বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আনন্দমঠ-এর প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘বাঙ্গালীর স্ত্রী অনেক অবস্থাতেই বাঙ্গালীর প্রধান সহায়। অনেক সময় নয়।’ সন্দেহ নেই, বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালি জীবন অনুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করে উপলব্ধ সত্য উচ্চারণ করেছেন, যার সঙ্গে দ্বিমত করা বাল-চাপল্য হবে। একজন বঙ্গবন্ধু বাঙালি পুরুষ হিসেবে স্ত্রীর সাহচর্য পেয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী, তার রেণু, আমাদের বঙ্গমাতা, তাঁর জীবনে সহায় হয়েছিলেন কী না তা বঙ্গবন্ধুর স্বীকারোক্তিতেই আছে। ১৯৭২-এর ২৬ মার্চ আজিমপুর গার্লস স্কুলে দেয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন
‘আমি আমার জীবনে দেখেছি আমি বুলেটের সামনে এগিয়ে গেলেও আমার স্ত্রী কোনদিন বাধা দেননি। আমি দেখেছি ১০/১১ বছর জেলখানায় থাকলেও তিনি কোনদিন মুখ খুলে প্রতিবাদ করেননি। যদি তিনি তা করতেন তাহলে আমি জীবনে অনেক বাধার মুখোমুখি হতাম। এমন অনেক সময় ছিল যখন আমি জেলে যাবার সময় আমার সন্তানদের জন্য একটি পয়সাও রেখে যেতে পারিনি। আমার নিরন্তর সংগ্রামী জীবনে তার প্রচুর অবদান আছে।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনে স্ত্রীকে শুধু সহধর্মিনী নয়, একজন সহযোদ্ধা-সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন। এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, একজন শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু-বিশ্ববন্ধু হতে পেরেছিলেন তাঁর স্ত্রীর প্রণোদনায়; অবশ্য স্বীকার্য যে, এতে তাঁর নিজস্ব মেধা-মনন ও উদ্যম-উদ্যোগও ক্রিয়াশীল ছিল। তবে দু’জনের মধ্যে ব্যাপারটি ছিল যেন সোনায় সোহাগা-একে অপরের সম্পূরক/পরিপূরক। ড. নীলিমা ইব্রাহিমের মূল্যায়নে, ‘নিরহংকার দীপ্তিময়ী মুজিবপত্নী... আমাদেরই মতো একেবারে সাধারণ। এই তো যোগ্য অগ্নিপুরুষের সহধর্মিনী।’
ব্যাপারটি শিষ্য তরুণ শেখ মুজিবের রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নজরে পড়েছিল। ১৯৪৬-এ বিহারে দাঙ্গা উপদ্রুত অঞ্চলে তিনি শেখ মুজিবকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পাঠাতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তার আগে টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে অসুস্থ স্ত্রীর অনুমতি নিতে বলেছিলেন। স্ত্রী রেণু চিঠি লিখেছিলেন, যাতে তার নির্দ্বিধ সম্মতি ছিল। চিঠির ভাষা প্রণিধানযোগ্য: ‘আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিত মনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লার উপর আমার ভার ছেড়ে দেন। ’
এ চিঠির মর্মার্থ অবহিত হবার পর সোহরাওয়ার্দী মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘মুজিব, সে তোমার জন্য শ্রষ্টার দেয়া অতি অমূল্য দান। অনুগ্রহ করে তাকে অবহেলা করো না।’ মুজিব কোনদিন রেণুকে অবহেলা/উপেক্ষা করেননি; এমন মানসিকতা তাঁর ছিল না, বা তার সুযোগও তিনি পাননি।
এমন একটি প্রেক্ষাপটে কিছুটা যেন বাস্তবধর্মী আবেগ নিয়ে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী দু’জনের আন্ত:সম্পর্ক মূল্যায়ন করেছেন বস্তুনিষ্ঠভাবে। অনেকেই জানেন শেখ মুজিব ছিলেন আপসহীন নেতা। বজ্রকঠিন ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। কিন্তু অনেকেই জানেন না, এই বজ্রের চৌদ্দআনা বারুদই ছিলেন বেগম মুজিব। তাঁর সমর্থন, সাহায্য ও ষোলআনা একাত্মতা ছাড়া শেখ মুজিব আপসহীন নেতা হতে পারতেন না। বঙ্গবন্ধু হতে পারতেন না। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এই নেতৃত্বকে সাহস, শক্তি এবং সকল দুঃখ ও নির্যাতন বরণের ধৈর্য ও প্রেরণা জুগিয়েছেন এই নারী।
বিয়ে ও পারিবারিক জীবন
অসাধারণ দম্পতি মুজিব-রেণুর দাম্পত্যজীবনের শুরুটাও ছিল অসাধারণ ও ব্যতিক্রমী। পারিবারিক প্রয়োজনে ও সামাজিক বাস্তবতায় তাঁদের বাল্যবিয়ে হয়েছিল, যাতে বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষায় ‘অনেকে আশ্চর্য হবেন।’ বিয়েটা কীভাবে হলো তা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে জেনে নেয়া যাক: ‘‘আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের
হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পর ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন।“তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।’ ..... আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে ।”প্রতিবেশিনী সায়রা খাতুন বালিকা পুত্রবধূকে কোলে তুলে নিলেন। কারণ রেণুর পাঁচ বছর বয়সে তার মা, এবং সাত বছর বয়সে তার দাদা লোকান্তরিত হন। কাজেই অভিভাবকহীনা রেণুর অভিভাবক হলেন শাশুড়ি। আর শাশুড়ি-পুত্রবধুর নৈকট্য কতটুকু ছিল, তা বোঝা যায় যখন রেণু শাশুড়িকে বাবা বলতে শুরু করেন। নিজের ছেলেমেয়েরা বড় হলেও অনেক অসতর্ক মুহূর্তে শাশুড়িকে বাবা সম্বোধন করে রেণু সবার হাসির পাত্র হতেন। পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে শাশুড়ি নিজের মেয়েদের চেয়ে ছেলের বউকে বেশি স্নেহ করতেন। বিয়ের পর মুজিব-রেণু একসঙ্গে খেলাধুলা করে বড় হয়েছে। বড়রা রেণুকে শিখিয়েছিল মুজিব তার দুলাহ্; রেণুও তা বলতো। এমন বালক বর আর বালিকাবধু নিয়ে রচিত হয়েছিল রবীন্দ্র পঙক্তি-
ও গো বর, ও গো বধূ
ওই যে নবীনা, বুদ্ধি বিহীনা
ও তব বালিকা বধূ
বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য অনুযায়ী, তাঁদের ফুলশয্যা হয় ১৯৪২-এ। শেখ হাসিনার সূত্রে জানা যায়, বঙ্গমাতা গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি র্পযন্ত পড়াশোনা করেছেন; একই স্কুলে বঙ্গবন্ধুও পড়তেন। সেকালে একজন নারীর পঞ্চম শ্রেণি র্পযন্ত পড়া মানে অনেক কিছুই। উপরন্তু, সে সময়ে মিশন স্কুলগুলোতে পড়াশোনার মান অনকে উঁচু ছিল। বঙ্গমাতার প্রাতষ্ঠিানকি শিক্ষা যা-ই হোক না কেন, স্বশিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে তাঁর ঐকান্তকি প্রচষ্টোর অভাব ছিল না। কর্মব্যস্ত স্বামীর প্রায়শ অনুপস্থতিতিতে নি:সঙ্গতা কাটানোর উপায় ছিল বিস্তর পাঠ। তিনি পড়তেন বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, প্রবোধ সান্যাল, বিভূতিভূষণ প্রমূখের নন্দিত সাহিত্যকর্ম। বোঝা যায়, এমন পাঠ পাঠককে মনন ও চেতনার কোন স্তরে নিয়ে যেতে পারে, বা তার জীবনবোধ কত গভীর ও তীব্র হতে পারে; যার চমৎকার একটি দৃষ্টান্ত ছিলেন বঙ্গমাতা। সুতরাং বিস্মিত হতে হয় না যখন দেখা যায়, এ নারী স্বামীর প্রিয় মনীষী র্বাট্রান্ড রাসেলকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করছেন। পঞ্চম শ্রেণি র্পযন্ত পড়া কোন নারীর পক্ষে র্বাট্রান্ড রাসেল বোঝা সম্ভব নয়; কিন্তু বঙ্গমাতা বুঝেছিলেন। কারণ তিনি স্বপ্রণোদিত ঐকান্তিক শ্রমে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সংযোজন করেছিলেন অনেক কিছুই।
পত্রিকা নিয়মিত পাঠ পাঠকের বোধ-বুদ্ধির সীমানা ছড়িয়ে দেয়, তা আলোকিত সব মানুষের জানা। শেখ হাসিনার বয়ানে জানা যায়, “মা ও আব্বা মিলে কাগজ পড়তেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। ... আমার মা খুব খুঁটিয়ে কাগজ পড়তেন। দুপুরে খাবার খেয়ে মা পত্রিকা ও ডাকবাক্সের চিঠিপত্র নিয়ে বসতেন। আমাদের বাসায় নিয়মিত ‘বেগম’ পত্রিকা রাখা হতো। ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফি’, ‘লাইফ’, এবং ‘রিডার্স ডাইজেস্ট— এই পত্রিকাগুলি রাখা হতো। ‘সমকাল’ সাহিত্য পত্রিকাও বাসায় রাখা হতো। মা খুব পছন্দ করতেন। ‘বেগম’ ও ‘সমকাল’ এ দুটোর লেখা মায়ের খুব পছন্দ-ছিল।”
বঙ্গমাতার সাংসারিক জীবনের কিছু খণ্ড চিত্র প্রণিধানযোগ্য। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম ছিল বন্ধুর পথে বিচরণের; তাঁর বাড়ি ছিল তাঁর জন্য স্বল্পদিনের অতিথির জন্য মুসাফিরখানা; আসল বাড়ি ছিল কারাগার, যেখানে কেটেছে স্বল্পায়ু জীবনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। কিন্তু তাঁর বাড়ি, সংসার ও সন্তান-সন্ততি সবই ছিল। তা চলতো কীভাবে? প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া যায় ড. নীলিমা ইব্রাহিমের সাক্ষ্য থেকে: “.... বৃদ্ধ পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা নিয়ে ফজিলাতুন্নেছার দিন কীভাবে কেটেছে বা কাটছে-এ নিয়ে নেতার খুব বেশি দুশ্চিন্তা ছিল বলে মনে হয় না। .... নিজ পরিবার সম্পর্কে নেতা নিশ্চিত ছিলেন, তার বড় কারণ একদিকে পিতামাতা অন্যদিকে গৃহিণীর কর্মনৈপূণ্য, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও সংসার পরিচালনার দক্ষতা সম্পর্কেও তিনি ছিলেন একান্তভাবে শ্রদ্ধাশীল এবং আস্থাবান।”
ড. নীলিমা ইব্রাহিমের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মা সায়েরা খাতুনের প্রথম পরিচয় হয় বরিশাল-ঢাকা লঞ্চে। তখন সায়রা খাতুন বলেছিলেন, “তাঁর দায়িত্বজ্ঞানহীন একটি পাগল ছেলে আছে। সে “শুধু রাজনীতি জানে, ঘর-সংসার কিছুই বোঝে না, সবই বৌমার ঘাড়ে। এখন বৌমা আসন্ন প্রসবা। পাগল তো গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে বসে আছে।” ড. নীলিমা ইব্রাহীম লক্ষ্য করলেন, ভদ্রমহিলা সব সময় ছেলে সম্পর্কে ‘পাগল’ বলছেন। তো তিনি জিজ্ঞেস করলেন, পাগল ছেলেটির নাম কী? উত্তর পেলেন, “মুজিব, শেখ মুজিবুর রহমান।” প্রশ্নকর্ত্রীর বিমুগ্ধ বিস্ময়ের পালা। শেখ মুজিব তার চেনা-জানা নাম, কিন্তু তাঁর মা-র সঙ্গে এভাবে প্রথম পরিচয় হলো। মা যখন ছেলের সংসার-বিচ্ছিন্নতা আর বৌমার সংসারলগ্নতার কথা বলেন তখন তা গ্রহণ করতে আমাদের আর বাড়তি তথ্য-প্রমাণের দরকার হয় না। জানা কথা, বঙ্গমাতা সংসার সামলিয়ে মন-মস্তিষ্ক দিয়ে স্বামীর কাজে সহযোগিতা করতেন।
বঙ্গবন্ধু সন্তানদের পিতা হয়েও পিতৃত্বের দায়িত্ব পালন করার সময় খুব কম পেতেন; যতটুকু পেতেন তার “চৌদ্দআনা হাসু
, এক আনা রাসেল, আর কামাল-জামাল- রেহানা মিলিতভাবে একআনা” পেয়েছে। কাজেই মা-র সান্নিধ্য ও শাসনে ছেলেমেয়েকে বেড়ে উঠতে হয়েছে। শেখ হাসিনার সুবাদে জানা যায়, “আমার মা আমাদের সব দু:খ ভুলিয়ে দিতেন তার স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে।” কিন্তু মা-র স্নেহ-ভালোবাসার আতিশয্য সত্ত্বেও কড়া শাসনের ব্যত্যয় কখনও হয়নি; মাতৃ¯স্নেহ সন্তানদেরকে তাদের খেয়ালখুশি মতো বড় হতে দেয়নি, তাদের বড় হতে হয়েছে মা-র কড়া শাসনে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শেখ হাসিনা লিখছেন, “... মাকে সবাই ভয় পেত। মার অপছন্দের কাজ করলে, পড়াশোনায় ফাঁকি দিলে মায়ের কাছে নির্ঘাত শাস্তি পেতে হবে। ..... তার ওপর মাকে তো আমরা আরও ভয় পেতাম, মার হাতে দু-চার ঘা যে খেতে হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।” বঙ্গমাতার জবানিতেই শোনা যাক তিনি কীভাবে ছেলেমেয়েদেরকে মানুষ করেছেন, “আমি চুবনি খাইয়া খাইয়া সাঁতার শিখছি, বাচ্চাদের এতটুকু বিলাসিতা শিখাই নাই।” তাঁকে কখনও কেউ সুসজ্জিতা দেখেনি; ছেলেমেয়েদেরকেও কখনও বিলাসপ্রবণ মনে হয়নি। তবে বঙ্গমাতাকে একবারই ভালো একটি শাড়ি পরতে দেখা গেছে, এবং তা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সান্নিধ্যে। বঙ্গমাতা সেদিন পরেছিলেন কাতান শাড়ি, যা সামলাতে তাঁর বড় কষ্ট হচ্ছিল। এমন দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী মহিলা রসবোধ বা কৌতুকহীন ছিলেন না। বঙ্গমাতা একদিন ড. নীলিমা ইব্রাহিমকে বললেন, “নিজের ভাইকে বানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু আর আমাকে বঙ্গমাতা, বেশ আমি বুঝি ‘বঙ্গবান্ধবী’ হতে পারি না। এতই কি বুড়ো হয়েছি।” তবে রেণু কৌতুক করে যা-ই বলুন না কেন, তিনি আমাদের বঙ্গমাতা থেকে গিয়েছেন, এবং থাকবেনও। তবে বঙ্গমাতাকে নিয়ে এক স্তাবক রসিকতা করেছিল। একদিন সে বঙ্গবন্ধুকে প্রস্তাব দিয়েছিল, বাংলাদেশ জাতীয় এয়ারলাইন্স-এর নাম ফজিলাতুন্নেছা রাখতে; কারণ ইউরোপের একটি এয়ারলাইন্স-এর নাম লুৎফুন্নেসা। বঙ্গবন্ধু তাকে ধমক দিয়ে বললেন, “ওটা লুৎফুন্নেসা নয়, লুফতহানসা, জার্মান এয়ারলাইন্স-এর নাম। পৃথিবীর কোথাও কোন ব্যক্তির নামে কোন এয়ারলাইন্স নেই, এয়ারপোর্ট আছে। যাও এখানে থেকে চামচাগিরি করো না।” বঙ্গমাতার সাংসারিক জীবন নিয়ে চ‚ড়ান্ত মন্তব্য পাওয়া যায় প্রয়াত সাংবাদিক এবং বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য এ.বি.এম. মূসার লেখনীতে, “বহু বছর আগে স্বামীর সঙ্গে গ্রাম্যবধূর যে লেবাসটি পরে এসেছিলেন, গণভবন বঙ্গভবনে এসে তা ছাড়তে চাননি। ...... শেখ মুজিবের পত্নীকে আমি দেখেছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির পত্নী ফার্স্ট লেডিকে দেখিনি। দেখেছি আটপৌরে শাড়ি পরনে পালঙ্কে বসে বাটা হাতে পান সাজাতে। রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে রাষ্ট্রীয় বাহনে তাঁকে দেখা যায়নি, দেখা যায়নি তাঁর সাথী হয়ে বিমানে করে রাষ্ট্রীয় সফরে যেতে।” বঙ্গমাতার নিত্যসঙ্গী ছিল পানের বাটা, যা তিনি ইন্দিরা মঞ্চেও নিয়ে গিয়েছিলেন। মঞ্চের সামনে অদূরে উপস্থিত এ.বি.এম. মূসা বঙ্গবন্ধুকে অনুযোগ করতে শুনলেন, “ওটা আবার নিয়ে আসলা ক্যান?” “এ হচ্ছে সেই সহজ-সরল চিরায়ত গ্রাম্যবধূ প্রধানমন্ত্রী জায়ার চিত্ররূপ।”লেখক বঙ্গবন্ধু: প্রেরণায় রেণু
বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজনীতির মানুষ; লেখক-পাঠক বঙ্গবন্ধু পরিচয় ছিল অন্তরালের। পাঠক বঙ্গবন্ধুর পরিচয় একেবারে অজানা ছিল না; কিন্তু লেখক বঙ্গবন্ধুর জনসম্মুখে আসেন তাঁর লোকান্তরের পর, ২০১২-তে। আর বঙ্গবন্ধুর লেখক-সত্তা নির্মাণে ও উপস্থাপনে তিন নারীর অবদান স্বীকৃত- স্ত্রী রেণু এবং দুই কন্যা - হাসিনা ও রেহানা। প্রথমজন সৃষ্টির প্রেরণা; দুই কন্যা সৃষ্টিভিত্তিক নির্মাণ ও উপস্থাপনের কুশলী কারিগর। বিশেষ করে শেখ হাসিনা না হলে বঙ্গবন্ধুর অনুপম লিখন-সৃষ্টিগুলো আমাদের অজানা থেকে যেত। কারাগারের রোজনামচা নামকরণ করেছেন শেখ রেহানা। লেখক বঙ্গবন্ধুর পরিচয় এ তিন নারীর কাছে ঋণ স্বীকার করে। অবশ্য উল্লেখ্য, আরও একজন নারীর কথা, শেখ হাসিনার বান্ধবি প্রয়াত সাংবাদিক বেবী মওদুদ, যার একনিষ্ঠ শ্রম বঙ্গবন্ধুর বইগুলো প্রকাশের পেছনে কাজ করেছিল। নারী-অবদানে আমাদের পাওয়া বইগুলো: অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২), কারাগারের রোজনামচা (২০১৭); এবং আমার দেখা নয়াচীন (২০২০)। শেখ হাসিনার সৌজন্যে বঙ্গবন্ধুর আরও কিছু বইয়ের জন্য আমরা অপেক্ষমান।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শুরুতে আছে বঙ্গবন্ধুর জবানি, “আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।” রেণু শুধু তাগাদা নয়, লেখার খাতাও দিয়েছিলেন। এভাবেই যাত্রা শুরু হয়েছিল লেখক বঙ্গবন্ধুর। রাজনীতিবিদ-রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু স্বয়ংসৃষ্ট; কিন্তু লেখক বঙ্গবন্ধু ষোলআনা রেণুর সৃষ্টি। কারাগারের রোজনামচা-র ভ‚মিকায় শেখ হাসিনার সাক্ষ্য আছে আব্বার লেখা এই খাতার উদ্ধার আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরোধের ফসল। আমার আব্বা যতবার জেলে যেতেন মা খাতা, কলম দিতেন লেখার জন্য। বারবার তাগাদা দিতেন। আমার আব্বা যখন জেল থেকে মুক্তি পেতেন মা সোজা জেল গেটে যেতেন আব্বাকে আনতে আর আব্বার লেখাগুলি যেন আসে তা নিশ্চিত করতেন। সেগুলি অতি যত্নে সংরক্ষণ করতেন।
মুজিব-রেণু আত্মিক সম্পর্ক
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ তেমন আর কোন মানবিক সম্পর্ক নয়। কিন্তু তথ্য-প্রমাণ বলে মুজিব-রেণু সম্পর্ক ছিল স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের চেয়েও গভীরতর; তাদের দু’জনের সম্পর্ক ছিল আত্মিক। কারণ বোধহয়, দু’জন দু’জনকে চেনা-জানার সময় পেয়েছিলেন অনেক। বঙ্গবন্ধুর বিয়ে হয় কিশোর বয়সে, আর রেণুর শিশু বয়সে। উপরন্তু রেণুর বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধুর মা-র ছত্রছায়ায়। অবশ্য এক্ষেত্রে দু’জনের মানসিক নৈকট্য ও মিল যে ছিল তা-ও বিবেচনায় নিতে হবে।
১৯৭৪-এ বঙ্গবন্ধু মস্কোতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। একদিন রুশ দোভাষী অধ্যাপক দানিয়েল চুক (বাংলা জানতেন) একজন ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে এসে বললেন। “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ইনি আপনার হৃদয়ের ডাক্তার।” হতভম্ব বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গমাতা তার উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, তোমার হার্টের ডাক্তার। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন ঠিকই, তবে চমকপ্রদ কিন্তু বস্তুনিষ্ঠ উত্তর দিলেন, “আমার হৃদয়ে তো তুমি।” উল্লেখ্য, এ দম্পত্তির যাপিত জীবন বলে দু’জন দু’জনের হৃদয়ে ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিশক্তি ছিল কিংবদন্তীতুল্য। অথচ সে বঙ্গবন্ধু কী না স্ত্রীকে বলেছেন, “এই আমার জীবন্ত ডায়েরি। তাকে জিজ্ঞেস কর। আমার চাইতেও নির্ভুল বিবরণ পাবে। আমার চাইতেও তার স্মৃতিশক্তি ভালো। তোমাকে
ডিকটেসন দেয়ার আগে এই জীবন্ত ডায়েরির সঙ্গে অনেক কথা মিলিয়ে নিয়ে তবে এখানে আসি। কর্মব্যস্ত স্বামীর সব কাজ/ঘটনার কথা যে স্ত্রী অনুপুঙ্খভাবে ধারণ করে তার শুধু স্মৃতিশক্তির তারিফ করলে হয় না, স্বামীর প্রতি তার যে ভালোবাসা ছিল তার-ও স্বীকৃতি দিতে হয়, যা বঙ্গবন্ধু অকুণ্ঠভাবে দিয়েছিলেন।বঙ্গবন্ধু রোজগেরে মানুষ ছিলেন না, অভাব তাঁর ছিল না বটে, তবে অর্থাভাব হতো। বাড়ি থেকে টাকা নিতে হতো। বাড়ি গেলে সবার অজান্তে রেণু তার জমানো টাকা বঙ্গবন্ধুকে দিত। বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃতি আছে, রেনু নিজের জন্য মোটেই খরচ করতো না।
বঙ্গবন্ধু নিজে কোনদিন তাঁর জন্মদিন পালন করতেন না। কিন্তু স্ত্রী জন্মদিনে তাঁকে “ছোট্ট একটি উপহার” দিতেন। বঙ্গবন্ধুর বারবার জেল খাটা আর তার ফলে স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়া সম্পর্কে রেণুর দুশ্চিন্তা ছিল। যেমন একদিন একান্তে স্বামীকে বলেছিলেন, “জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। . . . তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই।” বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বঙ্গমাতাকে আত্মার আত্মীয়বিহীন হয়ে বাঁচতে হয়নি; দুজনকে একসঙ্গে লোকান্তরিত করেছিল খুনিরা। এমনকি বাংলাদেশ সফর করে বিমানবন্দরে বিদায় নেয়ার সময়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গমাতার কাছে অনুযোগ শুনলেন, “কামালের আব্বারে একটু কইয়া যান তো, উনি যেন ঠিক টাইম মতো খাওয়াদাওয়া করেন।” ইন্দিরা গান্ধী শান্তি নিকতনে পড়ার সুবাদে একটু কষ্ট করে হলেও বাংলা বুঝে বঙ্গবন্ধুকে বললেন, “এক্সেলেন্সি, এটা তো সাংঘাতিক অভিযোগ; আমিও প্রধানমন্ত্রী এবং বেশ ব্যস্ত থাকি। কিন্তু লাঞ্চ-ডিনার খুবই টাইমমতো করি। আপনিও লক্ষ্য রাখবেন।” তিনি সংযোজক বক্তব্যে বললেন, “সত্যিই বেঙ্গলি হাউসওয়াইফদের তুলনা হয় না।” এহেন রেণু সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা-চিন্তা ছিল। তিনি লিখেছেন, “সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।” নিজের জীবনের ইতি কল্পনা করে তিনি আরও লিখেছেন, “রেণুর দশা কি হবে? তার তো দুনিয়ায় কেউ নাই।” সে কারণেই বঙ্গমাতা ঘাতকদের বলেছিলেন, “ওনাকে
যখন মেরে ফেলেছ আমাকেও মেরে ফেল।” ঘাতকরা তা-ই করেছিল। বঙ্গমাতা সাধারণ নারীর মতো বাঁচার আকুতি করেননি। মরণেও তিনি বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি।রেণুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা
ঘর-সংসার আর স্বামী নিয়ে যার ইহলৌকিক জগত তার মধ্যে রাজনীতি বা রাজনৈতিক কোন সংশ্লেষ থাকার কথা নয়। বঙ্গবন্ধুর জবানিও তাই বলে: “..... আমার স্ত্রী রাজনীতির ধার ধারে না। আমার সাথে পার্টিতে কোন দিন যায় নাই। সে তার সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাইরের লোকের সাথে মেলামেশাও করে না। আমার রাজনীতির সাথে তার সম্বন্ধ নাই।” অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু- কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, “আন্দোলন কীভাবে করতে হবে, সেটা মায়ের কাছ থেকেই শেখা। বঙ্গমাতা ছিলেন ‘গেরিলা’...।” বঙ্গমাতা সম্পর্কে দু’জনই ঠিক; প্রকাশ্যে নয়, আড়ালের রাজনীতিবিদ ছিলেন বঙ্গমাতা - গেরিলার মতো আড়াল যোদ্ধা - গেরিলা রাজনীতিবিদ। বঙ্গমাতা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এ.বি.এম. মুসার অভিমত যৌক্তিক : “... বেগম মুজিব স্বামীর প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত না থেকেও দেশে কী ঘটছে, জনগণ কী ভাবছে আর বলছে, তার খোঁজখবর রাখতেন, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালক স্বামীর কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হতেন না। ... ৩২ নম্বরে খাটের ওপর বসে তিনি শুধু পান বানাতেন না। সারা দেশের রাজনীতি এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত ছিলেন।” এমন আরেকজন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মন্তব্যও অভিন্ন : “শেখ মুজিবের জীবনে, তাঁর সকল রাজনীতিতে এই মহিলা ... সবুজ সঙ্কেত দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।” বঙ্গবন্ধুর প্রকাশ্য রাজনীতির অন্তরালবর্তী পরামর্শক ছিলেন বঙ্গমাতা। রাজনীতির প্রতিটি ক্রান্তিপর্বে এ মহিলার পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হয়েছিল। বলা চলে, পরিস্থিতির চাপে তৈরি হওয়া বঙ্গবন্ধুর মনের অনেক দোলাচল কাটাতে বঙ্গমাতার পরামর্শ অনুঘটক হয়েছিল।
ছয় দফাভিত্তিক আন্দোলন শুরু করা না করা নিয়ে বঙ্গবন্ধু দ্বিধান্বিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বীকারোক্তি: “আমি আর কারো বিরোধিতাকে ভয় করি না। কিন্তু হাসিনার মা বেঁকে দাঁড়ালে আমার পক্ষে মুভমেন্টে নামা কষ্ট হবে।” ক’দিন পর বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী শুনলেন, “চৌধুরী, গ্রীণ সিগন্যাল পেয়ে গেছি। এখন তোমাদের মুজিব ভাইকে আর ঠেকায় কে? ..... লাহোরে সর্বদলীয় সম্মেলনে যাচ্ছি। সেখানেই ঘোষণা করবো বাংলার মানুষের পক্ষ হয়ে আমার দাবিনামা। এই দাবি না মানলে আন্দোলন, লড়াই।” এখন বঙ্গমাতার পরামর্শ কী ছিল তা জানা যাক: “তাঁকে
আমি বলেছি, বুড়াদের নিয়ে আপনি এত ঘাবড়ান কেন? আপনার রয়েছে হাজার হাজার তরুণ কর্মী, ছাত্র, যুবক। তারা আপনার ডাক শুনলে হাসিমুখে আন্দোলনে ঝাঁপ দেবে।” তবে তিনি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে সতর্ক করেছিলেন এ বলে যে, “এবার আপনারা বাঘের পিঠে সওয়ার হতে যাচ্ছেন। হয় বাঘ আপনাদের বশ করতে হবে, নয় বাঘই আপনাদের খাবে।” ভবিষ্যতে ইতিহাস বলেছিল, বাঘ খেতে পারেনি, উল্টো সে-ই বশ হয়েছিল। তবে বড় কথাটি হল, বঙ্গমাতার পরামর্শ ও সতর্কতা কত বাস্তবধর্মী ছিল! অন্যদিকে ছয় দফার আন্দোলনে বঙ্গমাতার ভ‚মিকা নিয়ে মন্তব্য আছে শেখ হাসিনার: “আমার মা-ই আয়োজন করলেন ৭ জুনের হরতাল। এই আন্দোলনটাকে গড়ে তোলার জন্য আমার মা সব সময় সক্রিয় ছিলেন।”ছয় দফা না আট দফা তা নিয়ে আওয়ামী নেতাদের মধ্যে বাক-বিতন্ডা ছিল। অনেকের মত ছিল আট দফার পক্ষে; এবং তারা তরুণী শেখ হাসিনা এবং বঙ্গমাতাকেও দলে ভেড়াতে সচেষ্ট ছিলেন। অবশ্য কাজ হয়নি, শেখ হাসিনা উত্তর দিতেন, “কিছু বোঝার দরকার নেই, আব্বা বলেছেন ৬-দফা, ৬-দফাই দরকার, এর বাইরে নয়।” অন্যদিকে বঙ্গমাতার সোজাসাপটা মন্তব্য ছিল, “আমি তো ভাই বেশি লেখাপড়া জানি না, খালি এইটুকু বুঝি, ৬ দফাই হচ্ছে বাংলার মানুষের মুক্তির সনদ। এটা উনি বলে গেছেন, এটাই আমি মানি। এর বাইরে আমি কিছু জানি না।” লক্ষণীয়, প্রথম বক্তব্যে পিতার প্রতি কন্যার, এবং দ্বিতীয় বক্তব্যে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আস্থার প্রকাশ আছে। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্য ভালো, ঘরেও তাঁর নেতৃত্ব অবিসংবাদিত ছিল। আগরতলা মামলা চলমান থাকার সময়ে জিজ্ঞাসাবাদের উত্তরে বঙ্গমাতা সদম্ভে বিবেকী সাহস নিয়ে বলেছিলেন, “স্বাধীনতা আমাদের দরকার।”
পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে এলে বঙ্গমাতা তাদের সামনে যেতেন না, পর্দার আড়াল থেকে কথা বলতেন। তিনি অতিথিদের বলতেন, তিনি পর্দা করেন। আর বাড়ির লোকজনকে বলতেন, “ওদের সঙ্গে থাকব না, দেখা করব কেন?” বঙ্গবন্ধু করাচি যেতেন। কিন্তু বঙ্গমাতা কোনদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে যাননি। কেন? শেখ হাসিনার ভাষ্য আছে: “উনি জানতেন, উনিই বেশি আগে জানতেন যে, এদেশ স্বাধীন হবে।”
ফজলুল কাদের চৌধুরীর বরাতে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী জানাচ্ছেন, কীভাবে আইয়ুব খান বঙ্গমাতার কারণে মুজিব নামের বাঘকে নানা প্রলোভন সত্তে¡ও বশ করতে পারেননি। আইয়ুব-মুজিবের মধ্যে দুতিয়ালির কাজ করেছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পীকার ফজলুল কাদের চৌধুরী। আইয়ুবের শর্ত ছিল ছয় দফার দাবি ত্যাগ করতে হবে। বিনিময়ে মুজিব পাবেন : কোটি টাকা, মন্ত্রী হওয়ার প্রলোভন আগেই প্রত্যাখান করার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণরের পদ (মুজিব নিজের লোক দিয়ে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠন করবেন); এবং গান্ধারা ইন্ডাস্ট্রিজের ৪৯ শতাংশ শেয়ার (শেয়ার কেনার টাকা আইয়ুব দেবেন)। প্রস্তাবগুলো পেয়ে বঙ্গবন্ধুর তাৎক্ষণিক মন্তব্য ছিল, “দেখি, হাসুর মায়ের সঙ্গে একটু আলাপ করে।” ফজলুল কাদের চৌধুরী ভাবলেন, “হাতী কলা অর্ধেক গিলেছে। বাকিটাও গিলবে।” কিন্তু দু’দিন পর তিনি ৩২ নং-এর বাড়িতে গিয়ে বঙ্গমাতার মুখে যা শুনলেন তাতে নিজেই যেন হাতীর পায়ের তলায় পড়লেন;” ভাই, আপনাকে একটা অনুরোধ জানাব। শেখ মুজিবকে আইয়ুব খান আবারো জেলে ভরতে চান আমার আপত্তি নেই। আমাদের এই বাড়িঘর দখল করতে চান, তাতেও দুঃখ পাব না। আপনাদের কাছে দু’জনেরই অনুরোধ, আমাদের মাথা কিনতে চাইবেন না। শেখ মুজিবকে মোনায়েম খাঁ বানাবার চেষ্টা করবেন না।” কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে যেনতেন প্রকারে স্বামীর বৈষয়িক সমৃদ্ধির হাতছানিকে স্ত্রী সোৎসাহে স্বাগত জানান; কিন্তু এক্ষেত্রে হল অনুকরণীয়/অনুসরণীয় ব্যতিক্রম। আর সে কারণেই তিনি বঙ্গমাতা, তাঁর স্বামী আমাদের বঙ্গবন্ধু।
৭ মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধুর জীবনের শ্রেষ্ঠতম ভাষণ। কিন্তু ভাষণের আগের সময় ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনে কঠিনতম। সারাদেশ তাঁর দিকে তাকিয়ে। আওয়ামী নেতারা একমত ছিলেন স্বাধীনতা ঘোষণা করা সমীচীন হবে না; তবে পূর্বশর্ত ঘোষণা করে আন্দোলন চলমান রেখে ইয়াহিয়াকে চাপে রাখতে হবে। স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সামরিক জান্তা রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়ার সুযোগ পাবে। আবার ছাত্রনেতাদের দাবি ছিল, স্বাধীনতা ঘোষণা করতেই হবে। কাজেই বঙ্গবন্ধু প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন, দ্বিধা তো ছিলই। পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করলেন বঙ্গমাতা। স্বামীকে প্রশ্ন করলেন, “আপনার মন কী চায়।” বঙ্গবন্ধুর উত্তর ছিল, “আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে চাই। আজ সেই ঘোষণা না দিলে আর হয়তো তার সুযোগ পাব না। আর আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা না করলে আর কোনো নেতা হয়তো এই কাজটি করতে সাহস পাবেন না।” বঙ্গমাতা তখন বললেন, “আপনার মন এবং বিবেক যা চায়, আজ তাই করুন। ভয়ে পিছিয়ে যাবেন না।” তাঁর শেষ কথা ছিল, “মনে রাখবেন, আপনার পিছনে বন্দুক, সামনে জনতা।” বঙ্গবন্ধু সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে তাঁর সিদ্ধান্ত জানালেন, “আমি স্বাধীনতার ঘোষণা দেব। তবে সোজা ঘোষণা নয়। ঘুরিয়ে বলবো। যাতে ইয়াহিয়া-ভুট্টো ইউডিআই-র অভিযোগ তুলতে না পারে, অপ্রস্তুত ও নিরস্ত্র বাঙালির উপর হামলা চালানোর অজুহাত না পায়।” বঙ্গবন্ধু তাঁর রেণুকে যে কথা বলেছিলেন বা রেণুর কাছ থেকে যে দিকনির্দেশনা পেয়েছিলেন, সে অনুযায়ী তিনি তাঁর ভাষণ দিয়েছিলেন; তিনি বন্দুক ও জনতা উভয়কেই কুশলী দক্ষতায় সামলিয়েছিলেন। অবশ্য বাঙালি তাদের প্রত্যাশিত বার্তা পেতে ভুল করেনি।
কঠিন, জটিল ও অনিশ্চিত পরিস্থিতিতেও বঙ্গমাতা যে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন তার দৃষ্টান্ত আছে। ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বঙ্গবন্ধুহীন পরিবারটিকে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে বন্দি করে রাখা হয়েছিল সেনা পাহারায়। পাকিস্তানি জেনারেল উমর বাড়িটির ভাড়া দেয়ার প্রস্তাব করলে বঙ্গমাতা তা তাৎক্ষণিক প্রত্যাখান করেন; তাঁর বিকল্প প্রস্তাব ছিল, ব্যাংকের জমা টাকা থেকে তিনিই বাড়িভাড়া দেবেন এবং অন্যান্য খরচ চালাবেন। প্রস্তাবটি জেনারেল উমর গ্রহণ করতে বাধ্য হন। অবশ্য চেক সই করতে হবে শেখ মুজিবকে। পরে সইসহ চেক পাবার পর বঙ্গমাতা বুঝলেন বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন। ঘটনাটির মধ্য দিয়ে বঙ্গমাতার আত্মমর্যাদাবোধ ও বিচক্ষণতা প্রমাণিত হয়।
একজন সংবেদনশীল নারী এবং স্নেহময়ী মা হিসেবে বঙ্গমাতার মানসিক মানচিত্র নিয়ে ভুরিভুরি দৃষ্টান্ত আছে; একটির কথা বলা যেতে পারে। বঙ্গমাতা ও পরিবারের সবাইকে বন্দিত্ব থেকে উদ্ধার করেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর তারা। পাহারাদার ১০-১২ জন পাকিস্তানি সৈনিককে আত্মসমর্পনে বাধ্য করানোর পর মেজর তারা বাড়িতে প্রবেশ করলে বঙ্গমাতা তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “তুমি আমার পোলা, বাবা।” পরিস্থিতির আকস্মিক মধুর পরিবর্তনে বঙ্গমাতার মনে বাৎসল্য-রসের স্ফূরণ হয়েছিল।
পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে যা করা সমীচীন সে সম্পর্কে বঙ্গমাতার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব সংক্রান্ত বেশ কিছু দৃষ্টান্ত আমাদের আলোচনায় ইতোমধ্যে এসেছে। এমন একটি দৃষ্টান্ত তৈরি হয় যখন দেখা যায়, বঙ্গমাতার পরামর্শে বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার কর্মসূচিতে রদবদল হয়েছিল। আগের কর্মসূচি অনুযায়ী দিল্লি এবং কলকাতা হয়ে, আর দিল্লিতে ব্রিটিশ বিমান পরিবর্তন করে ভারতীয় বিমানে বঙ্গবন্ধুর ঢাকা ফেরার কথা ছিল। বঙ্গমাতা তাজউদ্দীনকে দুটো পরামর্শ দিয়েছিলেন। এক, বিমান পরিবর্তন করা ঠিক হবে না; কারণ তাতে ব্রিটেন মনঃক্ষুন্ন হতে পারে। দুই, কলকাতায় গেলে ঢাকায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে; যা নিরাপত্তায় সমস্যা করবে এবং রেসকোর্সেও ভাষণ দেয়া সম্ভব হবে না। কাজেই তাজউদ্দীন দিল্লিতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টা ডি. পি. ধরের সঙ্গে আলোচনা করে যে ব্যবস্থা করেন তাতে বঙ্গবন্ধু কলকাতা না গিয়ে ব্রিটিশ বিমানেই দিল্লি থেকে সরাসরি ঢাকা আসেন এবং শীতের সন্ধ্যা নামার আগেই রেসকোর্সের ভাষণ শেষ করেন। বলা বাহুল্য, আগের কর্মসূচি বহাল থাকলে অন্তত রেসকোর্সের ভাষণ হতো না; ইতিহাসের একটি অধ্যায় বাদ পড়তো। কারণ ভাষণটিতে কিছু দিকনির্দেশনা ছিল।
সমাপনী মন্তব্য
রেণু সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর অকপট স্বীকারোক্তি: “আমার জীবনে দুটি বৃহৎ অবলম্বন। প্রথমটা হলো আত্মবিশ্বাস, দ্বিতীয়টি হলো আমার স্ত্রী আকৈশোর গৃহিণী।” আমাদের নাতিদীর্ঘ এ আলোচনায় আমরা দেখেছি বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুর জন্য ছিলেন “শক্তিদায়িনী, প্রেরণাদায়িনী।” সুতরাং আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর এ বিশ্বাস সঠিক যে, “বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে একদিন যেমন শেখ মুজিবের প্রকৃত মূল্যায়ন হবে, তেমনি হবে মুজিবপত্নী বেগম ফজিলাতুন নেছারও। তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস রবে অসম্পূর্ণ।” কালের বিবর্তনে বঙ্গবন্ধু উজ্জ¦ল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছেন; মূল্যায়িত হচ্ছেন বঙ্গমাতাও। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির বটবৃক্ষ; আর বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুর ছায়াবৃক্ষ।
লেখক: বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল্স (বিইউপি), সাবেক চেয়ারম্যান, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।