ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেটে এগিয়ে বাংলাদেশ। অর্জনও এই ক্রিকেট খেলায় বেশি। ফুটবলের দৌঁড় সাফ পর্যন্ত। কিন্তু ক্রিকেটের দৌঁড় খেলাটির সর্বোচ্চ চূড়া বিশ্বকাপেও! সে হিসেবে ফুটবল নয়, ক্রিকেট নিয়েই এ জাতির উন্মাদনাটা থাকার কথা ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি! উন্মাদনায় ফুটবলের ধারেকাছেও নেই ক্রিকেট।
ফিফার আয়োজনে কাতার বিশ্বকাপের খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আর তা নিয়ে দেশে উন্মাদনাও চলছে। এরইমধ্যে ফুটবল উন্মাদনায় প্রাণ দিয়ে তাঁর খেসারত দিয়েছেন ১২ জন। সংখ্যাটা আরও বেশি হবে হয়তো, কারণ অনেক খবরই মিডিয়ায় আসে না। তবে কিছুটা রক্ষা পাওয়া গেছে দেশের প্রধান দুই সমর্থকগোষ্ঠীর পছন্দের একটি দল আগেভাগেই হেরে বিদায় নিয়েছে বলে। দুটি দলই যদি খেলায় টিকে থাকতো আর তাঁরা পরস্পর মুখোমুখি হতো, ভয়ানক সব কাণ্ড যে ঘটতো, তা নিশ্চিত।
সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর থেকে যে টুকু জানা যাচ্ছে, সারাদেশে ফুটবল নিয়ে তর্ক-বিতর্কের জের ধরে সংঘর্ষে, পতাকা টানাতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে কিংবা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, খেলা দেখার সময় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে এরইমধ্যে ওই ১২ জন মারা গেছেন। ভয়ংকর তথ্য হলো, এঁদের বেশিরভাগই আবার কিশোর ও তরুণ। নিহত ও মৃতের পাশাপাশি আহতও হয়েছেন পঞ্চাশের কাছাকাছি। এই ফুটবল উন্মাদনায় জড়িত মূলতঃ দুটি দলের উগ্র সমর্থকরা। দল দুটি হল লাতিনের দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা।
প্রতিবার বিশ্বকাপ এলে দেশজুড়ে চলে ফুটবল নিয়ে তুমুল মাতামাতি। তাঁর কেন্দ্রে থাকে দুই পরাশক্তি এই ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। তৃতীয় শক্তি কখনো জার্মানি তো, কখনো পর্তুগাল, স্পেন, ইতালি, বেলজিয়াম বা ফ্রান্স। তবে এদের সমর্থক খুবই কম। এই সমর্থকদের মধ্যে দেশের কৃষক থেকে কর্মকর্তা, শিক্ষক থেকে সাহিত্যিক, সাংবাদিক থেকে সচিব, অভিনয় শিল্পী থেকে কণ্ঠশিল্পী— কেউ বাদ যান না ফুটবল রোমাঞ্চের স্বাদ নিতে। বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনা-রোমাঞ্চে যুক্ত হন প্রায় সবাই। এই উন্মাদনাটা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। সোশ্যাল মিডিয়ার আগমনের আগে এ রকম মারদাঙ্গা সমর্থক ছিল না এ দেশে।
শোনা যায়, বাংলাদেশে ফুটবল নিয়ে যে মাতামাতি, বিশেষ করে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল নিয়ে— এমন উন্মাদনা নাকি খোদ ওই দুটি দেশেও চলে না। এ দেশের মানুষ ভালোবেসে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকা টাঙায়। কেউ কেউ তো জমি বেঁচে পছন্দের দলের পতাকা কেনে! কেউ পাঁচ কিলোমিটার লম্বা পতাকা বানালে অন্যরা বানায় ছয় কিলোমিটার! কেউ পছন্দের টিমের পতাকার রঙে রিকসা রাঙায় তো, কেউ গোটা বাড়িই রাঙায় মহাউৎসাহে। কেউ প্রিয় দল হারলে বৈরাগ্যব্রত নেয়। বিপরীতে প্রিয় দল জিতলে কেউবা বিয়েও করে। স্বামী-স্ত্রী দুই বিপরীত দলের সমর্থক হলে সে সংসারে শনি রাহু ভর করতেও দেখা যায়!
সমর্থনের নেশায় কেউ কেউ তাঁদের পুরো একটা বহুতল বাড়িকেই বানিয়ে ফেলে ব্রাজিলের পতাকা। আবার কেউ কেউ প্রিয় ফুটবলারের নামে স্লোগান দিয়ে মিছিল বের করে। ফুটবল এখানে এমনই এক উন্মাদনা নিয়ে হাজির হয় প্রতিটি বিশ্বকাপে। এ উন্মাদনার ঢেউ শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, এই ঢেউ গিয়ে আছড়ে পড়ছে বিশ্বকাপ আসরের ভেন্যুগুলোতে। সেই ঢেউ গুনতে কখনো কখনো চলে আসছেন আবার ওইসব দেশের দূতাবাস কর্তারাও। তৈরি হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় ভালবাসার বন্ধনও!
গত বিশ্বকাপে ঢাকার জার্মান দূতাবাসের কর্তারা গিয়েছিলেন মাগুরার এক ফুটবলফ্যানের বাড়িতে, যিনি কিনা পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘের জার্মানির পতাকা বানিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন। এরকম আরও শতসহস্র ঘটনার জন্ম হচ্ছে এ দেশে। চলতি বিশ্বকাপেও এসব ঘটনার পূণরাবৃত্তি ঘটছে। ভালোবাসা অন্ধ হয়। সেই ফুটবল ভালবাসায় অন্ধত্বের র্যাংকিং করলে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা নয়, বাংলাদেশই হবে হয়তো পৃথিবীর এক নম্বর দেশ!
১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল উরুগুয়েতে আয়োজিত হলেও বাঙালির সাথে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রেম হয় আরো পরে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনায় আয়োজিত বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচ সম্প্রচার করার কারণে বাংলাদেশের প্রান্তিক এলাকাতেও সীমিত পরিসরে হলেও ফুটবল পৌঁছে যায়। এরপর ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের সব ম্যাচ সম্প্রচার হলে পরে এদেশের বাঙালিদের হৃদয়ে বাসা বাঁধে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রেম। ধীরে ধীরে সেই প্রেম এক পর্যায়ে পাগলামি বা উন্মাদনায় রূপ নেয়।
এই যে বাঙালির ফুটবল-উন্মাদনা, তা সত্বেও আমাদের নিজেদের ফুটবলের এতো করুণ অবস্থা কেন? ঘুরেফিরে এই প্রশ্নটি উঠে প্রতিবার বিশ্বকাপ এলে। যেখানে ৪০ লাখ জনসংখ্যার ক্রোয়েশিয়া দাপটের সাথে বিশ্বকাপ খেলে শিরোপা জিততে চায়, মাত্র ৩ লাখ মানুষের দেশ আইসল্যান্ড ইউরোপের উঠতি ফুটবল শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পায়; সেখানে প্রায় ১৭ কোটি ফুটবলপ্রেমী মানুষের বাংলাদেশে ফুটবলের কেন এই দৈন্যদশা? সে প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক।
আমরা আগে অন্তত সাফ ফুটবলে শীর্ষ অবস্থানে ছিলাম, সেখান থেকে নামতে নামতে নামতে এতো নিচে এসে ঠেকলাম কেন? কেন আজ দক্ষিণ এশিয়ায় মালদ্বীপ, ভুটান, শ্রীলংকা, নেপালের মতো দেশগুলোও আমাদের ছাড়িয়ে গেলো? কেন আমরা আজ ফিফা র্যাংকিংয়ে একেবারে দুইশর কাছে এসে দাঁড়ালাম? অতীত ইতিহাস তো এ রকম ছিল না। আমাদের ফুটবল ইতিহাস তো সোনালী যুগের ইতিহা
শুধু উন্মাদনার র্যাংকিংয়ে এক নম্বর হলে তো চলবে না। কেন আমরা ফুটবলে আগাতে পারছি না, তাঁর জবাব আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। যদি সেসব জবাব আমরা বের করে আনতে পারি, তবেই সমস্যাগুলোর সমাধান মিলবে। এগিয়ে যাবে এদেশের ফুটবল। আর তখনই স্বার্থক হবে আমাদের ফুটবল উন্মাদনার। নাহলে বিদেশী টিমগুলোকে সমর্থন জানানোর নামে নিজেদের মধ্যে শুধু মন কষাকষি আর হানাহানিই হবে, কল্যাণ মিলবে না সেই ভালবাসা থেকে।
লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট