মাস পার হয়ে গেছে। উপর থেকে দেখে যদিও এখন সব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।
অবশ্য মনে হবেই বা না কেন!
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শেষ হয়েছে। শেষ হয়েছে বাংলাদেশ-পাকিস্তান টি-টোয়েন্টি সিরিজও। সফরকারী পাকিস্তানের বিপক্ষে স্বাগতিক বাংলাদেশের চলতি টেস্ট সিরিজ নিয়েও কম উত্তেজনা নেই। চট্টগ্রাম টেস্টে এক পাকিস্তান সাপোর্টারের যে বেহাল দশা হয়েছে, তার ভিডিও ভেসে বেড়াচ্ছে ফেসবুকে। এ নিয়ে কম তোলপাড় হয়নি। দুইপক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে এই ঘটনার বিচার বিশ্লেষণে।
অবশ্য, প্রায় সব ইস্যুতেই তো এখন পক্ষ-বিপক্ষ ঝড় তোলে। যার প্রমাণ আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই দেখতে পাই।
একের পর এক ঘটনা ঘটে, আর নতুন কিছু এলেই সেটা ধামাচাপা পড়ে যায়। এটাই যেন এখানকার নিয়ম হয়ে পড়েছে।
এই যেমন এক মাস আগে দেশে এতোবড় একটা গেইম হয়ে গেল, সেই গেইমের রেজাল্টের জন্য এখনো অপেক্ষা আমাদের। কিন্তু অনেকগুলো ইস্যুতে সেই ঘটনা অনেকটাই হালকা হয়ে গেছে।
অবশ্য এই কিছুদিনে অনেক কিছুই তো বদলেছে! নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য, গাড়ি ভাড়া, ডিজেলের দামসহ আরও অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। এই একমাসে জিডিপি গ্রোথও হয়তো বেড়েছে। উন্নয়নের চাকা থেমে নেই একদম। রাস্তা-ঘাট, বিদ্যুত, কারখানা ছাড়াও উন্নয়নের অনেকগুলো দিকই চলমান। আর তাই, ইস্যুর যেন শেষ নেই!
এতো কিছুর ভীড়ে যেন অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে ১৩ই অক্টোবর থেকে বেশ ক'দিন যাবৎ ঘটে যাওয়া হামলা ও নৃশংসতার রায়। অপরাধীদের বিচারের অপেক্ষায় আছে ভিকটিমরা...
নৃশংসভাবে একটা নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর উপর হামলার সেই দিনগুলো হয়তো আক্রান্তের শিকার হওয়া কেউ কখনো ভুলতে পারবে না।
১৩ই অক্টোবর সকালে কুমিল্লার নানুয়ারদীঘির পাড় পূজামণ্ডপে ধর্মীয় গ্রন্থ (কুরআন) পাওয়া যায়। সেই জের ধরে কুমিল্লাসহ দেশের অনেকগুলো জায়গায় (ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, কক্সবাজার, রংপুরের পীরগঞ্জসহ বেশক'টি স্থানে) নৃশংসভাবে হামলা চালানো হয়। বলা হয়েছিল, ধর্মীয় গ্রন্থের অবমাননা হয়েছে। সেই জের ধরেই একটা গোষ্ঠীর উপর আক্রমণ, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া ও লুটপাট করা হয়েছে। অনেকে সেটাকে নীরবে পক্ষ দিয়েছিলেন। অনেকে সরাসরি বলেছেন, এটা হিন্দুদের কাজ। কেউ কেউ আবার বলেছে, এটা ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স, ভারতের একটা চাল, কেউ বলেছে এর সঙ্গে চীনও যুক্ত। আরও অনেকে অনেক ব্যাখ্যা দিয়ে অন্যায়কে ঢেকে দিতে চেয়েছেন। ইনিয়েবিনিয়ে সেই অন্যায়কে জাস্টিফাই করতে চেয়েছিল তারা।
অথচ তখনও প্রমাণ হয় নি, সেই মণ্ডপে ধর্মীয় গ্রন্থ কে বা কারা রেখেছে। অনেকে আবার সে সময় এর বিরুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু ধর্মান্ধরা শোনে কার কথা! একেরপর এক হিন্দুদের বাড়ি, ঘর, মন্দিরে আগ্রাসন চালায়, লুটপাট করে। অসহায় হয়ে পড়ে অসংখ্য লোক।
পরবর্তীতে জানা যায়, ১২ই অক্টোবর রাতে পূজা মণ্ডপে ধর্মীয় গ্রন্থ রেখে আসে ইকবাল হোসেন নামের একজন। ২১ তারিখ সেই ইকবাল হোসেনকে গ্রেফতার হলো। এর আগে সে কক্সবাজারে আত্মগোপনে ছিল। শুরুতে তাকে নেশাগ্রস্ত, পাগল ও ভবঘুরে বলা হলেও সিআইডির দেয়া তথ্যমতে জানা যায়, অভিযুক্ত প্রধান আসামি ইকবাল হোসেন মানসিক ভারসাম্যহীন নয়, সে একজন সুচতুর সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ। (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন)
এর আগে সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ হওয়ার পরও একটা গোষ্ঠী বিশ্বাস করছিল না, ধর্মীয় গ্রন্থ রেখেছিল ইকবাল নামের নিকৃষ্ট লোকটি। সিআইডির দেয়া তথ্যমতে, ইকবাল নিজেই এই ঘটনার স্বীকার করেন।
যাইহোক, এইসব ঘটনা অনেকেরই জানা। তবে ধর্মীয় গ্রন্থ অবমাননার দায়ে ধর্মান্ধরা গত মাসের সেই সময়ে পাকিস্তানি হানাদারদের মতো যে অত্যাচার করেছে তারা এখন গা ঢাকা দিয়েছে। এদের একটা নির্দিষ্ট টার্গেট ছিল। ইকবাল সেদিন ধরা না পড়লে হামলা লুটপাট এভাবেই চলতে থাকতো, এটা নির্দ্ধিধায় বলা যায়! বাড়িঘরে আগুন দেয়া হিংস্র হায়নাদের ধরতে প্রশাসন এখন কতটা তৎপর আছে, সেটা না হয় প্রশ্ন-ই থাকলো।
জেনে রাখা ভালো, গত ১৪ই নভেম্বর (রোববার) প্রথম আলো একটি গবেষণাধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, গত ৫০ বছরে (১৯৫১-২০১১) দেশে ৭৫ লাখ হিন্দুর সংখ্যা কমেছে। ১৯৫১ সালে দেশে সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিল মোট জনসংখার ২২ শতাংশ, ৫০ বছর পর ২০১১ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৮.৫ শতাংশে (গত দশ বছরের হিসাব এখানে আসে নি)।
১৯৫১ সালে ৭৬.৯ শতাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০.৪ শতাংশে।
অন্যদিকে ১৯৫১ তে ০.৭ শতাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ২০১১ তে হয়েছে ০.৬ শতাংশ। আর খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা ০.৩ শতাংশ এই ৫০ বছরে অপরিবর্তিতই আছে।
এই গবেষণার তালিকায় চোখে পড়ার মতো আছে শুধুমাত্র সনাতন ধর্মাবলম্বী ও ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১১ সালের আদমশুমারি ও গৃহগণনা প্রতিবেদনে দেশে হিন্দু জনসংখ্যা কমে যাওয়ার দুটি কারণ উল্লেখ করেছে। প্রথমত, হিন্দুদের আউট মাইগ্রেশন হচ্ছে, অর্থাৎ হিন্দুরা দেশ ছাড়ছে। দ্বিতীয়ত, হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে মোট প্রজনন হার বা টোটাল ফার্টিলিটি রেট তুলনামূলক কম। অর্থাৎ হিন্দু দম্পতিরা তুলনামূলকভাবে কম সন্তান জন্ম দেন।'
কেন তাদের আউট মাইগ্রেশন হচ্ছে? কেন তারা দেশ ছাড়ছে? এর কারণ অনেকেই জানেন, মানেনও। আবার অনেকেই জেনেও মানতে নারাজ। আর অনেকে ধরেই নিয়েছেন, এরা দেশ ছাড়বেই। একটা সময় এদের সংখ্যা গুনে দেখার প্রয়োজন হবে না।
সহজ কথা হচ্ছে, এই দেশে রামু, নাসিরনগর, রংপুর, বরিশাল, সিলেটের মতো হামলাগুলোর ফলই হচ্ছে এই আউট মাইগ্রেশন। কেউই অনিরাপদ জীবন কাটাতে চায় না।
একটা পাখিও যখন অনেক কষ্ট করে নীড় বানায়, আর সেখানে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে থাকতে যদি তার নিরাপদবোধ না হয় তাহলে সে স্থান পরিবর্তন করবে এটাই স্বাভাবিক। মানুষও তাই।
আফগানিস্তানে যেমন তালেবানদের কাছ থেকে দূরে থাকতে নিজের দেশ ছেড়েছে অনেকেই।
কুমিল্লার এই ঘটনার জের ধরে সারাদেশে যে তাণ্ডব চালানো হয়েছে, এই ঘটনার পরেই সনাতন ধর্মাবলম্বী অনেকেই এই দেশে নিরাপত্তাহীনতার মুখে আছে বলেই স্পষ্ট। গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের ওপর যেভাবে প্রভাব খাটানো হয় সেটা বলার প্রয়োজন হয় না। এখন আবার নতুন কি ইস্যু ধরে এই গোষ্ঠীর উপর হামলা চালানো হবে সেটাই দেখার।
এসব চলতে থাকলে দেশ থেকে হিন্দু বিলুপ্ত হতে আর ৫০ বছরও লাগবে না।
তবুও পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, এদেশে কিছুই হয়নি। দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া তেমন কিছুই হয় নি এখানে। মাননীয়রা এসব ঘটনা অস্বীকার করেই যেতে পারেন। কিন্তু তারা জানেন না, বিচারপতির বিচারও সময়েই হয়। আমরা যেটাকে প্রকৃতির বিচার বলি। ১৫ আগস্ট কিংবা ২১ আগষ্টের মতো নৃশংস ঘটনার দিনগুলোও যে এদেশে ঘটেছে সেটা বোধহয় তারা ভুলে গেছেন। সেই ঘটনা যারা ঘটিয়েছেন তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঠিকই শাস্তি পাচ্ছেন।
সব ভুলে গেলে চলে না মাননীয়রা। অবিচারের বিচার ঠিকই আসে। সময় ঠিকই সেখানে নিয়ে যায়।
বলে রাখি, এর মধ্যে মন্দিরে আরও একবার কুরআন শরীফ রাখতে গিয়ে ধরা পড়েছেন একজন।
১৯ নভেম্বর হবিগঞ্জ জেলায় চৌধুরী বাজার এলাকায় ৫০ বছরের পুরনো (চৌধুরী বাজার সার্বজনীন পূজা মন্ডপে) কুরআন শরীফ রেখে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে মিজান (২৫) নামের একজন। স্থানীয় পুলিশের হাতে তুলে দেয় তাকে। (সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন)
এই ঘটনা নিয়ে তেমন কোনো বিশদ আলোচনা দেখা গেল না, কারও প্রতিবাদ দেখা গেল না। ধর্মানুভূতি যাদের মধ্যে প্রবল, তারাও মিজানের বিচারের দাবীতে রাস্তায় নামলেন না!
অথচ এই ঘটনার পর আবারও ধর্মান্ধদের সেই অত্যাচার, লুটপাট, হামলা হতে পারতো। কিন্তু ভাগ্যচক্রে সেটি হয়নি। একজন ইকবালের পর মাঠে নেমেছিল মিজান নামের আরেকজন। সম্প্রীতি নষ্ট করতে হয়তো এভাবে আরও অনেকেই তৈরি হচ্ছে। যা একেবারেই কাম্য নয়।
তাই দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি সরকার ও ক্ষমতাসীনদের উচিত ধর্মান্ধতা রুখতে নানা পদক্ষেপ নেয়া এবং এসব অপকর্মের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা। তা না হলে, সংখ্যালঘুরা এভাবেই নির্যাতিত হবে। এভাবেই একটা শ্রেণিকে টার্গেট করে আরেকটা শ্রেণি ধ্বংস ও দখলে লিপ্ত হবে।
সবশেষে কথা একটাই, 'সব ভালো হোক, পৃথিবীটা মানুষের হোক'।
(লেখক- সাংবাদিক)