পুরো নাম তার আবু নজীর মোহাম্মদ ফতেহ আলী খান (১১ মার্চ ১৯২৩ - ১২ এপ্রিল ১৯৭৫)। যিনি ফতেহ লোহানী নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি একাধারে একজন চলচ্চিত্র অভিনেতা, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, অনুবাদক, লেখক ও সাংবাদিক ছিলেন। দক্ষ আবৃত্তিকার হিসেবেও প্রশংসিত ছিলেন। তিনি ৪৪ টি চলচ্চিত্রে ও অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি মেধা ও প্রজ্ঞার ছাপ রেখে গেছেন। অভিজাত ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এক অভিনেতা ছিলেন তিনি। একজনের ভেতরে বহুগুণের এমন সম্মিলন এ দেশে খুব কম শিল্পীরই ছিল।
জন্ম ও শৈশব
ফতেহ লোহানী ১১ মার্চ ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন বৃহত্তর পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমায় (বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলায়) এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আবু সাঈদ মোহাম্মদ সিদ্দিক হোসেন খাঁ (১৮৯২-১৯২৯) যিনি আবু লোহানী নামে অধিক পরিচিত একজন সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি তৎকালীন কলকাতার বিখ্যাত ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা দ্য মুসলমান (১৯০৬) এর সহকারী সম্পাদক ছিলেন এবং মাতা ফাতেমা লোহানী কলকাতা করপোরেশন স্কুলের শিক্ষিকা ও লেখিকা ছিলেন।
শিক্ষাজীবন
মাত্র আট বছর বয়েসে বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর মায়ের তত্ত্বাবধানে কলকাতায় ছেলেবেলা ও শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়। লোহানী কলকাতার সেইন্ট মেরিজ ক্যাথেড্রাল মিশন হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, রিপন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করেন। এরপরে ১৯৫০-এ তিনি লন্ডনে পাড়ি জমান এবং ওল্ডভিক থিয়েটার স্কুলে নাট্য প্রযোজনা বিষয়ে দুবছরের কোর্স সম্পন্ন করেন। সে সময় ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সদস্য হিসেবে তিনি চলচ্চিত্র বিষয়েও অধ্যয়ন করেন।
কর্ম জীবন
অভিনয় ও পরিচালনা
কিশোর বয়সেই কলকাতায় মুকুন্দদাসের স্বদেশী যাত্রা দেখে মুগ্ধ হয়ে অভিনয়ের প্রতি অনুরাগী হন। কলকাতার স্কুলে অধ্যয়নকালে তিনি প্রথম অভিনয়ের সাথে সম্পৃক্ত হন। তিনি কৌতুকাভিনয় ও আবৃত্তি করতেন। রিপন কলেজে পড়ার সময় লোহানী বেশকিছু বাংলা ও ইংরেজি মঞ্চনাটকে অভিনয় করেন। কলেজে অভিনীত তার প্রথম নাটক বনফুল রচিত শ্রী মধুসূদন। এ নাটকে তিনি মধুসূদনের চরিত্রে অভিনয় করেন। সেসময় তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ উৎপল দত্ত পরিচালিত হ্যামলেট নাটক, এতে তিনি হ্যামলেটের পিতার ভুতের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
পরবর্তীতে তিনি শৌখিন নাট্যগোষ্ঠী ও সাধারণ রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হন। সেসময় তিনি সিরাজউদ্দৌলা নাটকটি পরিচালনা ও এতে অভিনয় করেন। বাণী থিয়েটার এর মঞ্চে রামের সুমতি নাটকে কিশোর রামের ভূমিকায় অভিনয় করেন। পেশাদার নাট্যগোষ্ঠী ‘আলোক তীর্থ’ এর উদ্যোগে রঙমহল-এ মঞ্চস্থ হেমেন রায়ের নর-নারী নাটকে তার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক ও চলচ্চিত্রকার বিমল রায় তাকে হিন্দি চলচ্চিত্র হামরাহী (১৯৪৫)-র একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেন। এ চলচ্চিত্রে তিনি কিরণ কুমার নামে অভিনয় করেন। একই বছরে তিনি উদয়ন চৌধুরী (ইসমাইল মোহাম্মদ) রচনায় ও পরিচালনায় জোয়ার টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৪৬ সালে হিমাদ্রি চৌধুরী (ওবায়েদ-উল হক) রচনা, প্রযোজনা ও পরিচালনায় দুঃখে যাদের জীবন গড়া চলচ্চিত্রে প্রতিনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯৪৭ সালে কলকাতায় অখিল নিয়োগী পরিচালিত মুক্তির বন্ধন চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
দেশবিভাগের পরে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫৭ সালে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (এফডিসি) প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসেন। ওই বছরেই তিনি আসিয়া চলচ্চিত্রের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি পরিচালনা করলেন আকাশ আর মাটি চলচ্চিত্রটি। চলচ্চিত্রটি ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায়। এ চলচ্চিত্রে নায়িকা হিসেবে সুমিতা দেবী ও নায়ক হিসেবে প্রবীর কুমার ও আমিন অভিনয় করেন৷ এটি ছিল তার পরিচালিত প্রথম পূর্নদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও এফডিসি থেকে নির্মিত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। পরের বছর ১৯৬০ সালের ৪ নভেম্বর আসিয়া চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রতেও সুমিতা দেবী-প্রবীর কুমার জুটি অভিনয় করেন। এ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ১৯৬০ সালে শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার ও পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সম্মানজনক নিগার পুরস্কার লাভ করেন।
ঢাকাই চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে ফতেহ লোহানীর অভিষেক ঘটে ১৯৬৪ সালে মহিউদ্দিন পরিচালিত রাজা এলো শহরে এর মাধ্যমে। এ চলচ্চিত্রে তিনি খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন ও এর মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। একই বছর বেবি ইসলাম পরিচালিত তানহা উর্দু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৬৫ সালে তার পরিচালিত প্রথম উর্দু চলচ্চিত্র সাত রং মুক্তি পায়। ১৯৬৬ সালে জহির রায়হান বাংলার প্রচলিত লোককাহিনী ও হিন্দু পুরাণ মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা-লখিন্দর এর কাহিনী অবলম্বনে বেহুলা চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। এতে তিনি চাঁদ সওদাগরের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ওই বছর তিনি সৈয়দ শামসুল হক পরিচালিত আরেকটি উর্দু চলচ্চিত্র ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন।
১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ এর মধ্যে লোহানী বিশের অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এর মধ্যে আগুন নিয়ে খেলা (১৯৬৭), দরশন (১৯৬৭), জুলেখা (১৯৬৭), এতটুকু আশা (১৯৬৮) বাল্যবন্ধু (১৯৬৮), মোমের আলো (১৯৬৮), মায়ার সংসার (১৯৬৯), মিশর কুমারী (১৯৭০), তানসেন (১৯৭০), আঁকাবাঁকা (১৯৭০), অন্তরঙ্গ (১৯৭০), ঘূর্ণিঝড়, (১৯৭০), স্বরলিপি (১৯৭০), দর্পচূর্ণ (১৯৭০), দীপ নেভে নাই (১৯৭০), অপবাদ (১৯৭০) উল্লেখযোগ্য।
সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চা
দেশবিভাগের পূর্বে কলকাতায় ফতেহ লোহানী সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চায় যুক্ত হন। তিনি দৈনিক আজাদ ও সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। সাহিত্য শাখায় তিনি একজন গল্পকার ও অনুবাদক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। মাসিক মোহাম্মদী, সওগাত প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত তার উল্লেখযোগ্য ক’টি গল্প প্রকাশিত হয়। অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মার্কিন লেখক হেমিংওয়ের Old man and the Sea এর বাংলা অনুবাদ।
বেতার ও আবৃত্তি
ফতেহ লোহানী ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্টের পর ঢাকা বেতার কেন্দ্রে সংবাদ পাঠক হিসেবে যোগ দেন। এ সময় তিনি নিয়মিত বেতারের অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করতেন। এতে নাটক ও আবৃত্তিতে অংশ নিতেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ লোহানী অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। এর মধ্যে ১৯৬১ সালে শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে আসিয়া-র জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬০), পাকিস্তানের নিগার পুরস্কার (১৯৬০), ১৯৬৮ সালে শ্রেষ্ঠ বেতার নাট্য-অভিনেতা হিসেবে পাকিস্তানের মজিদ আলমাক্কী পুরস্কার , বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কার (১৯৭৫) (অভিনয়- চলচ্চিত্র) এবং এফডিসি-র রজত জয়ন্তী পুরস্কার (১৯৮৩) উল্লেখযোগ্য।
ব্যক্তিগত জীবন
ফতেহ লোহানীর ছোট ভাই ফজলে লোহানী ও ছোট বোন হুসনা বানু খানম হেনা। ফজলে লোহানী একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার চাচাতো ভাই কামাল লোহানী একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক যিনি ২০১৫ সালে একুশে পদক লাভ করেন।
তার স্ত্রী রিজিয়া লোহানী ইডেন মহিলা কলেজ এর অধ্যাপক ছিলেন। তাদের একমাত্র মেয়ে সুমনা লোহানী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে কর্মরত রয়েছেন৷
মৃত্যু
১৯৭৫ সালের ১২ এপ্রিল চট্টগ্রামের কাপ্তাই-এ কুয়াশা চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণের সময় বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী ফতেহ লোহানী মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যঋণ: উইকিপিডিয়া