পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। বছরপ্রতি সড়ক দুর্ঘটনার কবলে প্রাণ হারাচ্ছে পাঁচ হাজারের অধিক মানুষ। পরিসংখ্যান বলছে সড়কে অব্যবস্থাপনার কারণে নিহত এই সংখ্যার তালিকায় শিক্ষার্থীদের সংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে সোচ্চার কেবল শিক্ষার্থীরাই। শোকে কাতর হয়ে যাওয়ার বাইরে সাধারণ নাগরিকদের মাঝে এসব দুর্ঘটনা নিয়ে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি সাম্প্রতিক সময়ে৷ মাথাব্যথা নেই বিএরটিএ কর্তৃপক্ষ এমনকি নিরাপদ সড়ক আইন বাস্তবায়নে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কাছে জিম্মি সরকার নিজেই।
চলতি বছর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী ১১মাসে মোট ৪ হাজার ২৬৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ১৪৪ জন যেখানে শিক্ষার্থী রয়েছে ৭৩৭ জন।শতাংশের বিচারে এই সংখ্যা ১৪। নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা একাধিক সংগঠনের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করেও শিক্ষার্থী নিহতের এই সংখ্যা একইরকম। প্রশ্ন হচ্ছে সড়কে অনিয়ম-দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনার কারণে যে দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে তার কি কোন সমাধান নেই?
সাম্প্রতিক সময়ে নটেরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান গুলিস্থান হল মার্কেটের সামনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বেপরোয়া ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নিহত হয়। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন করতে দেখা যায়। পরবর্তীতে রাজধানীর রামপুরায় সড়ক দুর্ঘটনায় এক শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পরে আবার ফুঁসে উঠে শিক্ষার্থীরা।নিহত মাঈন উদ্দীন একরামুন্নেছা স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী।
উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী।বর্তমান সময়ে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সোহাগী সামিয়া দ্য রিপোর্টকে জানান, সড়ক দুর্ঘটনায় ভিক্টিম পরিবহন খাত সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরাও। একজন পরিবহন শ্রমিক সঠিক মজুরি পায়না, যথাযথ বিশ্রাম ও কর্মঘন্টার অভাবে ভয়ানক মানসিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মাঝে থাকতে হয় তাদের। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সকল নাগরিকের নিরাপদে বেঁচে থাকার অঙ্গিকার। আমরা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশায় নিযুক্ত দেশের সকল নাগরিকদের এই আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার আহবান জানাই। সড়কে অব্যবস্থাপনার অনিয়মের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার মাধ্যমে সকল হতাশা দূর করে একটা সফল আন্দোলনের মাধ্যমে একটা বার্তা দিতে দিতে চাই আমরা তিনি যুক্ত করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয় দীর্ঘ ২৮ বছর আগে। ১৯৯৩ সালের ১৫ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেলে সামনে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম মেডিকেলের ছাত্রী রুমানা পারভীন (২০) নিহত হয়। তিনি রিক্সাযোগে চলার সময় ঢাকা মেডিকেলের সামনে ট্রাক ধাক্কা দেয়। এসময় তিনি পড়ে গেলে ট্রাক তাকে পিষ্ঠ করে চলে যায়। তৎক্ষনাৎ নিহত হওয়ার পরেই নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। তারপর থেকে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করতে দেখা গেছে। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের পাল্লাপাল্লিতে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়৷ এরপর নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসে৷ এক পর্যায়ে সেও আন্দোলন জনসমুদ্রে পরিণত হলে সরকার বাধ্য হয় 'সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮' সংসদে আনতে যা ঐ বছরের সেপ্টেম্বর আলোর মুখ দেখে। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের চাপের মুখে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়৷ পরিবহন শ্রমিকরা আইনের ১২৬টি ধারার মধ্যে ৩৪টি ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন৷ যেখানে ২৯টি ধারা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্চা ও প্রশাসনের জবাবদিহিতার অভাবে সড়কে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা। যারা এইসকল কাজে জড়িত তারা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সরকারকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সাধারণ মানুষ নিজের পরিবারের কেউ আক্রান্ত না হলে প্রতিবাদ করছে না। এই জনসাধারণের এই নীরব ভূমিকা সেইটা রাষ্ট্রকে উৎসাহিত করছে সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন না করতে। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে অভিভাবক নাগরিকদের অংশগ্রহণ করা জরুরি নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে।
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর এতো মানুষ নিহত হচ্ছে তার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক জনপদ কর্তৃপক্ষের পরিচালক (রোড সেফটি উয়িং) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রাব্বানী বলেন, আমাদের দেশে সাধারণত যেসব (সড়ক দুর্ঘটনা) ঘটে থাকে তার মেক্সিমামই(বেশিরভাগই) বেপরোয়া ড্রাভিং,ওভারলোডিং, ওভারটেকিং এর কারণে হয়। এর পার্সেন্টেজই বেশি কিন্তু অন্যান্য কারণও আছে। মানুষ কেন ওভারস্পীডে গাড়ি চালায়, কেন অভারলোড করে এইগুলাতো সহজভাবে দেখা যায়, এর পেছনে অনেক হিডেন কারণ আছে। অনেক বিশ্লেষণ আছে এইভাবে এক কথায় বলা যাবে না। আমাদের রাস্তা ঘাটও এতো উন্নত হয়নি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নগরায়ণ ও সুশাসন-সংক্রান্ত উপকমিটির যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, পরিবহন সেক্টরে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি-চাঁদাবাজি বিদ্যমান। এই চাঁদাবাজির সাথে সবাই জড়িত,পুলিশ প্রশাসন এবং বিশেষ শ্রমিক নেতা। পরিবহন মালিক সমিতির কাছে সরকার জিম্মি। সাধারণ নাগরিকরা হতাশ, প্রতিবাদ করতে করতে ক্লান্ত। তারা জানে আন্দোলন প্রতিবাদ করে কিছু হয় না। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে কারণ তারা জানে এই দেশটা তাদের। তাদের নিরাপদ চলাচলের নিশ্চয়তা তাদের হাতে।