জুন ৮, ২০২৫, ০১:৪২ পিএম
বিশ্বাস, দৃঢ়তা ও ঐতিহাসিক দায়িত্ববোধের এক অনন্য উদাহরণ গড়েছেন স্পেনের তিন মুসলিম হজযাত্রী।
তাঁরা ঘোড়ায় চড়ে প্রায় ৮,০০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ১০টি দেশ অতিক্রম করে সৌদি আরবের মক্কায় পৌঁছেছেন—যে রুটটি শেষবার ব্যবহার হয়েছিল ৫০০ বছরেরও বেশি আগে।
আব্দেলকাদের হারকাসি আইদি, তারেক রদ্রিগেজ ও আবদাল্লাহ রাফায়েল হার্নান্দেজ মানচা নামের এই তিনজন গত অক্টোবরে দক্ষিণ স্পেন থেকে যাত্রা শুরু করেন।
পথে তাঁরা ফ্রান্স, ইতালি, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া, সার্বিয়া, বুলগেরিয়া, তুরস্ক, সিরিয়া ও জর্দান হয়ে মে মাসে সৌদি আরবে প্রবেশ করেন—ঠিক হজ মৌসুমের আগমুহূর্তে।
তাঁদের জন্য এ যাত্রা কেবল শারীরিক পরিশ্রম নয়, বরং ছিল এক গভীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা। ১৪৯১ সালের পর এই পথে আর কেউ হজে যাননি বলে দাবি তাঁদের। গন্তব্য ছিল মসজিদুল হারামের কাবা শরিফ, যা মুসলমানদের কাছে সর্বোচ্চ পবিত্র স্থান।
আরাফাত থেকে আবেগময় কণ্ঠে হারকাসি বলেন, “আমরা এত হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছি এবং আল্লাহ আমাদের প্রার্থনায় সাড়া দিয়েছেন। আমরা কাবার সামনে দাঁড়াতে পেরেছি, স্পর্শ করতে পেরেছি। তখন এই ৮,০০০ কিলোমিটার পথ কিছুই মনে হয়নি।”
ইতিহাস ও কষ্টের সহযাত্রা
মাসের পর মাস ধরে চলা এই যাত্রায় তাঁরা প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ও ইসলামের ঐতিহাসিক স্থাপনার সাক্ষাৎ পেয়েছেন।
সিরিয়ায় তাঁরা আলেপ্পোর প্রাচীন দুর্গ ও উমাইয়া মসজিদের মতো নিদর্শন ঘুরে দেখেন। পথে তাঁরা এক পুরোনো অটোমান রেললাইন অনুসরণ করেন, যা এক সময় ইস্তানবুল থেকে সৌদি আরব পর্যন্ত সংযুক্ত ছিল।
তবে সবই ছিল না সহজ। বসনিয়ায় তাঁদের ঘোড়াগুলো হারিয়ে যায়, পরে জানা যায়, ঘোড়াগুলো একটি পুরোনো ল্যান্ডমাইন এলাকায় ঢুকে পড়েছে। কেউ উদ্ধার করতে সাহস পাননি, কিন্তু অলৌকিকভাবে ঘোড়াগুলো নিরাপদে ফিরে আসে।
যান্ত্রিক সমস্যা, বৈরী আবহাওয়া এবং দৈনিক পরিশ্রম ছিল নিত্যসঙ্গী। কিন্তু বিশ্বাস ও লক্ষ্য তাঁদের এগিয়ে নিয়ে যায়।
মানবতা ও উম্মাহর শক্তি
তবে সব চেয়ে বড় শিক্ষা ছিল মানুষের আন্তরিকতা ও সহানুভূতি। হারকাসি বলেন, “যখন আমাদের কিছুই ছিল না, তখন মানুষ ঘোড়ার দেখাশোনা করেছে, খাবার দিয়েছে, টাকা দিয়েছে। এমনকি আমাদের সহায়তাকারী গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে তার মেরামতও করে দিয়েছে। মানুষ ছিল অবিশ্বাস্যরকম উদার।”
এই অভিজ্ঞতা তাঁদের মুসলিম উম্মাহর একতাবদ্ধতার বাস্তব রূপ উপলব্ধি করিয়েছে। “আমি বিশ্বাস করি, এটি প্রমাণ করে মুসলমানরা একতাবদ্ধ—যে উম্মাহর স্বপ্ন আমরা দেখি, তা বাস্তব।”
আজ যখন তাঁরা লাখো হজযাত্রীর সঙ্গে মক্কায় অবস্থান করছেন, তাঁদের সঙ্গে রয়েছে দীর্ঘ পথের ধুলো, শত সংগ্রামের স্মৃতি এবং এক অসাধারণ গল্প—যা সময় ও সীমানা ছাড়িয়ে একতা, ইতিহাস ও সাহসিকতার বার্তা পৌঁছে দেয়।