মহানগর ১ শেষ যেখানে সেখান থেকেই শুরু হয়েছে মহানগর ২। অর্থাৎ সিরিজটির নতুন কিস্তি শুরুই হয় ওসি হারুনের বেসামাল অবস্থা নিয়ে। মহানগরের প্রথম কিস্তি কপ-ক্রাইম-থ্রিলার হিসেবে শুরু হলেও দ্বিতীয় কিস্তিতে এসে এই সিরিজকে কোন নির্দিষ্ট জনরাতে ফেলা যাবে না। এতে একাধারে নাটকীয়তা রয়েছে, অপরাধ রয়েছে, থ্রিল রয়েছে, পলিটিক্যাল স্যাটায়ার রয়েছে এবং এই সব কিছুর পাশাপাশি কমিক রিলিফও রয়েছে।

মহানগর সিরিজটা স্লো বার্ন ট্রিটমেন্ট এর সাথে ভালোমতো সখ্যতা গড়ে তোলে। গল্প ধীরে ধীরে  বিল্ড আপ হয়ে শেষে গিয়ে হিউজ একটা খোলাসা আর টুইস্ট।  মাঝে মধ্যে এসে গল্প মানুষকে আটকে রাখবে। এই সিজনেও নির্মাতা আশফাক নিপুণ আরও সুনিপুণভাবে এটি তৈরি করেছেন। তবে কিছু অসামঞ্জস্যও দেখা গিয়েছে।

সিরিজটা রিভিউ করার আগে দুইটা কথা জেনে রাখা ভাল।

১. রিভিউতে স্পয়লার থাকবে। তাই কেউ যদি সিরিজটি না দেখে থাকেন তাহলে আগে সিরিজটি দেখবেন।

২. এখানে কোন রাজনৈতিক কিংবা প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা নয় বরং সিরিজটির রিভিউ দেয়া হচ্ছে।

কাহিনী সংক্ষেপ

প্রথমেই আসা যাক কাহিনী সংক্ষেপ নিয়ে। ওসি হারুনকে আটক করেছে অপ্রকাশিত এক গোয়েন্দা বাহিনী। শুরু হলো তদন্ত আর সামনে আসা শুরু হলো হারুন সাহেবের অন্ধকার জগতের ইতিহাস ৷ তবে দুই বছর আগে এক বোমা হামলার কাহিনী নিয়ে এগিয়েছে এই কিস্তির গল্প। সেই সাথে মহানগর ১ এর আফনান চৌধুরীর বিষয়টিও সুরাহা করতে হচ্ছে ওসি হারুনকে। নেই কোন সেল ফোন নেই যোগাযোগ। ঠিক কিভাবে সব সুরাহা করবেন তিনি।

বাংলাদেশতো নয়ই বরং সারা বিশ্বেই ইন্টোরেগেশন বা জিজ্ঞাসাবাদের ওপর ভিত্তি করে সিনেমা কিংবা সিরিজ কম হয়েছে। তবে এই জনরার কোন মুভির কথা যদি বলতে হয় তাহলে প্রথমেই আসবে ‘দ্য ইউজাল সাসপেক্টস’র নাম। যেখানে কাইজার সোসে নামে এক সন্ত্রাসীর পরিচয় খুঁজে পেতে মরিয়া আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। আর মহানগর ২ তে মাসুম নামে এক অভিযুক্তকে নিয়েইে এগোয় কাহিনী।

ফজলুর রহমান বাবুর অভিনীত দীন মোহাম্মদ বাবরের চরিত্রটি ছিল ওসি হারুনের জন্য পারফেক্ট একটা প্রটাগোনিস্ট। তদন্তকারী কর্মকর্তা বাবরের সাথে পরিচয়ের পর থেকে বোঝা যায় তিনিও একজন দক্ষ অফিসার এবং জানেন কীভাবে আসামির কাছ থেকে তথ্য বের করতে হয়। তাকে টেক্কা দিতে ওসি হারুনও প্রস্তুত, কারণ ‘প্রতিপক্ষ প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ, হারুনকে হারানো কিন্তু সহজ নয়!’ এবার শুরু হয় তাদের মধ্যে মেন্টাল গেম।

চরিত্রে যারা ছিলেন

অভিনয়ের কথা যদি বলতে হয় তাহলে মোশাররফ করিম ও ফজলুর রহমান বাবুকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এদিকে ওসি হারুনের বন্ধু হিসেবে সুকুমার বড়ুয়ার চরিত্রে বৃন্দাবন দাস ছিলেন সাবলীল। আর মহানগর ৩ এ যে এই সুকুমার বড়ুয়া বড় ভূমিকা রাখবে তা বলাই যাচ্ছে। তবে শ্যামল মাওলার আফনান চৌধুরীর চরিত্রটা অনেকটাই নিস্প্রভ ছিল। তাকে দিয়ে আগের কিস্তির সাথে যোগসূত্র ঘটানো ছাড়া এই কিস্তিতে তার ভূমিকা তেমন নেই বললেই চলে। অন্যদের মধ্যে তানজিকা আমিন ও আফসানা মিমি তাদের চরিত্রগুলোতে যথাযথ নির্বাচন ছিল। আর এসআই মলয়ের বদলে যোগ হয়েছে এসআই দীপু। দীপু চরিত্রে সরকার রওনক রিপন খুব ভালভাবেই উতরে গেছেন। রাজনীতিবিদ রজব আলী চরিত্রে অনির্বাণের ক্যামিও প্রেডিকটেবল ছিল। পরের কিস্তিতে আরও বড় পরিসরে দেখা যাবে।

সিরিজের পজিটিভ দিক

মহানগর ১ এর সাথে যোগসূত্র থাকার পাশাপাশি ২ বছর আগের একটি ঘটনা ফ্লাশব্যাকে দেখানো হয়েছে। যার ফলে ইন্টেরোগেশন ভিত্তিক নির্মাণ হলেও দর্শকদের বিরক্ত হবার সুযোগ কম ছিল।

আর দেশে পলিটিকাল ক্রাইম থ্রিলার নেই বললেই চলে। সে তুলনায় মহানগর ১ ছিল সেরা একটি সিজন। আর সেই কিস্তিকেই ছাড়িয়ে গিয়েছে মহানগর ২।

প্রথমে ওসি হারুনের দুর্নীতির অনুসন্ধানের জিজ্ঞাসাবাদ মনে হলেও ধীরে ধীরে আসল কাহিনীতে আসতে থাকে। সেখানে ওসি হারুন ও বাবরের মধ্যে চোর পুলিশ খেলা দেখা যায়। তবে আপতদৃষ্টিতে ওসি হারুনকে অসহায় মনে হলেও তিনি সেখানের আইটি স্পেশালিস্ট উত্তম কুমারের সাহায্য নিয়ে সব ছক কষে। এদিকে উত্তম কুমার আফনান চৌধুরীর হয়ে কাজ করলেও উল্টো সবাইকেই বোকা বানায় ওসি হারুন।

এই কাহিনীর শুরু থেকে বিল্ড আপ ছিল অত্যন্ত সুনিপুণভাবে। একই সময় ধরে ওসি হারুনের ইন্টোরেগেশন ও আফনান চৌধুরীর কাহিনী চলতে থাকে।

এদিকে বাবর খুঁজে পেতে চায় ২ বছর আগের একটি ঘটনার তথাকথিত পলাতক আসামীকে। যেটি ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে এই তিনের সমন্বয় খুব ভালভাবেই করেছে পরিচালক আশফাক নিপুণ।

এবার ওয়েব সিরিজটির নেতিবাচক দিকগুলোয় আসা যাক।

সিনেমাটোগ্রাফি

মহানগর ২ কিস্তিতে সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন শেখ রাজিবুল ইসলাম। মহনগর ১ এর মতই কিছু হ্যান্ড হেল্ড, পুশ ইন শট ছিল। তবে ওসি হারুনের ক্ষেত্রেও যে পুশ ইন হ্যান্ড হেল্ড ব্যবহার করা হয়েছে অন্য চরিত্রগুলোর ক্ষেত্রেও সেগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। যে কারণে এই সিনেমাটোগ্রাফির মোটিভ নিয়ে এখনও পরিষ্কার কিছু বুঝা যায়নি।

কালার

ব্লু ও ইয়োলো কালারে সিরিজটি শ্যুট করা হয়েছে। কিন্তু ব্লু বা নীল কালারের সাথে ওসি হারুনের ড্রেস বারবার মিলে যাচ্ছিল। যেহেতু ওটিটি প্লাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে তাই মোবাইলে ভিউইং অভিজ্ঞতা খারাপ ছিল। এরই সাথে বাবর চরিত্র যখন খাকি ড্রেস পরে ছিল তখন তার ব্যাকগ্রাউন্ডে ছিল হলুদ কালার। যেটাও সমস্যা সৃষ্টি করে।

এদিকে গোয়েন্দা বাহিনীর অফিসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কাউকে আনা হলে তাকে বের হতে দেয়া হয়না। তবে ওসি হারুনের ক্ষেত্রে সেটা ব্যতিক্রম ছিল। কিন্তু বুলবুল আহমেদ নামে একজন ব্যবসায়ী কেন ঘুরঘুর করছে আর ওসি হারুনের সাথে তার এত কথা কিসের জন্য সেটা বড্ড বেখাপ্পা লেগেছে।

আর এসআই দীপুকে দেখে ওসি হারুন চিনতে পারেনি এটাও তেমন বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। এছাড়া সাংবাদিক কামরুজ্জামান কামুকে শুধু ফ্লাশব্যাকে দেখা গিয়েছে। এই চরিত্রটিকে আরও বেশি শক্তিশালী করলে হয়ত সিরিজটি ভিন্নমাত্রা পেত।

সব মিলিয়ে বলতে গেলে মহানগর ২ সিরিজটি এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে ইতিবাচক একটি সিরিজ। পরিচালনা থেকে শুরু করে অভিনয় ও প্রযোজনা সবই টপ পর্যায়ে রয়েছে।

তবে এখন কোটি টাকার প্রশ্ন ওসি হারুন কি জীবিত নাকি মৃত। মহানগর ৩ এর ঘোষণা এসেছে। এটিকি ওসি হারুনকে ছাড়াই হবে। নাকি নতুন কেউ আসবে। এসআই মলয় কি নতুন ভূমিকায় আসবে। তবে সব মিলিয়ে রজব আলী ও সুকুমার বড়ুয়া যে পরের কিস্তিতে বড় ভূমিকা রাখবে তা বলাই যায়।

মহানগর-২ এমন এক জ্বলন্ত কুপির মতো যার আগুন অল্প অল্প করে বাড়তে থাকে, সবশেষে সেই আগুন ধপ করে নিভে যাবে। আর সেই আগুন পুনরায় জ্বালানোর জন্য আশফাক নিপুণ দেয়াশলাই ধরে বসে আছেন, অপেক্ষা শুধু দাবানলের, অপেক্ষা সিজন ৩ এর।

Link copied!