একবার আহমদ ছফাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি কী মনে করেন হুমায়ুন আহমেদ এখন শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের সমান জনপ্রিয় লেখক? জবাবে আহমদ ছফা মুচকি হেসে বলেছিলেন, হুমায়ুন আহমেদ এখন শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের চেয়েও জনপ্রিয় লেখক। কিন্তু মেরিটের দিক দিয়ে সে নিমাই ভট্টাচার্যের সমান। হি রাইটস ওনলি ফর বাজার!
তিনি সেই আহমদ ছফা। তাঁর সম্পর্কে সেই হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ একবার স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—“স্বাধীনতার পরে শহীদ পরিবার হিসেবে মোহাম্মদপুরে বাড়ি দিল সরকার। তিন দিন পর সেই বাড়িতে রক্ষীবাহিনী এসে হাজির। আমার মতো মানুষরে উচ্ছেদ করতে ট্রাকভর্তি অস্ত্রশস্ত্র আনছে! সুবেদার মেজর হাফিজ আমাদের বাসার পর্দাটর্দা ছিঁড়া ফেলল। অশালীনভাবে আমাদের উচ্ছেদ করল। এ সময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়াইল আহমদ ছফা। রক্ষীবাহিনীর অন্যায়ের প্রতিবাদে কেরোসিন ঢাইলা নিজের গায়ে আগুন ধরাইয়া দেওয়ার হুমকি দিল সে।”
হুমায়ুন আজাদের "নারী" নিষিদ্ধ হবার পর আহমদ ছফা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিক্রি করেছিলেন সেই বই।
আহমদ ছফা সমাজের শেকড়ে পেতে রেখেছিলেন নিজের আত্মা-মনন-চৈতন্যকে। এদেশের বিভিন্ন কালপর্বের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়, তাঁর কাজে। বুদ্ধিবৃত্তিক শঠতা, ভণ্ডামি,পরশ্রীকাতরতাকে যেমন তিনি নির্মমভাবে তুলে ধরেছেন, তেমনই ধিক্কার দিয়েছেন ভীরু-কাপুরুষদের, চাবকে দিতে দ্বিধায় ভোগেননি- তার কলম ঝলসে উঠেছে নষ্টদের বিরুদ্ধে।
ত্রিকালদর্শী এই লেখক বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই এ সত্য উচ্চারণ করেছিলেন যে, এদেশের বুদ্ধিজীবীরা যা বলেছে তা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না এবং আজ যা বলছে তা শুনলে এদেশের সমাজও পরিবর্তিত হবে না। তাঁর সেই কথাগুলো আজও কত না প্রাসঙ্গিক।
এই দেশের মা-মাটির লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও গণবুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার জন্মদিন আজ। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ও সলিমুল্লাহ খানসহ আরও অনেকের মতে, মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক হলেন ছফা। তাঁর লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে।
আহমদ ছফা তাঁর প্রথাবিরোধিতা, স্পষ্টবাদিতা, স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গির জন্য লেখক ও বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষ আলোচিত ও বিতর্কিত ছিলেন। জীবদ্দশায় অনেকে তাকে বিদ্রোহী, বোহেমিয়ান, উদ্ধত, প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাহীন ও বিতর্কপ্রবণ বলে অভিহিত করেছেন।
জন্ম
আহমদ ছফা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে। তাঁর পিতা হেদায়েত আলী এবং মাতা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে আহমদ ছফা ছিলেন বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান।
শিক্ষা ও জীবন
১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় সুধাংশু বিমল দত্তের মাধ্যমে কৃষক সমিতি-ন্যাপ বা তৎকালীন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অণুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা কয়েকজন বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন উপড়ে ফেলেন। পরে গ্রেপ্তার এড়াতে কিছুকাল পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মগোপন করেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন; একই বৎসরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। পরে বাংলা বিভাগে ক্লাশ করা অব্যাহত রাখেননি। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের জন্য জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসেন। দীর্ঘকাল তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন। ১৯৭১ সালে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন ও এর বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নেন। ৭ই মার্চ ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা’ হিসেবে প্রতিরোধ প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এপ্রিল মাসে কলকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সেখান থেকে দাবানল নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে ফিরে লেখালেখি করতে থাকেন।
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন। পরে ১৯৮৬-তে জার্মান ভাষার ওপর গ্যেটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি, যা তাঁকে পরবর্তী সময়ে গ্যেটের অমর সাহিত্যকর্ম ফাউস্ট অনুবাদে সহায়তা করেছিল।
সাহিত্যকর্ম
আহমদ ছফা সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন দীপ্তিময়ভাবে। গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনি মিলিয়ে তিরিশটির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর জীবদ্দশায় আহমদ ছফা রচনাবলি প্রকাশ শুরু হয়। তাঁর রচনাবলি ৯ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। জীবিত থাকাকালীন আহমদ ছফা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কলাম লেখা অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর জনপ্রিয় লেখা হলো আব্দুর রাজ্জাক স্যারকে নিয়ে লেখা "যদ্যপি আমার গুরু"।
মননশীল সাহিত্য
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে মুক্তধারা থেকে প্রকাশ পায় ছফার প্রবন্ধ গ্রন্থ জাগ্রত বাংলাদেশ। প্রকাশকাল- শ্রাবণ ১৩৭৮ বা জুলাই ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ। ১৯৭২-এ প্রকাশ পায় বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস এবং ১৯৮১-এ বাঙালি মুসলমানের মন গ্রন্থ প্রকাশ পায়।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক গণকণ্ঠ-এ ধারাবাহিকভাবে বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস রচনা প্রকাশ করেন। 'বিতর্ক বা আলোড়ন সৃষ্টিকারী' এই প্রবন্ধের কারণে তৎকালীন সরকারের রোষে পড়তে হয় তাকে। বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস বইয়ে আহমদ ছফা বাঙালি চিন্তকদের সম্পর্কে যুক্তিসহ রূঢ় সব মন্তব্য করেছেন। সেই সময় দেশের প্রতিষ্ঠিত-অপ্রতিষ্ঠিত লেখক-বুদ্ধিজীবীরা প্রতি সপ্তাহের কিস্তির দিকে তাকিয়ে থাকতেন আগ্রহ এবং আতঙ্ক নিয়ে। আহমদ ছফার সর্বাধিক আলোচিত সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—দীর্ঘ এ কালখণ্ডে বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে আত্মবিক্রির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন, কীভাবে পুরস্কার, পদক-পদবির জন্য মরিয়া ছিলেন, তা তথ্য উপাত্তসহ উপস্থাপন করেছেন। ছফার ভাষায়:
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা, গল্প-উপন্যাসে পাকিস্তান প্রশস্তি, স্বৈরশাসকের জীবনী অনুবাদ—এসব বিষয়কে ছফা দেখেছেন লেখকদের মেরুদণ্ডহীনতার চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে। একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগ মুহূর্তে লেখকসমাজের নিষ্ক্রিয়তা, যুদ্ধের সময় দ্বিধান্বিত ভূমিকা, ভারতে পালিয়ে বেড়ানো, ভোগবিলাসে মত্ত থাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ছফা তুলে ধরেছেন, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বাংলাদেশের লেখকসমাজ কতটা অপরিণামদর্শী ও অদূরদর্শী ছিলেন।
ছফা বলেন, সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীরা ‘প্রয়োজনে-ঠেলায়’ পড়ে বিশেষ বিশেষ ঘটনার আগে যে ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি দেন, ঘটনার পরে লেখেন তার উল্টো কাসুন্দি। ফলে তাঁদের কোনো চিন্তা-কর্ম-উপদেশ সমাজের বিশেষ কোনো কাজে আসে না। তাই ছফা বলেন, বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামো আমূল পরিবর্তন হবে না।
বাংলা একাডেমি থেকে বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ পায় ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ও বিতর্কিত প্রবন্ধ "বাঙালি মুসলমানের মন।" "বাঙালি মুসলমানের মন" প্রবন্ধে ছফা বাঙালি মুসলমানদের হীনম্মন্যতার ব্যাপক সমালোচনা করেছেন এবং পাশাপাশি এর বাস্তব ও যৌক্তিক কারণগুলো তুলে ধরেছেন।
কথাসাহিত্য
সলিমুল্লাহ খান ও আরো অনেকের মতে, আহমদ ছফা বাংলা সাহিত্য তথা বিশ্ব সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতে, ছফা গল্প বলার কলা অল্পবয়সেই রপ্ত করেছিলেন। তাই পাঠকরা তার ডাকে সাড়া দেয়।
‘সূর্য তুমি সাথী’ (১৯৬৭) আহমদ ছফার প্রথম উপন্যাস ও গ্রন্থ।] উপন্যাসটিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির হৃদয়গ্রাহী উপাখ্যান বলা হয়েছে। যদিও বরুমতির আঁকেবাঁকে নামক একটি গ্রন্থও তাঁর প্রথম গ্রন্থের দাবিদার।
`ওঙ্কার’ (১৯৭৫) ছফার দ্বিতীয় উপন্যাস। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রচিত ওঙ্কারে একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের তৎকালীন অস্থির রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাকে ধারণ করেছেন লেখক। ওঙ্কারে বোবা বউয়ের 'বাঙলা' উচ্চারণের সমান্তরালে "জাতিসত্তার জাগরণের অন্তর্সত্য বিধৃত হয়েছে।"
‘একজন আলী কেনানের উত্থান-পতনে’ (১৯৮৮) ছফা বাংলাদেশের মাজার সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে আলী কেনান নামের মূল চরিত্রের উত্থান ও পতন উপস্থাপন করেছেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান থেকে শুরু শেখ মুজিবের শাসনামল পর্যন্ত রাজনীতির উত্থান পতন আলী কেনানের উত্থান পতনের সমান্তরালে প্রতিবিম্বিত হয়েছে।
‘মরণবিলাসে’ (১৯৮৯) চিত্রায়িত হয়েছে মৃত্যুশয্যায় এক মন্ত্রী যে তার রাজনৈতিক অনুসারী মাওলা বক্সের কাছে তার সারা জীবনে কৃত অপকর্মের বর্ণনা দেয়।মন্ত্রীর অপকর্মগুলো খুন, ব্যভিচার, ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘিরে আবর্তিত হয়।
‘অলাতচক্র’ (১৯৯৩) প্রেম ও মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে রচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গতি-প্রকৃতি, তার নানা পর্যায়, সবলতা ও দুর্বলতাগুলোসহ কোটি নিরাশ্রয় মানুষের আকুতি, বেদনা ও স্বজন হারানোর শোক শাশ্বতরূপ পেয়েছে উপন্যাসটিতে।
‘গাভী বিত্তান্ত’ (১৯৯৫) উপন্যাসের মূল কেন্দ্র একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা লোক বিশ্ববিদ্যালয়, উপন্যাসের ভাষায়, 'দেশের সবচাইতে প্রাচীন এবং সম্ভ্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়' এবং মূল চরিত্র সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্বাচিত উপাচার্য মিঞা মোহাম্মদ আবু জুনায়েদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে আবু জুনায়েদের আরোহণ এবং এর আগে ও পরে শিক্ষক রাজনীতিকে ঘিরে ঘটনাচক্র উপন্যাসটির বিষয়বস্তু।
‘পুষ্প বৃক্ষ’ এবং ‘বিহঙ্গপুরাণ’ (১৯৯৬) একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। জাপানি ভাষায় পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ উপন্যাসের অনুবাদ প্রকাশ পায় ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে পুষ্প, বৃক্ষ, বিহঙ্গ ঘুরে সুশীল সমাজের ব্যবচ্ছেদ হয়েছে তার এই উপন্যাসে।
‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’(১৯৯৬) উপন্যাসটি ছফার ব্যক্তিগত প্রেমকে উপজীব্য করে রচিত। অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী পূর্বে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রাণপূর্ণিমার চান নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। ছফাঅর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরীকে তাঁর প্রেমের সৌধ হিসেবে কল্পনা করেছিলেন
কাব্য সাহিত্য ও অন্যান্য
ছফা চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। ছফা জার্মান সাহিত্যিক গ্যেটের ফাউস্ট অনুবাদ শুরু করেন ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে। মুক্তধারা থেকে ফাউস্টের অনুবাদ বের হয় ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে । বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক ও সমসাময়িক কালের বিশিষ্ট পণ্ডিত অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের প্রসঙ্গে রচিত স্মৃতিচারণ গ্রন্থ যদ্যপি আমার গুরু প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে।
প্রভাব ও উত্তরাধিকার
বাংলা ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক বলে বিবেচিত আহমদ ছফা ছিলেন 'সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং আদর্শনিষ্ঠ ও প্রগতিপন্থি একজন সংস্কৃতিকর্মী। 'ছফার লেখালেখিতে, তার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় বর্তমানময়তা আছে, আছে ইতিহাসের পরিচ্ছন্নতা। তৃতীয় উপাদান গণমানুষের প্রতি অঙ্গীকার, এবং তা রাজনৈতিক অর্থে। ছফার আরও ছিল সাহস। তার ক্ষেত্রে এ সাহস এসেছে ইতিহাসবোধ থেকে, অঙ্গীকার থেকে।'
ছফা রচিত প্রতিটি উপন্যাসই ভাষিক সৌকর্য, বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীর অভিনবত্বে অনন্য। মানসিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুষঙ্গসহ ছফার চরিত্র সৃষ্টির তথা কাহিনিকথনের পারঙ্গমতা অসামান্য।
আহমদ ছফা ও তার রচনাকর্ম অনেক লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকর ও বুদ্ধিজীবীকে অনুপ্রাণিত করেছে; তাঁদের মাঝে অন্যতম হুমায়ূন আহমেদ ফরহাদ মজহার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তারেক মাসুদ এবং সলিমুল্লাহ খান। বর্তমানে ছফা স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী বলে বিবেচিত।
পুরস্কার
তিনি লেখক শিবির পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি কর্তৃক সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়। তাঁকে ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্যে (মরণোত্তর) একুশে পদক প্রদান করা হয়। প্রতিষ্ঠানবিরোধী আহমদ ছফা ১৯৭৫ সালে লেখক শিবির পুরস্কার ও ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমির সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন
আহমদ ছফা সারাজীবন অকৃতদার ছিলেন। তবে কয়েকজন নারীর সাথে তাঁর প্রণয়সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাঁদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন শামীম শিকদার ও সুরাইয়া খানম। এঁদের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে ছফা অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬) আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস রচনা করেছিলেন।
জীবনাবসান
২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুলাই অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুরের বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে এই মনীষীকে দাফন হয়।