জুলাইয়ের শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা বৈষম্যের প্রতিবাদে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন ক্রমান্বয়ে শেখ হাসিনার পদ ত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে পরিণত হতে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে পদত্যাগপত্রে সই করার পর দেশ ছাড়েন। বর্তমানে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। অপরদিকে বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের পরামর্শক্রমে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের প্রধান ড. ইউনূসসহ অন্যান্য উপদেষ্টারা এরই মধ্যে শপথ নিয়েছেন। তাদের জীবনী ও পেশাগত পরিচয় নিয়েই দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের এই আয়োজন:
আরও পড়ুন: শপথ নিলেন ড. ইউনূসসহ উপদেষ্টারা
ড. মুহাম্মদ ইউনূস
বিশিষ্ট সমাজসেবক ও সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবেও জনপ্রিয় ব্যক্তি নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠা ও ক্ষুদ্রবিত্ত ধারণা প্রবর্তনের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রাখা হয়েছে।
সালেহ উদ্দিন আহমেদ
অর্থনীতিবিদ হিসেবে সুপরিচিত সালেহ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। ২০০৫ সালের ১ মে থেকে ২০০৯ সালের ৩১ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
সালেহ উদ্দিনের জন্ম পুরান ঢাকায় হলেও পৈর্তৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরে। ১৯৬৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ১৯৬৯ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপর কানাডার হ্যামিল্টন শহরস্থিত ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে যথাক্রমে ১৯৭৪ ও ১৯৭৮ সালে আবারও স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক (লেকচারার) হিসেবে কর্মজীবনের শুরু করেন। পরবর্তীতে পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। একপর্যায়ে ঢাকার সহকারী কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। এ ছাড়া দীর্ঘদিন পিরোজপুর জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন এই অর্থনীতিবিদ। ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর রিসার্চ অন হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্টেও কাজ করেছেন তিনি। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সঙ্গে সংস্থাটি একীভূত হয়। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমন্বিত গ্রামীণ উন্নয়ন কেন্দ্রেও কাজ করেছেন সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ একাডেমি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি।
১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এ ছাড়া ১৯৯৮ সালে ব্র্যাকে উপ-নির্বাহী বা ডেপুটি এক্সিকিউটিভ হিসেবেও নিয়োজিত হয়েছিলেন।
গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমেদের অবসর গ্রহণের পর ২০০৫ সালের ১ মে থেকে ২০০৯ সালের ৩১ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিযুক্ত হন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নবম গভর্নর হিসেবে অবসর গ্রহণের পর অর্থনীতিবিদ সালেহ উদ্দিন আহমেদ ২০০৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনায় নিয়োজিত হন। ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ব্যবসায়িক অধ্যাপক ছিলেন। এরপর যোগদান করেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে। এ ছাড়া গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি হিসেবেও নিয়োজিত রয়েছেন তিনি।
২০২০ সালের আশা ইন্টারন্যাশনালের স্বাধীন পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন। সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাকশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং এনজিও ফোরামের সাধারণ কমিটির সদস্য। গ্রামীণফোনের একজন স্বাধীন পরিচালক। এ ছাড়া সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির জার্নাল অব আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস বিভাগের উপদেষ্টা হিসেবেও নিয়োজিত রয়েছেন।
আসিফ নজরুল
আসিফ নজরুল একাধারে লেখক, ঔপন্যাসিক, রাজনীতি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং কলামিস্ট। কর্মসূত্রে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক। টেলিভিশনে টক শো ও সংবাদপত্রে সাহসী কলাম লেখার ক্ষেত্রে তিনি এদেশের রাজনীতি সচেতন মানুষের কাছে বিশেষ স্থান ধরে রেখেছেন। একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ১৯৮৬ ও ১৯৮৭ সালে যথাক্রমে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন আসিফ নজরুল। ১৯৯৯ সালে সোয়াস (স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ) ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে তার পিএইচডি সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে জার্মানির বন শহরের ইনভায়রনমেন্টাল ল’ সেন্টার থেকে পোস্ট ডক্টরেট ফেলোশিপ অর্জন করেন তিনি। কলামিস্ট আসিফ নজরুল স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে একজন কমনওয়েলথ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরুর আগে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সাংবাদিকতা করেছেন কিছুদিন। কিছু সময়ব্যাপী তিনি সরকারি চাকরি অর্থাৎ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মানবাধিকার, আইনের শাসন বা পরিবেশগত সমস্যার ইস্যুতে তাকে প্রায়ই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেখা যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শক বা কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে এই রাজনীতি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞের।
আদিলুর রহমান খান
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সমধিক পরিচিত মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান খান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যয়ন করেছেন। ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে স্বৈরাচার হোসাইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরাশাদ শাহীর পতনের পর অপ্রত্যাশিতভাবে ক্ষমতায় আসেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এই সরকারের শাসনামলেই ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর সুশীল সমাজের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে গড়ে তোলেন মানবাধিকার সংস্থা অধিকার।
মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমানকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
পরিবেশবিদ হিসেবেই সমধিক পরিচিত সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ১৯৬৮ সালের ১৫ জানুয়ারি হবিগঞ্জ জেলার একটি মুসলিম পরিবারে জন্ম তার। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও হলিক্রস কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পেশাগত জীবনে সৈয়দা রিজওয়ানা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। এ ছাড়া বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী।
এম সাখাওয়াত হোসেন
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন ১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তেজগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পর ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের করাচির একটি স্কুল থেকে এসএসসি ও করাচি ইসলামিয়া বিজ্ঞান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন এই সামরিক ব্যক্তিত্ব। করাচি ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নকালীনই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান, ১৯৬৬ সালে কমিশন লাভ ও ১৯৭১ সাল পর্যন্ত শিয়ালকোটে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশে ফিরে আসেন ১৯৭৩ সালে। এ সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজর পদমর্যাদায় কুমিল্লা সেনানিবাসে যোগদান করেন সাখাওয়াত হোসেন। সেনাবাহিনীর চাকরি ও নির্বাচন কমিশন থেকে অবসর গ্রহণের পর জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি। সংবাদপত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক হিসেবে প্রায়ই তার কলাম প্রকাশ হতে দেখা যায়।
মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ
সরকারি চাকরিতে কোটা বৈষম্যের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে দুজন মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে তারা দুজনেই সমধিক পরিচিত। নাহিদ ইসলামের জন্ম ১৯৯৮ সালে। তার বাবা শিক্ষক। মা গৃহিণী। মা-বাবা-ছোট ভাইকে নিয়ে নাহিদ ইসলামের পরিবার। সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়ন করছেন তিনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদের পৈর্তৃক নিবাস কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আকুবপুর গ্রামে। বাবা বিল্লাল হোসেন ও মা রোকসানা বেগম। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে উচ্চমাধ্যমিক অধ্যয়নকালীন তিনি বিএনসিসি ক্লাবের প্লাটুন সার্জেন্ট ছিলেন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে (২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ) অধ্যয়নরত রয়েছেন আসিফ মাহমুদ।
এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে অরও রয়েছেন পররাষ্ট্র ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সাবেক রাষ্ট্রদূত সুপ্রদীপ চাকমা, বেসরকারি সংস্থা উবিনীগের (উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা) নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায়, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক নায়েবে আমির আ ফ ম খালিদ হাসান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরজাহান বেগম, ব্রতীর নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ ও ফারুক-ই-আযম।