মিয়ানমারের রাজনীতিতে সামরিক শাসন একটি পরিচিত এবং অবশ্য আলোচ্য বিষয়। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো স্থিতিশীল সময় পাওয়া যাবে না যখন সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল না। দেশটিতে সম্প্রতি সংঘটিত সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচনের রায়কে অবজ্ঞা করা হয়েছে, কিন্তু ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের এমনই একটি রায়কে নস্যাৎ করেছিল সেনাবাহিনী। বলতে গেলে, স্টেট কাউন্সিলর পদ নিয়ে সু চি'র গত মেয়াদের শাসনটি মিয়ানমারের ইতিহাসে একমাত্র স্তিতিশীল সরকার, যদিও তা সেনাবাহিনীর প্রভাবমুক্ত ছিল না। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যুগেও সেনাবাহিনী মেনে নিতে পারে না, তাদের হাত থেকে ক্ষমতার রাশ আলগা হচ্ছে। জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণে আপাত ব্যবস্থা হিসেবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শ্রদ্ধার ইতিহাস মিয়ানমারের সংস্কৃতিতে গড়েই ওঠেনি। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্তি লাভের পর রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বাদই পায়নি তারা। দেশের জনগণের কাছে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবেশ বড্ড অচেনা। ধ্রুব সত্যটি হলো, স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শূন্যতাই দেশটির যাবতীয় সমস্যার মূলে। সর্বশেষ অভ্যুত্থান এবং অতীতের সেনাপ্রভাব যা রেখে গেছে সেসব হিসেবের খাতার উপাদান বিস্তর।
অভ্যুত্থান কি সু চি'র বৈশ্বিক ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করবে?
রোহিঙ্গা নির্যাতনকে কেন্দ্র করে অং সান সুচির ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে বেশ ধাক্কা খেয়েছে, এমনটা সকলেরই জানা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, সংস্থাসহ বিভিন্ন দেশের কাছে মিয়ানমারের জনগণের নেত্রী হিসেবে সু চি'র গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। সেনাশাসনের বিরুদ্ধে ১৯৮৯ সাল থেকে ২০১০ অব্দি সময়ের ১৫ বছরই তিনি বন্দী ছিলেন তিনি। এ সময়ে তাঁকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একজন সমীহ জাগানিয়া লড়াকু প্রতিনিধি হিসেবে দেখা হতো। তাঁর ধারাবাহিকতায় বন্দীদশা থেকে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন। কিন্তু রাখাইন প্রদেশের মুসলিম গোষ্ঠীর ওপর মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে তাঁর নীরবতা ও আংশিক সমর্থন সেই প্রতিচ্ছবিকে ভুল প্রমাণ করেছে। তবে আবারো সংঘটিত সামরিক শাসেনের মাধ্যমে সু চি'র হৃত ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার হবে, এ কথা সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে। অং সান সু চি'র ওপর নতুন করে আরোপ করা গৃহবন্দীত্বের খড়গ, তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ ও তাঁর সপক্ষে উঠে আসা জনরায়কে প্রত্যাখানের মধ্য দিয়ে সু চি বিগত সময়ে তার যাবতীয় বিতর্কিত ভূমিকাকে প্রশ্নহীন থাকার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। সু চি'র বন্দীত্বই এখন বিশ্ববাসীর কাছে ইস্যু, রোহিঙ্গা বা অন্য কোনোটি নয়! আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীও সেদিকেই খেয়াল করবে, হয়তো সেটাই নিয়তি। কিন্তু ব্যক্তি ও রাজনীতিক হিসেবে অং সান সু চি নিজে কী 'মানবাধিকার' শব্দটির প্রশ্নে সঠিক ছিলেন? নিশ্চয়ই না। ২০১৫ থেকে বন্দীত্বের আগ পর্যন্ত পদে পদে আপোষ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বের বিগত সময়ের সংক্ষিপ্ত শাসনে দেশটির কারেন, কোচিন, রোহিঙ্গাসহ ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর অধিকারের প্রশ্নে কোনো গণতান্ত্রিক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করতে পারেননি তিনি। সত্যিকার অর্থে, সু চি এতদিন সেনাবাহিনীর সকল কর্মকাণ্ডে প্রায় নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে গেছেন।মিয়ামারের জাতিগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে সবচেয়ে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিই প্রমাণ করে দেশটির জাতিগত বিরোধকে তিনি আসলে কোন চোখ দিয়ে দেখেন। অর্থাৎ তাঁর ভাবমূর্তিটি গড়ে উঠেছে, মিয়ামারের সেনাশাসনের কল্যাণে। মিয়ামারের ক্ষমতার সামনে সু চি'ই একমাত্র চ্যালেঞ্জ তাই তাকে নিবৃত্ত করতে হয় তাদের। সু চি'র জায়গায় অন্য যে কেউ থাকলেও তার মতো বৈশ্বিক ভাবমূর্তি গড়ে উঠতে পারতো। এবারও সেই ধারা অনুযায়ী যাবতীয় নেতিবাচক ভূমিকা সত্ত্বেও তার 'ইতিবাচক' ভাবমূর্তি ফিরে আসবে। এই বন্দীদশা ও সামরিক শাসন যত দীর্ঘ হবে তার এমন ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হবে।
গণতন্ত্রের শূন্যতার কারণে সু চি'ও পরীক্ষার মুখে পড়েননি
২০২০ সালের নভেম্বরে দেশটির নির্বাচনে সু চি'র দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) একাই ৮৭ শতাংশ আসনে জয়লাভ করে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া জাতীয় ও আঞ্চলিক পরিষদের সর্বমোট ১১১৭টি আসনে ৯২০টিই সু চি'র দল অধিকার করেছে। এই বিপুল জয়ের পেছনে সু চি'র ভূমিকা কী? কার্যত, এই প্রশ্ন করাই বোকামি। কারণ, সু চি একজন রাজনৈতিক দলের নেত্রী হিসেবে জনগণের কাছে কোনো পরীক্ষাই দেননি, দেওয়ার সুযোগও তিনি পাননি। কারণ, সেনাবাহিনীর জেনারেলদের রক্তচক্ষুর সামনে দাড়িয়ে লড়াই করছেন, এমনটাই তার সম্পর্কে মানুষের ধারণা। গণতন্ত্র নামক সোনার হরিণটি কেমন তার স্বাদ পাওয়ার প্রতীক্ষায় দিন পার করা মানুষ আশা করেন, তিনি সেই মানুষ যিনি তাদের সেই স্বাদ এনে দেবেন। তাই নির্বাচনে জিততে তার কোনো কৈফিয়ত, ভূমিকা কিংবা প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রয়োজন পড়েনি। সেনাবাহিনীও ক্ষমতার লোভে সু চি'কে সেই পরীক্ষার মুখে ফেলেননি। রাজনীতিতে তাঁর জন্য সবচেয়ে কঠিনতম এবং যথেষ্ট বিব্রতকর ছিল রোহিঙ্গা ইস্যু। এই একটি ইস্যুতে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে পরীক্ষার মুখে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু 'জনপ্রিয়' সু চি 'জনপ্রিয়তা' অটুট রাখতে ভোটের অঙ্ক ঠিকই কষতে পেরেছিলেন। তিনি ভোট হারানোর ঝুঁকি নেন নি। আধিপত্যবাদী ডানপন্থী জাতীয়তাবাদকে আশ্রয় করেছেন তিনি। যারা তাকে উদারবাদী গণতান্ত্রিক নেত্রী ভেবেছিলেন তাদের মুখে ছাই দিয়ে ২০১৫ সালের নির্বাচনের তুলনায় এবার আরো ভোট বাড়িয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার নরেন্দ্র মোদি, সদ্য বিদায়ী ডোনাল্ড ট্রম্প থেকে পাকিস্তানি সংখ্যাগুরু জাতীয়তাবাদী শাসকদের স্বগোত্রীয় তিনি। যাকে এক কথায় বলা হয়, 'লোকরঞ্জনবাদী' নেতা। জনগণের দুর্ভাগ্য কিন্তু সু চি'র সৌভাগ্য যে, শেষ বয়সেও নিরবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক পরীক্ষার মুখে পড়লেন না তিনি। মোটকথা, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সু চি'কে জনগণের কাছে একজন 'অতি মানবীয়' শাসক ও নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছেন যা তিনি নন।
কার্যত রাজনীতিশূন্য মিয়ানমার
১৯৪৮ সালে মিয়ানমারের স্বাধীনতা লাভের পর গত বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি কার্যত দেশটির ইতিহাসে দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন। আশ্চর্য হলেও এটি সত্য। এই দীর্ঘ সময়ে দেশটিতে প্রত্যক্ষ সামরিক প্রভাব ছিল নানা কায়দায়। এ পরিস্থিতিতে এনএলডি দলটি দুটি কারণে বেশ প্রভাববিস্তারকারী ও জনগণের আনুকূল্যে রয়েছে। প্রথম কারণটি হলো, মিয়ানমারের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ছিলেন সু চি'র বাবা অং সান। তার মেয়ে হিসেবে সু চি'র প্রতি ভাবাবেগ ইতিবাচক। মানুষ এখানে যতটা না এনএলডির প্রতি দুর্বল তার চেয়ে কয়েকগুণ দুর্বল অং সান সু চি'র প্রতি। গত নির্বাচনে মোট ৮৭টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল। অথচ, নির্বাচনে এসব দলের বিপরীতে সেনাবাহিনী প্রভাবিত দল ইউনাইটেড সলিডারিটি ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) তো লড়াই করতে পারেই নি, বাকি দলগুলোর হিসেবের খাতাে এক প্রকার শূন্য। মূলত, ইউএসডিপি নিজেদের দ্বিতীয় বৃহৎ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। কিন্তু কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একগুচ্ছ রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি প্রয়োজন। এছাড়া মিয়ানমার বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীর একটি দেশ। এখানে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ও অন্য আত্মপরিচয়ের গোষ্ঠীভুক্ত জনগণের মধ্যে মতপার্থক্য দীর্ঘদিনের। বহুমতের বাস্তব উপস্থিতি থাকলেও রাজনীতিতে তার নজির নেই। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে, সেনাবাহিনীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণবাদ মিয়ানমারকে রাজনীতিশূন্য একটি রহস্যময় দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সু চি একজন 'অতি মূল্যায়িত' শাসক
সু চি হচ্ছেন মিয়ামারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। এ জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের মোট জনগণের ৬০-৬২%। এর বাইরে বাকিরা বিভিন্ন আদিবাসী, নৃতাত্ত্বিক ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর। এসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোচিন, কারেন, মন, ওয়া জাতিগোষ্ঠীর বিদ্রোহীরা বহুদিন থেকে আত্ননিয়ন্ত্রণ ও স্বীকৃতির দাবিতে লড়াই করে আসছে। এ পর্যন্ত এসব জাতিগোষ্ঠীর দাবি-দাওয়া কিাংবা চাওয়া-পাওয়ার মূল্য দেয়নি সামরিক কর্তৃত্ব। দেশটির জনগণের একটি অংশ মনে করে, অং সান সু চি এসব জাতিগোষ্ঠীকে এক সুতোয় গেঁথে ফেলতে পারবেন। ২০১১ সালে তার মুক্তিলাভের পর থেকে দেশের অভ্যন্তরের বিদ্রোহীরা অনেকেই এমন কিছুই মনে করতেন। বিশ্ববাসীও তাই ভাবতেন। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রশ্নে তার অবস্থান ডানঘেষা 'প্রতিক্রিয়াশীল' ও 'আধিপত্যবাদী'। একজন উদারবাদী ও মানবাধিকার চেতনা সম্পন্ন নেতার পরিচয়ের খোলস ছেড়ে অচিরেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ বার্মিজদের মনোভাবের সমান্তরালে চলতে শুরু করেছেন তিনি। তিনি ভোটের রাজনীতির একজন পাকা খেলোয়ারই হতেন যদি সুযোগ পেতেন।
সহসম্পাদক, কালের কণ্ঠ