লাইফ সাপোর্টে চলে যাওয়া ঢাকাকে বাঁচাতে হবে

লুৎফর রহমান হিমেল

অক্টোবর ২৮, ২০২২, ০৫:২৯ পিএম

লাইফ সাপোর্টে চলে যাওয়া ঢাকাকে বাঁচাতে হবে

দেশের মধ্যে ভালো বাসস্থান সুবিধা কোথায়? উত্তর: ঢাকায়। দেশে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কোথায়? উত্তর: ঢাকায়। দেশে ভালো বিপণীবিতান, শপিং মলগুলো কোথায়? উত্তর: ঢাকায়। দেশে ভালো চিকিৎসা সেবা কোথায় মেলে? উত্তর: ঢাকায়। দেশে ভালো চাকরির সুযোগ সুবিধাগুলো কোথায়? উত্তর: ঢাকায়। দেশে বিদ্যুৎ-গ্যাস-ব্যবসাবাণিজ্যের সুবিধাগুলো বেশি কোথায়? উত্তর: ঢাকায়।

এ রকম আরও বহু সুযোগ সুবিধার কথা বলা যাবে যেসব শুধু এই ঢাকাতেই মেলে।

যদি সবকিছুর সুযোগ সুবিধা রাজধানী ঢাকাতেই জড়ো করে রাখা হয়, তাহলে দেশের সব মানুষ ত ঢাকার দিকে ছুটবেই। ছুটছেও। ছুটতে ছুটতে এই নগরী এখন মানুষের ভারে, সমস্যার চাপে ক্যুজো হতে বসেছে। গাড়িঘোড়ায় চলাচল তো দূরে থাক, এখন হেঁটে চলাচলও কঠিন হয়ে পড়ছে। ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে বসতি। ফলে রাজধানী নগরীটি হয়ে গেছে বসবাসের অনুপযোগী জটিলতম এক আবাসস্থল।

Dhaka City cover 1
ঈদ বা কোনো পার্বণ এলেই আমরা দেখি, ঢাকার মানুষ দলবেঁধে আনন্দ করতে নাড়ির টানে বাড়ি যায়। সেই আনন্দযাত্রা বেশিরভাগ সময় বিভীষিকায় পরিণত হয়। ছবি: দ্য রিপোর্ট

একটি দেশ যদি একটি মানবশরীর হয়, তাঁর মাথা বা মস্তিস্ক হবে তাঁর রাজধানী। রাজধানী যখন নানা সংকটে খাবি খায়, তখন গোটা দেশের স্বাভাবিক চলাচলও বিঘ্নিত হয়। দেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে। মূলতঃ ৪০০ বছর পুরনো ঢাকা নগরী এখন লাইফ সাপোর্টে চলে গেছে। ঢাকাকে সুস্থ্ করার জন্য মাঝেমধ্যে ডিটেইল এরিয়া প্লান বা ড্যাপ (বিশদ নগর পরিকল্পনা) নামের যেসব উন্নয়ন প্রেসক্রিপশন দেওয়া হচ্ছে, তাতে ব্যথা কিছুটা কমালেও রোগ সারাতে পারছে না।

পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ অতি ছোট একটি দেশ। সেই দেশের রাজধানী ঢাকা আরও ছোট্ট একটি শহর। প্রশাসনিক কাজ, দাপ্তরিক কাজ, ভালো চিকিৎসা, উচ্চশিক্ষা, কর্ম, চাকরি বা ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য মানুষ ঢাকাতে ছুটে আসে। মানুষের মনে ধারণা গেঁথে আছে, ঢাকায় টাকা ওড়ে। ঢাকায় গেলেই সফলতার দেখা মিলবে। ফলে তাঁরা ঢাকায় এসে মনের সুখে গান হায়: ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে...। কিন্তু কিছুদিন পরই তাঁদের ভুল ভাঙে!

ঢাকার অবস্থা এখন এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে, এই নগরীর কপালে কখনো পৃথিবীর প্রথম কখনো বা দ্বিতীয় দূষিত শহরের খেতাব জোটে। বসবাসযোগ্য শহরের সারিতেও রাজধানী ঢাকার অবস্থান একদম তলানিতে। স্বাধীনতার পর যে ঢাকায় মাত্র ১৬ লাখ মানুষের বসবাস ছিল, সে ঢাকায় আজ দুই কোটির বেশি মানুষের বসবাস। এতসংখ্যক মানুষের অন্ন, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ নানা মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খেতে হচ্ছে ঢাকাকে। ঢাকা কার্যতঃ এখন সমস্যার পাহাড় দিয়ে ঢাকা।

পৃথিবীর কোনো শহরের জনসংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে গেলে তাঁকে বলা হয় মেগাসিটি বা অতিমহানগরী। সে হিসেবে ঢাকা একটি মেগাসিটি সেই ১৯৮০ সাল থেকেই। ঢাকা মহানগরী এলাকার জনসংখ্যা এখন দুই কোটিরও ওপরে।

৩০৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে এখন ২৩ হাজার লোক বসবাস করছেন! বসবাসের উপযুক্ততার বিশ্ব সূচকে ঢাকার অবস্থা বেজায় খারাপ। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জনসংখ্যার অত্যধিক চাপ ঢাকাকে আজ এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে।

প্রতিদিন নানা কাজে সারাদেশ থেকে রাজধানীতে আসেন কম করে হলেও চার থেকে পাঁচ লাখ মানুষ। কাজ শেষে ফিরে যান তাঁরা। কিন্তু গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ ঢাকায় থেকে যান। তাঁরা আসেন একেবারেই থেকে যাওয়ার জন্য। কারণ, গ্রাম মানুষকে ধরে রাখতে পারছে না; কাজ নেই সেখানে। কৃষিকাজ এখন অনেক হিসাব কষে করা হয়। ফলে গ্রামের মানুষজন ছুটছে ঢাকার দিকে। ঢাকা সারাদেশের মানুষকে চুম্বকের মতো টানছে।

Dhaka City cover-3
রাজধানীর পথে গাড়ি-ঘোড়া তো বটেই, পায়ে হেঁটেও এখন চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। ছবি: দ্য রিপোর্ট

ঢাকাকে ঘিরে শাসন ও উন্নয়ন কেন্দ্রীভূত করার একটি প্রবণতা সেই পাকিস্তান আমল থেকেই চলে আসছে। আর এ প্রবণতার কারণে ঢাকায় অবস্থিত সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান ও তাঁদের প্রধান কার্যালয়, দেশ সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সশস্ত্র বাহিনীর সদর দফতরসহ নানা অফিস আদালত দেশের আপামর জনগণতে ঢাকামুখী করে তুলেছে।

ঢাকায় যানবাহনের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারেরও কম! শুনতে রসিকতা মনে হলেও সত্য, ঢাকায় বাসের চেয়েও সাইকেলের গতি এখন বেশি। মানুষের আধিক্য, গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, সংকীর্ণ অপরিকল্পিত রাস্তা— এরকম নানা বিষয় যানজটের জন্য দায়ী। যানজট নিরসনে গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে দিলে গাড়ির সংকটে পড়ে মানুষেরই ভোগান্তি হবে। ফলে এই নগরীর মানুষ কমানো ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য জনস্রোত ঢাকার দিকে আসাকে নিরুৎসাহীত করার পরিকল্পনা করতে হবে।

ঈদ বা কোনো পার্বণ এলেই আমরা দেখি, ঢাকার মানুষ দলবেঁধে আনন্দ করতে নাড়ির টানে বাড়ি যায়। সেই আনন্দযাত্রা বেশিরভাগ সময় বিভীষিকায় পরিণত হয়। বাস-ট্রেনের ছাদে, ট্রাকে, অ্যাম্বুলেন্সে, লঞ্চে গরু-ছাগলের মতো গাদাগাদি করে মানুষ বাড়ির পানে ছোটে! অথচ রাজধানী ঢাকার সুযোগ সুবিধাগুলো বাকি সাত বিভাগে ছড়িয়ে দিলে সাতগুণ চাপ কিন্তু কমে যেত এই ঢাকার ওপর থেকে। দীর্ঘদিন কথাগুলো আলোচনা হয়, বিকেন্দ্রীকরণের কথা উঠে। কিন্তু কেউ শোনে না।

এখনই ঢাকামুখী এই জনস্রোত যদি থামানো না যায় তাহলে ভবিষ্যতে ঢাকা মহানগরী একটি অকার্যকর নগরীতে পরিণত হবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে দীর্ঘদিন ধরে বারবার উঠে এসেছে এসব আশংকার কথা। তাদের মতে, এরপরও যদি সরকারি কর্তাদের টনক না নড়ে তাহলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলেও মনুষ্যসৃষ্ট কারণেই একদিন পরিত্যক্ত হতে পারে এই ঢাকা।

ঢাকাকেন্দ্রিক একমুখী উন্নয়ন বন্ধ করে বিভাগীয় এবং জেলা শহরগুলোতে উন্নত শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান এবং উন্নত জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যাতে সামান্য কারণে মানুষকে ঢাকায় আসতে না হয়। গণতান্ত্রিক দেশে এ কথা বলা যায় না যে, বর্তমানে যাঁরা ঢাকায় আছেন এর বাইরে আর কেউ এসে এখানে বসবাস করতে পারবেন না। কিন্তু যাঁরা ঢাকার বাইরে আছেন তাঁদের জন্যও ঢাকার সমান সুযোগ তৈরি করে ঢাকায় আসার প্রয়োজনীয়তা কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশে প্রতিটি জেলা ও বিভাগ নিজস্ব সম্পদে সমৃদ্ধ। ঢাকাকে ভেঙে দেশের প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করে যদি নতুনভাবে সাজানো যায়, তবে ঢাকার ওপর চাপ কমে যাবে। ঢাকা আবার প্রাণ ফিরে পাবে। ঢাকাতেই সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, ঢাকাতেই যেতে হবে— এই ধ্যানধারণা থেকে জনগণকে বের করে আনতে হবে। তাঁর জন্য যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ঢাকার বাইরেও ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করতে পারলে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানও বৃদ্ধি পাবে। এখনই এই ঢাকাকে নিয়ে না ভাবলে লাইফ সাপোর্টে থাকা এই নগর একদিন কোমায় চলে যাবে।

লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট। ইমেইল: lutforrahmanhimel@gmail.com

Link copied!