আমরা কি আন্তর্জাতিক সহযোগীদের নির্বোধ মনে করি

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২২, ০৭:৫২ পিএম

আমরা কি আন্তর্জাতিক সহযোগীদের নির্বোধ মনে করি

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং সংস্থাটির সাবেক-বর্তমান বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এ বিষয়ে আমাদের বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর মন্তব্য পাওয়া গেছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, 'জাতিসংঘের কয়েকটি সংস্থা আমাদের গুম হওয়া ব্যক্তিদের একটি তালিকা দিয়েছেন। পরে দেখা গেছে তাদের মধ্যে অনেকের ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি হয়েছে। বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়ে তারা প্রতিবেদনটি তৈরি করে। এ বিষয়ে তাদের নিজেদের কোনো গবেষণা নেই।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা এ বিষয়ে পুলিশকে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলেছি। তখন পরিবারের সদস্যরা জানাবেন তাদের (নিখোঁজ ব্যক্তি) কখন, কীভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তারা ফিরে এসেছে কি না।' মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে তিনি বলতে চেয়েছিলেন, 'আসল উদ্দেশ্য মানবাধিকার কিংবা খুন-গুম নয়। আসল উদ্দেশ্য হলো, এসব উপায়ে চাপ দিয়ে কিছু ফায়দা নেওয়া যায় কি না সে চেষ্টা করা... যেহেতু আমরা কৌশলগত দিক দিয়ে ভালো অবস্থানে আছি, তাই কারও জন্য চক্ষুশূল হয়েছি। এ ছাড়া অনেক দেশ তাদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে গুমের প্রসঙ্গটি সামনে নিয়ে আসছে।'

'ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশ' শীর্ষক একটি সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে তিনি তথ্য-প্রমাণহীন  মন্তব্য করে ঠিক কী ধরনের 'ব্র্যান্ড ভ্যালু' তৈরি করতে চাইলেন?

আমরা মনে করি, তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত বহুপাক্ষিক জবাবদিহিতার প্রক্রিয়াকে উপহাস করেছেন, বাংলাদেশে যেখানে অন্যতম স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। পাশাপাশি তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে এমন একটি সময়ে তাচ্ছিল্য করেছেন, যখন বিষয়টিকে খুব সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে নেওয়া দরকার বলে প্রতীয়মান হয়। একই সঙ্গে তিনি উন্নত জীবনের খোঁজে সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে নির্মম ট্রাজেডির প্রতি অত্যন্ত অসংবেদনশীল মনোভাব দেখিয়েছেন।

ভূমধ্যসাগরে মর্মান্তিক সলিলসমাধি হওয়া মানুষদের বিষয়ে তিনি বলেছেন, 'পরে দেখা গেল' তাদের অনেকেই জাতিসংঘের 'গুম' হওয়া মানুষের তালিকায় ছিলেন।

তার কাছে কী এসব নামের কোনো তালিকা আছে? কখন এ তালিকা বানানো হয়েছে এবং কে বানিয়েছেন? তিনি কি এর সত্যতা যাচাই করেছেন? এবং কেন তিনি সেটি জনসম্মুখে প্রকাশ করছেন না? (৯ ফেব্রুয়ারি আমাদের পররাষ্ট্রসচিব গণমাধ্যমের কাছে জানান, বাংলাদেশ থেকে গুম হিসেবে জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত প্রায় ৮ থেকে ৯ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। তবে, এ তথ্যের সূত্র সম্পর্কে তিনি কিছু জানাননি। তার কথাগুলো ছিল অস্পষ্ট এবং শুনে মনে হয়েছে তার হাতে যে তথ্য আছে তা না জানিয়ে বরং তিনি যা শুনেছেন তা আমাদেরকে জানাচ্ছেন।)

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, 'আমরা পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি এবং তাদের অনুরোধ করেছি নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানতে যে, কখন এবং কীভাবে তাদের গুম করা হয়েছে।' অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তিনি কখনো এই পরিবারগুলোকে নিয়ে লেখা সংবাদপত্রের প্রতিবেদনগুলো দেখেননি, যেখানে জানানো হয়েছে কীভাবে তারা বছরের পর বছর অশ্রুসিক্ত চোখে তাদের কান্নায় ভেঙে পড়া কমবয়সী শিশুদের সঙ্গে করে নিয়ে প্রেসক্লাবে এসে প্রিয়জন হারানোর ঘটনার হৃদয়বিদারক বিবরণ দেন।

জাতিসংঘ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, 'জাতিসংঘের কিছু সংস্থা আমাদের একটি তালিকা দিয়েছিল।' ঘটনাচক্রে, উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে জাতিসংঘের গুমসংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ ডব্লিউজিইআইডি। এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের আওতায় কাজ করে এবং এতে বিশ্বের প্রতিনিধিত্বকারী ৫ জন স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞ আছেন। বর্তমান বিশেষজ্ঞরা ইতালি, লিথুয়ানিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, গিনি-বিসাউ ও আর্জেন্টিনার। আর্জেন্টিনার নাগরিক বর্তমানে এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।

প্রতিষ্ঠানটির সবশেষ প্রতিবেদন (২০২১) অনুযায়ী বাংলাদেশে ৭৬টি গুমের 'অমীমাংসিত' ঘটনা রয়েছে। প্রতিবেদনের ৬৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশে গুমের পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগের বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করছে, যে বিষয়টি তারা একই ধরনের প্রতিবেদনে বেশ কয়েক বছর ধরে তুলে ধরা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে উদ্যোগের ঘাটতি দেখা গেছে। এ প্রসঙ্গে ওয়ার্কিং গ্রুপ উল্লেখ করছে, তারা এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময়সীমার মধ্যে কোনো অমীমাংসিত ঘটনার বিষয়ে কোনো উত্তর পায়নি। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো এ ধরনের ঘটনা প্রকাশের পর সরকার এত দিনে শুধু একটি ঘটনার বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য দিয়েছে। ওয়ার্কিং গ্রুপ আশা করছে, তারা অমীমাংসিত ঘটনাগুলোর বিষয়ে যত দ্রুত সম্ভব তথ্য পাবে। গুমের ঘটনার অভিযোগের দ্রুত তদন্ত হতে হবে এবং দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে, বিশেষ করে যেসব ঘটনার সঙ্গে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) জড়িত।' ৬৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশে সরেজমিন পরিদর্শনের আগ্রহ পুনর্ব্যক্ত করছে, যে ইচ্ছার কথা ২০১৩ সালের পর থেকে একাধিকবার জানানো হয়েছে।'

ডব্লিউজিইআইডির প্রতিবেদন থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, তারা আমাদের সরকারের সঙ্গে ১৯৯৬ সাল থেকে বা অন্যভাবে বলতে গেলে, গত ২৬ বছর ধরে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। ২০১৩ সাল থেকে তারা বাংলাদেশ পরিদর্শন করতে চাইছে, কিন্তু তাদের সে অনুমতি দেওয়া হয়নি। যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডব্লিউজিইআইডির বিরুদ্ধে 'কোনো গবেষণা না থাকার' অভিযোগ তোলেন—এর উত্তরে বলা যায়, ৯ বছর আগে তারা অনুসন্ধানমূলক সফরের জন্য দেশে আসতে চাইলেও আমরা তাদের সে অনুমতি দেইনি। কেন? আমাদের লুকানোর কী আছে?

আমরা যাচাই করে জানতে পেরেছি, কমপক্ষে ৩ বার—২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সালের নভেম্বর এবং ২০১৫ সালের অক্টোবরে জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন এই ওয়ার্কিং গ্রুপের কাছ থেকে বার্তা পেয়েছে এবং উত্তরে জানিয়েছে, 'স্থায়ী মিশন সম্মানের সঙ্গে আশ্বস্ত করছে যে বার্তায় যা লেখা হয়েছে তা গ্রহণ করা হয়েছে এবং সেটিকে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় তদন্ত ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাঠানো হবে।'

তাহলে, ২০১৩ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত কী কী 'প্রয়োজনীয় তদন্ত ও ব্যবস্থা' নিয়েছি আমরা? প্রতিবেদনে পরিষ্কার বলা হয়েছে, 'কোনো অমীমাংসিত ঘটনার বিষয়ে উত্তর পাওয়া যায়নি' এবং '১৯৯৬ সাল থেকে শুধু একটি ঘটনার বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য দেওয়া হয়েছে।' ২৬ বছরে মাত্র একটি ঘটনা? ডব্লিউজিইআইডির প্রতিবেদনগুলোতে আলাদা করে র‍্যাবের নাম বারবার উঠে এসেছে, বিশেষ করে ২০১৩ সালের পর থেকে। কিন্তু যখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো, আমরা অবাক হয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। আমরা যদি আগে ডব্লিউজিইআইডির প্রতিবেদনগুলোকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতাম, তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, এই নিষেধাজ্ঞা এবং এর সঙ্গে আসা খারাপ ভাবমূর্তির বিষয়টিকে এড়ানো যেত। আমি মনে করি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দিতে দায়বদ্ধ, বিশেষ করে দেশের মানুষের কাছে। কারণ তারা ব্যাখ্যাতীতভাবে ২ দশকের বেশি সময় ধরে এবং বিশেষত ২০১৩ সাল থেকে এ বিষয়ে কোনো কাজই করেনি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার 'আসল কারণ' মানবাধিকার বা গুম নয় বরং 'আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা'। এ কথা বলার মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে অঙ্গুল তুলেছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছেন। আপনি যখন নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য আলোচনা করছেন—তখন এ ধরনের একটি কথা বলা কূটনৈতিক দৃষ্টিতে কতটা যুক্তিযুক্ত? বিশ্বের পরাশক্তিদের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সম্পর্কে একে অপরের ওপর চাপ সৃষ্টি করা খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয় এবং এটি জানেন না, এমন কেউ কী আছেন? কিন্তু মন্ত্রীর কাছে আমাদের প্রত্যাশা কী? কূটনৈতিক রীতিনীতি অনুসরণ করে পর্দার অন্তরালে আলোচনা, সূক্ষ্ম বার্তার আদান-প্রদান, তৃতীয় পক্ষের সহায়তা নেওয়া এবং বিভিন্ন ধরনের বৈঠক ও সফরের মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করার চেষ্টা করা নয়কি? মন্ত্রী যদি প্রকাশ্যে বলেন, আমরা 'চক্ষুশূলে' পরিণত হয়েছি, তাহলে ইতিবাচক সমাধান সম্ভব? এর আগে যখন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে গণতন্ত্র সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ জানায়নি, তখন তিনি বলেছিলেন খুব সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র শুধু 'দুর্বল' গণতন্ত্রের দেশগুলোকেই ডেকেছে। কূটনীতি বটে!

আমাদের সঙ্গে সাময়িকভাবে সমস্যা চলছে এরকম দেশগুলোর ব্যাপারে গণমাধ্যমের কাছে হেলাফেলা করে প্রতিক্রিয়া দেওয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগমূলক মন্তব্য করে কূটনীতি হয় না। বরং পরিপক্ব যোগাযোগের মাধ্যমেই তা সম্ভব। যেকোনো ধরনের জবাবদিহিতা এড়িয়ে যাওয়ার এই অসুস্থ অভ্যাস আমাদের বেশি দূর এগিয়ে যেতে দেবে না। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সাফল্যের কারণে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখানোর এই প্রবণতা শাঁখের করাতের মতো হতে পারে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশিও হতে পারে।

দয়া করে আন্তর্জাতিক সহযোগীদের বোকা বা নির্বোধ ভাববেন না। তাদের সঙ্গে আমাদের নিবির যোগাযোগ ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা ও এগিয়ে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

বিশেষ করে যখন আমরা একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার প্রত্যাশা করছি।

(লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার। লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে দ্য ডেইলি স্টারে)

Link copied!