আজকের গল্পটা এক দুষ্টু ছেলেকে নিয়ে। আসল নাম মাহফুজ আনাম। তিনি তার আসল নামের চেয়ে ডাক নামেই বেশি পরিচিত। বাবা ড. মোজাম্মেল হক চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। মা জাহানারা খাতুন গৃহিনী। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে পড়ালেখা করেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তবে একদা ভদ্র ছেলের তকমা পাওয়া মাহফুজ আনামের ভালোবাসার দুষ্টু ছেলে জেমস হয়ে ওঠার যাত্রা শুরু চট্টগ্রামের আজিজ বোর্ডিংয়ে।
কৈশোর পেরিয়ে টগবগে তারুণ্য যখন কলেজে তখুনি মাথায় ঢোকে গানের পোকা। পরিবারের কেউই গানের সঙ্গে যুক্ত না থাকায় গানের বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। তাই স্বপ্নের সমান বড় হতে পরিবারের বিশেষ করে বাবার সঙ্গে অভিমান করে ঘর ছাড়েন। ঘর পালানোর দলই ফ্রান্স উদ্ধার করেছিল ছিল- এর মতো করে জেমসের বেলায়ও বলা যায়, ঘর পালানো ভদ্র মাহফুজ আনাম দুষ্টু ছেলে জেমস হয়ে বাংলা গানকে উদ্ধার করেছিলেন। এটি অত্যুক্তি হলেও জেমস ভক্তদের কাছে এটি সরল বিশ্বাস।
গুমোট মুখচ্ছবির, লম্বা ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো এক বাউল তিনি। নগর বাউল। প্রথম দেখায় মনে হয়, গোমড়া মুখের এই মানুষটি হয়তো গানের বাইরে কথা বলেন না। কিন্তু বাস্তবতা বিপরীত। ছোট্টবেলায় ভীষণ বহির্মুখী বা এক্সট্রোভার্ট ছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই দুষ্টু ছেলে। এখনো তাই। তবে জীবনের নানামুখী রঙ দেখে অভ্যস্ত জেমস মুখ খোলেন সাবধানে। মুখের সাধারণ কথার চেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তায় স্বচ্ছন্ন তিনি।
১৯৮০ সালের দিকে গঠন করেন ব্যান্ড দল ‘ফিলিংস’। সেই থেকে শুরু। তারপর একে অনেক গান লিখেছেন, গেয়েছেন। তবে ভদ্র ছেলে মাহফুজ আনাম থেকে দুষ্টু ছেলে জেমসে পরিণত হওয়ার মাশুলটা অনেক বেশি চড়া মূল্যেই দিতে হয়েছে। বাবা মার স্নেহাশীষ বঞ্চিত হয়েছিলেন চিরতরে। তাই হয়তো বাবা-মাকে নিয়ে তার গাওয়া গানগুলো আলাদা করে হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
তার ‘বাবা কতোদিন দেখিনা তোমায়’ যেন তারই জীবনের ছবি এঁকে দিয়ে যায় আমাদের সামনে। সেই যে তারুণ্যের শুরুতে বাবার সঙ্গে রাগ করে বাড়ি ছেড়েছিলেন তার পর বাবার সঙ্গে তার কোনদিন দেখা হয়েছে কিনা সেই ইতিহাস ধোঁয়াটে। একসময়ের ডানপিটে, দূরন্ত দুষ্টু ছেলেটি কোনদিন জনসমক্ষে তার ব্যক্তি জীবনের ইতিহাস বলেননি। বলতে চানও না। এক্সট্রোভার্ট এক দুষ্টু ছেলে হঠাৎ করে যেন ইন্ট্রোভার্ট নগর বাউলে পরিণত হয়েছেন। তবে বাবার চাওয়া মতো ছেলে তার এখন অনেক বড় হয়েছে। কিন্তু ছেলের এই বড় হয়ে ওঠা দেখে যেতে পারেননি তার বাবা-মা কেউই। তাই হয়তো বাবার সঙ্গে অভিমান করে ঘর ছেড়ে দুঃখিনী মায়ের ব্যথা বুঝেই গেয়েছিলে, ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’। পুরো গান জুড়ে যেন মায়ের প্রতি তার অপ্রকাশিত হাহাকার ঝরে পড়েছে সুর আর স্বরে মুর্ছনায়। জেমস তার বড় হয়ে ওঠা আকাশের তারা হয়ে যাওয়া মাকে বুঝিয়ে দিতেই যেন এই গানের আয়োজন করেন।
মায়ের অন্তর্ধান যে জেমসের হৃদয়ে যে ভীষণ দাগা দিয়েছিল তা না বললেও চলে। জীবনে মায়ের অভাববোধের এই অসামান্য গান যেন জেমসের ভেতরের এক কোমল ক্ষতবিক্ষত দিককে সামনে তুলে আনে। তাই হয়তো রাতের তারার কাছে জানতে চান, তার মা কোথায় আছে। মায়ের খোঁজ না পেয়ে তারাকে অনুরোধ করেন যেন তারা তার মাকে বলে দেয়, তার ছেলে অনেক কেঁদেছে আর কাঁদতে পারছে না। মায়ের প্রতি এমন ভালোবাসা প্রকাশে ছেলে জেমস গেয়ে উঠেন,
দশ মাস দশ দিন করে গর্ভে ধারণ,
কষ্টের তীব্রতায় করেছে আমায় লালন,
হঠাৎ কোথায় না বলে হারিয়ে গেলো
জন্মান্তরের বাঁধন কোথা হারালো? – তার নাড়ি ছিঁড়ে আকাশে তারা হয়ে গিয়েছে।
জীবনে কি ব্যথা পেয়েছিলেন জেমস? যে জন্য একসময়ের দূরন্ত, ডানপিটে সারাক্ষণ আসর মাতিয়ে রাখা কেন চুপ করে গেলেন? তারই জবাব লুকিয়ে আছে জেমসের নিজের গলায় গাওয়া, ‘বাবা কতোদিন দেখি না তোমায়’, ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’, ‘মা’ এবং ‘গিটার কাঁদতে জানে’- গানগুলোতে। গিটার কাঁদতে জানে গানে জেমস বলেন,
‘ছয়টি তারে লুকিয়ে আছে
ছয় রকমের কষ্ট আমার’-
গানে জেমস তার চারটি কথা বলেন বাকী দুটো ব্যথা উহ্য রাখেন। গানটির গীতিকার লতিফুল ইসলাম শিবলী বলেন, ‘এতে মূলত একজন গিটারিস্টের ভেতরের অব্যক্ত বেদনার কথা ফুটে উঠেছে। গিটারের ছয়টি তারে একজন গিটারিস্ট তার দুঃখ, বেদনা ও যন্ত্রণার কথা বলার চেষ্টা করেন। আমি গানের কথায় সেই বিষয়টিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। যদিও গানে শুধু ৪টি কষ্টের কথা বলা হয়েছে। বাকি ২টি কষ্টের কথা গানের মধ্যে বলেননি জেমস ভাই। সম্ভবত, গান বড় হয়ে যাবে বলা হয়নি’।– জেমসের জীবনের সেই দুটো দুঃখের মতো আরো কতো দুঃখ যে আমাদের অগোচেরে রয়ে গেছে তা কেবল অন্তর্যামী এবং জেমস নিজে জানেন।
কতো ব্যথা নিয়ে গান ভালোবেসে জেমস বাবা-মায়ের স্নেহের আচল ছেড়ে এসে আজকের জেমস হয়েছেন তার পরিমাণ কেবল জেমস জানেন। জীবনের সব স্নেহাশীষের বিনিময়ে জেমস গান কিনে নিয়েছিলেন। সেই গানই এক ভদ্র মাহফুজ আনামকে ভালোবাসার দুষ্টু ছেলে জেমস, গুরু জেমসে পরিণত করেছে।
শুভ জন্মদিন জেমস।