ঈদে রেকর্ড জামদানির অর্ডার, ৪০ কোটি টাকার লেনদেন

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

এপ্রিল ১৮, ২০২৩, ১২:০৫ এএম

ঈদে রেকর্ড জামদানির অর্ডার, ৪০ কোটি টাকার লেনদেন

‘১৯৮৮ সাল থেকে ব্যবসা করতেছি এবারের ঈদের মত অর্ডার আর কখনও পাইনি। ব্যবসা যা করার নিজ উদ্যোগে করছি। কোন সরকারি প্রতিষ্ঠান বা বড় কোম্পানি আমাদের বলার মত কোন সাহায্য করেনি।’

দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের কাছে এভাবেই ক্ষোভ জানালেন বিল্লাল জামদানি হাউসের কর্ণাধার বিল্লাল হোসেন। বর্তমানে তার ১৮ টি তাঁতে শাড়ি বোনার কাজ চলছে। ঈদের আগেই সবগুলো সরবারহ করতে হবে। তাই দম ফেলার ফুসরত নেই কারিগর ও সহকারিদের।

আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ব্যস্ত সময় পার করছেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের জামদানি পল্লীর কারিগর ও ব্যবসায়ীরা। মিহি জমিনে সূক্ষ্ম নকশাদার কাজ দিয়ে তৈরি ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ির কদর দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও রয়েছে। জামদানি শাড়ির এই চাহিদাকে মাথায় রেখে কারিগররা নানা রঙের নজরকাড়া ডিজাইনের শাড়ি তৈরি করছেন। তবে পল্লীতে এসে জামদানি কেনার প্রবণতা কম তারচেয়ে বরং অর্ডার দিয়ে শাড়ি বানানোর প্রবণতা বেশি।

একটি শাড়ি ২ লাখ টাকা

পল্লীতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন কারিগর আল-আমিন। প্রায় দুইমাস ধরে তিনি শাড়ি বোনার কাজ করছেন। ক্রেতার অর্ডারে এই শাড়িটির দাম ৬২ হাজার টাকা। দুইমাসের কাজ শেষে তিনি পাবেন ৩০ হাজার টাকা। আর তার সহকারি পাবেন ১৬ হাজার টাকা, বাকিটা মালিকের। বর্তমানে অর্ডারকৃত শাড়ির চাহিদা বেশি।

আল- আমিন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, বর্তমানে অনেক ক্রেতারা শাড়ি কিনে ঠকছেন। তাই সরাসরি অর্ডার করে কিনছে। আর জামদানি শাড়ি নিয়মিত কিনেনা সবাই। তাই একটু বেশি দাম দিয়েই ভাল মানের জামদানি বানাচ্ছেন তারা।

এদিকে মাত্রই ২ লাখ টাকার শাড়ির বোনার কাজ শেষ করেছেন জসিম উদ্দিন নামে এক কারিগর। এই শাড়ি বুনতে তার সময় লেগেছে তিনমাসেরও বেশি।

জসিম উদ্দিন বলেন, যত বেশি দাম তত জটিল নকশা। এজন্য এগুলো বানাতে অনেক সময় লাগে। যার ফলে এই শাড়িগুলো বানাতে নিজের একটা মৌসুমই চলে যায়।

রূপগঞ্জের তারাব পৌরসভার নোয়াপাড়া গ্রামে জামদানি শাড়ির উৎপত্তিস্থল বলে দাবি করেন স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা। তবে এখন জামদানি তৈরির কারখানা জেলার অন্যান্য উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁতশিল্পীরা বর্তমানে জামদানি শাড়ির পাশাপাশি সালোয়ার কামিজসহ ছেলেদের জন্য পাঞ্জাবি তৈরি করছেন।

জামদানি তৈরিতে ব্যস্ত তাঁতশিল্পীরা

ব্যবসায়ী ও জামদানি তৈরির কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি জামদানি শাড়ি দুই হাজার টাকা থেকে শুরু করে দুই লাখ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। নজরকাড়া ডিজাইন ও সুতার কাউন্টের ওপর ভিত্তি করে শাড়ির দাম কম-বেশি হয়ে থাকে। যে কাপড়ের সুতার কাউন্ট যত বেশি দামও তত বেশি। সুতার এই কাউন্টের ওপর শাড়ি বোনার সময় নির্ভর করে। বিভিন্ন ধরণের জামদানি শাড়ির মধ্যে রয়েছে– ময়ূরপ্যাঁচপাড়, বাঘনলি, কলমিলতা, চন্দপাড়, ঝুমকাণ্ড, তেরছা, জলপাড়, পান্নাহাজার, করোলা, দুবলাজাল, সাবুরগা, বলিহার, শাপলাফুল, আঙ্গুরলতা ইত্যাদি।

জামদানি পল্লীর সোহাগ জামদানি হাউজের মালিক নজরুল ইসলাম বলেন, প্রত্যেক ঈদ মৌসুমে প্রায় ৪০- ৫০ লাখ টাকার শাড়ি অনায়াসে বিক্রি হয়ে থাকে। তবে এবার ঈদে এখনও আশানুরূপ ব্যবসা জমে ওঠেনি। তবে ঈদের আরও বেশ কিছুদিন বাকি আছে। ঈদের আগে বিক্রি বাড়বে, সেই প্রত্যাশায় রয়েছি।

রূপগঞ্জের জামদানি বিসিক শিল্প নগরীর কর্মকর্তা বায়েজিদ হাসেন বলেন, করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে এ বছর আমাদের ব্যবসা কয়েকগুণ বেড়েছে। আসন্ন ঈদকে কেন্দ্র করে কারিগররা ব্যস্ত সময় পার করছেন। এই ঈদে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকার বেচাকেনা হবে জামদানি পল্লিতে। প্রতি বছর প্রায় ২০০ কোটি টাকার বেচাকেনা হয় এই পল্লিতে।

জামদানি পল্লিতে ৪০৭টি প্লট রয়েছে। বর্তমানে জামদানি পল্লিতে প্রায় ৩ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ তাঁতশিল্পী কাজ করছেন। তারা জামদানি শাড়ি তৈরির পাশাপাশি পাঞ্জাবি, থ্রি-পিস ও টু-পিস তৈরি করছেন। উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকের কাছে এই জামদানি শাড়ির চাহিদা বেশি।

দাম বেড়েছে সুতার

নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী জানান, জামদানির সুতার দাম বেড়েছে ৫ গুণ। যেখানে এক রিল সুতা ৬ টাকা ছিল সেটি ৩০ টাকা হয়েছে। একটা শাড়িতে গড়ে ৩ হাজার টাকার সুতা প্রয়োজন। আর দামি শাড়িতে ৭ হাজার টাকার সুতা লাগছে। সব মিলিয়ে এই বিষয়ে নিয়ন্ত্রণে নেই।

এদিকে বিসিকের ই সেন্টারের সুফল পাচ্ছেননা তারা। ব্যবসায়ীরা জানান, ই সেন্টারের কথা বললেও এখনও কোন পণ্য বিক্রি করতে পারেননি তারা।

এদিকে বিসিক কর্তৃপক্ষ জানায়, ই সেন্টার ঈদের পরপর চালু হবে। তখন ক্রেতারা সরাসরি পল্লী থেকে অনলাইনে জামদানি ক্রয় করতে পারবে।

ভাল নেই কারিগররা

সাধারণত জামদানি পল্লীতে ৫০-২৫-২৫ নিয়ম মেনে শাড়ি বোনা হয়। অর্থাৎ শাড়ি বিক্রি মূল্যের ৫০ শতাংশ অর্থাৎ অর্ধেক পাবে কারিগর। বাকি ২৫ শতাংশ পাবে হেলপার। আর বাকিটুকু মালিক। তবে সুতাসহ যা যা খরচ রয়েছে সবই মালিকের বহন করতে হয়।

বিল্লাল জামদানি হাউসের কর্ণাধার বিল্লাল হোসেন। ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

একটা ৬০ হাজার টাকা মূল্যের শাড়ি বুনতে ২ মাস লেগে যায়। সে হিসেবে একজন কারিগর মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। টাকার প্রয়োজনে এখানেও রয়েছে দাদন ব্যবস্থা।

এদিকে পল্লীতে ক্রেতার সংখ্যা কম। কেননা এখনকার মালিকরা অনেকেই নিজ উদ্যোগে অনলাইন শাড়ি বিক্রি করে থাকেন।

এদিকে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জামদানি শাড়ি কিনতে পল্লিতে ভিড় করছেন ক্রেতারা। নারায়নগঞ্জ থেকে শাড়ি কিনতে এসেছেন ইশরাত জাহান। তিনি বলেন, আমার অর্ডারকৃত দুটো শাড়ি ছিল। তবে এখনে এসে পরে বিভিন্ন দোকান থেকে আরও ৪ টি শাড়ি কিনলাম। করোনার কারনে এতদিন কেনা হয়নি। তাই এবারের ঈদে এই আয়োজন।

Link copied!