সাগরে বাড়ে পানি ঢাকায় বাড়ে মানুষ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২২, ০৩:২৭ পিএম

সাগরে বাড়ে পানি ঢাকায় বাড়ে মানুষ

ভালবাসার বাড়াবাড়ি বেশি হলে পরে যা হয় আরকি, আমাদেরও বোধ হয় হয়েছে তা-ই। নাহলে ২০—৩০ লাখ মানুষের বসবাসের উপযোগী এই ঢাকা শহরে কেন দুই—আড়াই কোটি মানুষ এসে বসবাস করবে? কেন তাদের দেহখানি বহন করতে ১৫ লাখ রিকসা, পাঁচ—ছয় লাখ প্রাইভেট কার দিনমান ব্যস্ত থাকবে? অন্য যানবাহনের কথা –ননা হয় বাদই দিলাম।

সারাদেশ থেকে প্রতিদিন পঙ্গপালের মতো ঢাকায় ছুটে আসছে মানুষ। সংখ্যাটা নাকি দিনে গড়ে তিন—চার হাজার করে! এরা নাকি ঢাকায় ঢোকে কিন্তু বের আর হয় না! ঢাকার নাম সার্থক করতেই কিনা কে জানে, লিটারেলি মানুষ দিয়েই ঢেকে যাবে বোধ হয় এই ঢাকা। রাজনীতিকদের ভাষায় এ শহর নাকি তিলোত্তমা ঢাকা। এখন এই তিলোত্তমা শহরে পথ চলতে গেলে মানুষে মানুষে গায়ে গায়ে লেগে যায়। দু চার বছর পর আর লাগালাগি নয়, মানুষজন পরস্পরের সাথে একেবারে লেপ্টালেপ্টি করে পথ চলবে! আসলে তখন পথে চলতে হবে না, রাস্তায় দাঁড়ালে পেছনের লোকই ঠেলে নিয়ে যাবে সামনের জনকে! পরে সুবিধা মতন গন্তব্যস্থানে হড়কে পড়তে ডানে কিংবা বাঁয়ে টুপ করে একখান লম্ফ দিতে হবে গন্তব্যে পৌঁছানো নাগরিকদের! একেবারে অটোম্যাটিক এক সিস্টেম দাঁড়িয়ে যাবে তখন!

প্রতিদিন কতো মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করছে তার আনুমানিক হিসাব থাকলেও সঠিক কোনো হিসাব নেই কারুর কাছে। হিসাবটা করবে কে? কার এত ঠেকা পড়েছে? আর হিসাবের দরকারটাই বা কি? মানুষ ভালোবাসার টানে এই নগরের দিকে ছুটে আসছে, তাদের সংখ্যা হিসাব করা বেরসিকের মতো একটি কাজ। দাওয়াতে কতোজন মেহমান এসেছে, এমন হিসাব করা বাঙালির সাথে যায় না। এটি একেবারেই ছোটোলোকি কাজ। সুতরাং জিও কিংবা এনজিও, কেউই আমরা ঢাকামুখী মেহমানদের সংখ্যা হিসাব করবো না। করা উচিতও নয়। বরং আমরা বলবো, জিও ভাই জিও। ঢাকা এসে জিও।

অতীত থেকে বর্তমান সকল সরকারই এ দেশের সাধারন মানুষদেরকে ভয়ানক ভালোবেসেছে, এখনও ভালবাসে এবং ভবিষ্যতেও বেসে যাবে। এই ভালবাসার সুনামির চোটে সাধারন মানুষজন প্রায়শই ভেসে যায়! যার কারণে সকল সরকার মফস্বল ও গ্রামের মানুষদের এই ঢাকায় আবাসন করে দিতে অঘোষিত এক মিশনে নেমেছে। সরকারগুলো মনে মনে হয়তো বলে, ধান, পাট, পেঁয়াজ, রসুনের চাষ রাখেন, ওসব আমদানী করবো আমরা। চাষাভূষা পরিচয় রেখে ছুটে আসুন নিয়নবাতির ঝলমলে এই ঢাকা শহরে। নাগরিক হোন। এই ঢাকাতে সকল সুবিধার পসরা সাজিয়ে রেখেছি। আসুন আর এসে সুখে স্বাচ্ছন্দে বসবাস গড়ুন এই জনারণ্যে। চাষাভূষার পরিচয় বাদ, হয়ে যান উড়াল সড়ক আর নিয়নবাতির নগরের গর্বিত নাগরিক।

মানুষ বোধ হয় এই ভালবাসার ডাকেই এই নগরীর দিকে ছোটে। এই প্রক্রিয়ায় পারলে দেশের ১৮—১৯ কোটি মানুষকে এই ঢাকায় এনে জায়গা করে দেয় সরকার মহোদয়েরা। মুরগী যেমন তার দুই পাখনার নিচে তার সকল ছানাকে আশ্রয় দেয়, ঠিক সেইভাবেই বিভিন্ন সময়ের সরকার মহোদয়েরাও যেন দেশের সব মানুষকে এই নগরীতে এনে জড়ো করে তার সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় দেওয়ার মহা মেগা পরিকল্পনা নিয়ে চলেছেন! নাহলে দেশের অন্যসব বিভাগীয় শহরে যাবতীয় সুযোগ সুবিধার আয়োজন কেন তারা করছেন না? কেন করবে বলি শুনি! মুরগির ছানাপোনাগুলোকে পাখনার নিচে রেখে চোখে চোখে রাখার চেয়ে নিরাপদ স্থান আর আছেটা কোথায়! গণমানুষের প্রতি রাষ্ট্র ও সরকার মহোদয়গণের ভালোবাসা প্রকাশের এমন নজির পৃথিবীতে বিরল।

ঢাকায় মানুষ বাড়ানো মানেও উন্নয়ন কিনা, আমরা জানি না। নাহলে সরকার কেন বিকেন্দ্রীকরণ করে না। সব মানুষকে ঢাকায় এসে বসবাস করার উৎসাহ কেন দেয়! এটাও উন্নয়নমুখী কোন পরিকল্পনা কিনা, সন্দেহ হয় আমাদের।

এই শহরে দুই দশক আগেও এত ঘনবসতি ছিল না। মনে পড়ে, এই সেদিনকার নব্বই দশকের কথা। তখনকার কালে রাত আটটা বাজলেই পথঘাটে জনমানুষের সেভাবে দেখা মিলত না। একটা বিড়ি ফুঁকতে গিয়ে নিজের পকেটে দেশলাই না থাকলে আগুন পেতে আশপাশে যতদূর চোখ যেত, কারুর দেখা মিলত না! ভাল করে আশপাশে দৃষ্টি দিলে দেখা যেত, ও—ই ত দূরে আবছা মতন কেউ একজন হেলেদুলে কিংবা অন্যকোনো বাইসাইকেলে এগিয়ে আসছে তার গন্তব্যে। তিলোত্তমা নগরীর এমন জনমানবশূণ্য দশা ভারী অন্যায়! একটি বিড়ি ফুকতেও সন্ধ্যারাতে রাস্তাঘাটে জনমানুষ মিলবে না, এমনটা মেনে নেওয়া যায় না!

এই কষ্ট লাঘবের জন্যই বোধ হয় সেই ঢাকা মাত্র এই দুই যুগের ব্যবধানে জনারণ্যে পরিণত করেছেন আমাদের সরকার মহোদয়েরা। সরকারের ভালোবাসার টানে এই রাজধানীতে এখন মানুষ আর মানুষ। বিড়ি খাওয়ার আগুন নয়, চাইলে শহর জ্বালিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত মূহর্তেই তারা করে ফেলতে পারবেন, এত মানুষ এখন এ নগরে। সাগরে পানির বাড়বাড়ন্ত আর ঢাকায় মানুষের ঘনবসতি দুটিই ফুলেফেঁপে উঠছে। আমরা জনসংখ্যার ঘণত্বে বিশ্ব রেকর্ড করে ফেলেছি। ঢাকা এখন অতিজনবসতির কারণে অতিমহানগরী। জনসংখ্যার বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম শহর। আর জনঘনত্ব? এই বিচারে এক নম্বর আসনটি আমাদেরই। ৩০৬ বর্গকিলোমিটারের ছোট এই শহরটিতে সোয়া দুই কোটিরও বেশি মানুষের বাস! অর্থাৎ বর্গকিলোমিটার প্রতি ২৩ হাজার মানুষ এখন এ শহরে!

বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান শেষের দিক দিয়ে প্রথম দিকে, মানে সমালোচকরা বলেন তলানিতে। ১৪০টি শহরের মধ্যে আমাদের রাজধানীর অবস্থান নাকি ১৩৭ নম্বরে। রুল নম্বর উল্টো করে বললে চার নম্বরে আছি আমরা। গত কয়েক মাস ধরে বায়ুদূষণে টানা এক নম্বর স্থান দখল করে আছে তিলোত্তমা এই নগরী। এ অবস্থায় আমাদের সরকার মহোদয়েরা, কর্তৃপক্ষগণ এবং সংশ্লিষ্টরা আরেকটু চেষ্টা করলেই ঘনবসতির রেকর্ডের পাশাপাশি বসবাস অযোগ্যের ক্ষেত্রেও রুল নম্বর এক—এ নিয়ে যাওয়ার রেকর্ড করতে সক্ষম হবো আমরা। রেকর্ড যে রকমই হোক, এক নম্বরে থাকাই বড় কথা।

লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট

 

Link copied!