বেটা
ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৪, ০৪:১১ পিএম
অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ। ফাইল ছবি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে এবার যৌন হয়রানি ও মানসিক নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছেন রাজধানীর একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক নারী শিক্ষার্থী, যেখানে তিনি অতিথি শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিতে যেতেন বলে জানা যায়।
এ ব্যাপারে বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদুর রহমান বরাবর মেইলের মাধ্যমে একটি অভিযোগপত্র দিয়েছেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিউপি) ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী। পরে সকাল ১১টায় ঐ শিক্ষার্থীর একজন প্রতিনিধি প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগের হার্ডকপি দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: ঢাবি অধ্যাপকের বিরুদ্ধে এবার যৌন নিপীড়নের অভিযোগ
অভিযোগ গ্রহণ শেষে ঢাবি প্রক্টর বলেন, ‘অভিযোগ পত্র ই-মেইলেও পেয়েছি, হার্ড কপিও পেয়েছি। ইতিমধ্যেই অভিযোগপত্র আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
উক্ত অভিযোগপত্রে ড. নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীর অন্তরঙ্গ দৃশ্য দেখে ‘ধর না আমরাও এমন করছি’ ধরনের যৌন উত্তেজনামূলক কথা বলার অভিযোগ দিয়েছেন উক্ত নারী শিক্ষার্থী।
অভিযোগ পত্রের বিষয়টি নিশ্চিত করে অধ্যাপক মাকসুদুর রহমান বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের একজন নারী শিক্ষার্থীর কাছ থেকে অধ্যাপক ড. নাদির জুনায়েদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ এসেছে। এই সংক্রান্ত অভিযোগগুলো মূলত উপাচার্য বরাবর দেওয়া হয় এবং প্রক্টরের কাছেও অনুলিপি পাঠানো হয়। আমি সেই অনুলিপি হাতে পেয়েছি।
উক্ত অভিযোগপত্রে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী উল্লেখ করেন, আমি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছি, সেখানে অধ্যাপক নাদির জুনাইদ একটি কোর্স পড়াতেন। গেস্ট টিচার হিসেবে আমাদের বিভাগে এসেছিলেন। আমি ক্লাসের সিআর হওয়ার সুবাদে আমাকে তার সঙ্গে এক ধরনের যোগাযোগ রাখতে হতো। প্রথমত উনি নিয়মিত আমাকে ফোন দিতেন। বাসায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিতেন। কিন্তু সমস্যা হলো, উনি ব্যক্তিগত অনেক তথ্য জিজ্ঞেস করতেন। আমাকে এমনও জিজ্ঞেস করেছেন, আমার বয়ফ্রেন্ড আছে কি না। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল, ওনার পড়াশোনার কাজের থেকে বেশি আগ্রহ ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। এসব নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে চাইতেন।
আরও পড়ুন: ঢাবির সাংবাদিকতা বিভাগে ফলাফলে ধস; আত্মপক্ষ সমর্থনে যা বললেন অভিযুক্ত অধ্যাপক
সাধারণত উনি রাত ১০টা বা ১২টার দিকে ফোন দিতেন। উনি আমাকে যখন এইভাবে ফোন বা ভিডিও কল দিতেন, আমি খুবই বিব্রত হতাম। আমি প্রায় ওনার ফোন না ধরার চেষ্টা করতাম, কিন্তু সেটার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পরবর্তী ক্লাসে দেখা যেত। ফোন না ধরায় আমাকে ক্লাসে নানাভাবে হেনস্তা করতে চাইতেন। ক্লাসে এভাবে হেনস্তার শিকার হওয়ার পরও উনি আবারও আমার সাথে যোগাযোগ করতেন।
উক্ত শিক্ষার্থী আরও বলেন, ক্লাসে এবং ক্লাসের বাইরে নাদির জুনাইদের মুখ ও মুখোশ ছিল আলাদা। উনি ক্লাসে হেনস্তা করার পরে আবার দুঃখপ্রকাশ করে আমাকে মেসেজ দিতেন, ফোন দিতেন। পরে অনেকটা বাধ্য হয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে ওনার ফোন এবং ভিডিও কল রিসিভ করতাম। তখন ভিডিও কলে বলতেন, একটু তোমার চেহারাটা দেখি, তোমার চুলটা একটু দেখি, তোমার জুম পিক দেখি। আমার কয়েকবার মনে হয়েছে তখন উনি হস্তমৈথুন করেন।
উনি সবসময় চাইতেন, তাকে সব আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখি। ‘উনি অনেক হ্যান্ডসাম’- এটা উনি বারবার শুনতে চাইতেন। উনি এত সুদর্শন, এত তরুণ, ওনাকে দেখে আমরা কেন আকর্ষিত বোধ কেন করছি না- এরকম বিষয় নিয়ে প্রায়ই খোঁচা দিতেন। প্রায়ই মেসেঞ্জারে/ওয়াটসআপে ওনার ভিডিও বা ছবি পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, ‘আমি দেখতে কেমন’। পরে বুঝেছি, এর সবই ছিল ওনার ফাঁদপাতার কৌশল।
অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে অশ্লীল কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টার অভিযোগ তুলে এই শিক্ষার্থী বলেন, উনি আমাকে শারীরিক স্পর্শ বা সেরকম কিছু করেননি। কিন্তু বিয়ের কথা বলে আমার সঙ্গে দীর্ঘদিন কথোপকথন চালিয়ে গেছেন। উনি প্রায় অশ্লীল কথাবার্তা বলতেন। নানা রকম যৌন উত্তেজনামূলক কথা আমার সঙ্গে বলতে চাইতেন। সবসময় অন্তরঙ্গ কথা বলার প্রতি ওনার বিশেষ আগ্রহ থাকত।
আমার শরীরের স্পর্শকাতর জায়গা নিয়ে তিনি আমাকে প্রশ্ন করতেন। আমার পোশাক নিয়েও অযাচিত মন্তব্য করতেন। বলতেন, আমি কেন ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরি না। কেন বাংলাদেশের মেয়েদের পোশাক এত বাজে? নানারকম অশ্লীল কথাবার্তা তিনি গল্প আকারে বলতেন। যেমন কোন সিনেমায় নায়ক নায়িকা কীভাবে অন্তরঙ্গ হলো, নায়ক নায়িকার সঙ্গে কী কী করল, এসব উনি খুব আগ্রহ নিয়ে আমাকে শোনাতেন এবং নানাভাবে বোঝাতেন যে উনি এইসব করতে চান। আমাকে বলতেন, মনে করো আমরাও এমন করছি।
অধ্যাপক নাদির জুনাইদ অন্য নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে এমন কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছেন উল্লেখ করে অভিযোগকারী বলেন, আমার ক্লাসের আরেকটা মেয়ের সঙ্গেও এমন করেছেন উনি। ওই মেয়েকেও উনি বিয়ের প্রলোভন দেখিয়েছেন। ছয় মাসের জন্য পড়াতে গিয়ে একই ক্লাসের দুজন মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছেন, এটাকে স্বাভাবিক মনে করার কোনো কারণ নেই। আমাকে ‘গোয়েন্দা’র মতো ব্যবহার করে অন্য মেয়েদের খোঁজ নিতেন উনি। উনি প্রায়ই ফোন করে জিজ্ঞেস করতেন, ক্লাসের কোন মেয়ের কার সঙ্গে প্রেম চলতেছে এসব নিয়ে নাদির জুনাইদের প্রচুর আগ্রহ ছিল।
আরও পড়ুন: এবার মৌখিক যৌন হয়রানি ধামাচাপা দেয়ার অভিযোগ উঠলো অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে
এ প্রসঙ্গে অভিযুক্ত অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদকে একাধিকবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, গত ১০ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ এনে প্রক্টরের কাছে লিখিত দেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থী। যদিও তিনি (নাদির জুনাইদ) এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
অপরদিকে, অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হয়রানির অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচারের দাবিতে ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ করেন বিভাগের সকল শিক্ষার্থী। পাশাপাশি নাদির জুনাইদের বিভাগীয় অফিস কক্ষে তালা দেওয়া ও শ্রেণিকক্ষের তালায় সিলগালা করে দেন শিক্ষার্থীরা এবং দরজায় ‘যৌন নিপীড়ক অধ্যাপক নাদির জুনাইদ ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত’ সংবলিত পোস্টার ঝুলিয়ে দেন। এ ছাড়া, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপিও দেন।
পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে অধ্যাপক নাদির জুনাইদকে তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ছুটির চিঠিতে বলা হয়, অভিযোগের যথাযথ অনুসন্ধান ও তদন্ত করার জন্য বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় উপস্থাপন করা হবে এবং সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন: যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত ঢাবি অধ্যাপককে তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি
এরপর শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের জন্য তাদের একাডেমিক কার্যক্রমে কোনো প্রভাব পড়বে না এমন লিখিত নিরাপত্তার আশ্বাস চাইলে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে বিভাগের একাডেমিক কমিটির বৈঠক শেষে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক নিরাপত্তা দেওয়া হবে এমন একটি বিবৃতি প্রদান করেন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল মনসুর আহমাদ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে রুটিন অনুযায়ী ক্লাসে ফেরার ঘোষণা দেন এবং ১০ দিনের মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু না হলে আবারও ক্লাস বর্জনসহ কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন তারা।
