বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। আমাদের প্রিয় খালাম্মার সাধারণ শেষ জন্মদিন। সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন আমাদের খালাম্মা। আমরা যাঁরা শেখ কামাল ভাইয়ের সাথে কিংবা আবাহনী ক্লাবের অফিসিয়ালস, সবাই ওনাকে ডাকতাম ‘খালাম্মা’ বলে। খালাম্মার সবচেয়ে বড় গুন ছিল, আমাদের সবাইকে তিনি সন্তানের মত ভালবাসতেন।
এমনও হয়েছে, রাতে আমরা কোনো কাজে গিয়েছি কামাল ভাইয়ের কাছে তিনতালায়, আর খাল্লামা টের পেয়ে গেছেন দোতালায়। ব্যস। না খেয়ে ওই বাড়ি থেকে আর বেরুনো যাবে না। আমি অসময়ের কথা বললাম এইজন্যে যে দিনে দুপুরে তো কথাই নেই। সত্যি কথা বলতে কি ওই বাড়ির, মানে ৩২ নাম্বার বাড়ির মানুষগুলো ছিল কেমন যেন সহজ সরল। তাঁরা যে বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা কিংবা প্রধানমন্ত্রীর পরিবার, তাঁদের সেই অহংকার ভাবসাব তার কিছুই ছিল না। এমনকি ওই বাড়ির সাঁজসজ্জা এসি কারপেটবিহীন ঘরগুলোও ছিল সাধারণ তাঁদের মতোই। আমার অবাক লেগেছিল দোতালায় বসে যে টিভি সেটটিতে বঙ্গবন্ধু কিংবা পরিবার মিলে তিনি যে টিভি দেখতেন, সেই টিভিটিও ছিল আমাদের বাসার মতই সাদা কালো সাধারণ।
খালাম্মার কথায় আসি।
খালাম্মা বাড়িতে এতোটাই সাধারণ বেশে থাকতেন যে, বাইরের মানুষের সাক্ষাৎ দিতে নিজেকে দামী শাড়ি কিংবা একটু সাঁজ গোছ কিছুই করতে পছন্দ করতেন না। খালাম্মা বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাকালে মাত্র দুই বার বিদেশ সফরে গিয়েছিলেন। একবার বঙ্গবন্ধুর চিকিৎসা করতে লন্ডন এবং সেই ট্রিপেই সুইজারল্যান্ড। আর একবার কোলকাতা। কোলকাতায় রাষ্ট্রীয় ট্যুরে তাঁর প্রোটোকল ছিল, ফাস্ট লেডির। কোলকাতা নেতাজি বিমানবন্দরে রাজধানী দিল্লী থেকে রিসিভ করতে এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বিদেশ সফরের কারণে খালাম্মাকে একটু ভালো শাড়ি, অল্প হিল যুক্ত স্যান্ডেল সু, আর একটু সাঁজতে হয়েছিল। সেটা ঠিক সাজগোজ বলা যায় না, তাতেই তিনি এতোটাই অস্বস্তিতে থেকেছেন যে রুমে গিয়ে হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন। যদিও পরিবারারের সবাই তখন খালাম্মাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। বঙ্গবন্ধুও হাল্কা টিপ্পনী কেটেছিলেন হাসুর মা কে নিয়ে।
কিন্তু এই মহিয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব আমাদের প্রিয় খালাম্মা এককভাবে সামলেছেন সন্তানদের আর পরিবারকে। বঙ্গবন্ধুর জন্য রাত নেই দিন নেই চিন্তা। বাড়িওয়ালারা সেই বিপদের দিনে বাড়ি ভাড়া দিতে চান না। সন্তানদের নিয়ে কত বিপদেই না তিনি সামলেছেন, তাঁর উপর স্কুল কলেজে সন্তানদের ভর্তি করতে কত্ত ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর জীবনের যে জার্নি, জেল জুলুম, রাজনৈতিক সভা সমাবেশ না করতে দেবার বিরুদ্ধে নূতন নুতন কৌশল বেড় করা পার্টি নেতা কর্মীদের কাছে তা পৌঁছানো।
খালাম্মা দেশ স্বাধীনের পর গণভবনে পরিবার নিয়ে একটু আরাম আয়েস করতে চাননি বলে থেকেছেন নিজের হাতে যোগালির কাজে সহায়তা করা ধানমণ্ডির প্রিয় ৩২ নাম্বারের বাড়িতে।
সেই প্রিয় বাড়িতেই নিজের জীবন দিলেন ঘাতকদের হাতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য একজন মুসলমান হিসেবে নিহতরা কবরবাসী হবার আগে গোসল কিংবা কফিনের কাপড়টুকুও পাননি।
আল্লাহ্ বারবুল আলামিন আমাদের মহিয়সী খালাম্মাকে বেহেশতবাসী করুন— আমিন!
পাভেল রহমান। ৯ আগস্ট ২২। ধানমণ্ডি, ঢাকা।