যে কারণে এআই দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে ভারত

শামস তারেক আজিজ

নভেম্বর ১৩, ২০২৩, ১২:১৭ এএম

ফাইল ছবি

গত কয়েক দশকে বিশ্ব প্রযুক্তি খাতে ভারতের আধিপত্য বেড়েছে প্রায় কয়েক গুণ। গুগল, মাইক্রোসফট, আইবিএম এবং অ্যাডোবি’র মতো বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ স্থানগুলো দখল করে আছেন সুন্দর পিচাই, সত্য নাডেলা, সান্তনু নারায়ণের, অরভিন্দ কৃষ্ণসহ অনেক ভারতীয়।  

সাম্প্রতিকালে বিশ্বের প্রযুক্তি খাতের আলোচনার শীর্ষে রয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি। চ্যাটজিপিটি, গুগল বার্ড, মিড জার্নির মতো হাজারো এআই জেনারেটেড টুলের মাধ্যমে মানুষের নানা কঠিন কিংবা সৃজনশীল কাজের সহজ সমাধান আসছে নিমেষেই। কিন্তু প্রযুক্তি খাতের শীর্ষ অবস্থানে  বিপুল পরিমাণ ভারতীয়রা থাকলেও আপাতদৃষ্টিতে ভারত জাতি হিসেবে বিশ্বের এআই দৌড়ে খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারত প্রযুক্তিখাতে সাফল্যের দেখা পেলেও এআই জেনারেটেড প্রযুক্তির প্রতিযোগিতায় ভারতের কোনো প্রতিষ্ঠান চ্যাটজিপিটি, মিডজার্নি অথবা গুগল বার্ডের মতো জেনারেটিভ এআই প্ল্যাটফর্মের প্রতিষ্ঠানগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো প্রযুক্তি বাজারে আনতে পারেনি।

বিশ্লেষকেরা, মনে করেন, ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবসার কার্যক্রমকে কার্যকর ও গতিশীল করতে জেনারেটিভ এআই এর বদলে মেশিন লার্নিংয়ের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। এমনকি দেশটির শীর্ষ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ফ্লিপকার্ট ক্রেতাদের কেনাকাটার অভিজ্ঞতা আরও আধুনিক করতে মেশিন লার্নিং ব্যবহার করেছে। 

পাশাপাশি লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতারণা থেকে বাঁচতে ‘রেজর পে’ নামক প্লাটফর্মের সাহায্য নিয়েছে, যা এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

শিক্ষাক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের লাইভ ক্লাসে এআই প্রযুক্তি সংযুক্ত করেছে, যার ফলে ক্লাস পরিচালনার খরচ যেমন কমেছে, শিক্ষার্থীদেরও তেমনি কম অর্থ গুনতে হচ্ছে।

ভারতের প্রযুক্তি খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, কর্মীদের দক্ষতার ঘাটতির কারণেই দেশটির এআই ভিত্তিক উদ্যোক্তারা আশানরূপ সাফল্যের দেখা পাচ্ছে না।

বর্তমানে জেনারেটিভ এআই‍‍’র উত্থানের কারণে দেশটির সেবা খাতের অনেক চাকরি হুমকির মুখে পড়ছে। যদিও  দেশটিতে এআই প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের হচ্ছেনা তার অন্যতম কারণ সেখানে শ্রম সস্তায় পাওয়া যায়।  

স্যানফোর্ড সি বার্নস্টেইনের বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের আইটি খাতের ৫০ লাখ কর্মীর অধিকাংশই, সিস্টেম মেইনট্যানেন্স কর্মী। এআই প্রযুক্তির দ্বারা মানুষকে প্রতিস্থাপনের পর্যায়ে এখনো আসেনি। তবে এই প্রযুক্তি খুবি দ্রুত উন্নতি করছে।

লাইটস্পিড ভেঞ্চার পার্টনার্স ইন্ডিয়ার এক পার্টনার দেভ খারে’র মতে, “ভারতের কোন কোন খাতে এআই প্রযুক্তির প্রভাব পড়তে যাচ্ছে, এরই ধারণা দিয়েছেন। তার মতে, মার্কেট সার্ভে, কনটেন্ট তৈরি, আইনি বিশ্লেষণ, আর্থিক বিশ্লেষণ সহ আইটি শিল্পের অনেক খাতে এআই প্রযুক্তির প্রভাব পড়বে। ভারতে শ্রমিকদের সস্তায় পাওয়া যাওয়ায় সেই তুলনায় জেনারেটিভ এআইয়ে বিনিয়োগ বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে।”

অন্যান্য বিশ্লেষকদের মতে, এআই প্রযুক্তির সাহায্যে কম জনশক্তি ব্যবহার করে বেশি কাজ করানোর সম্ভাবনা থাকায় ভারতের সেবা খাত সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে যাচ্ছে। দেশটির বড় বড় কনসালটিং প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে। যেমন, ইনফোসিস স্বীকার করেছে যে তারা গ্রাহকদের নির্দিষ্ট কিছু জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে এআই ব্যবহার করছে। টাটা কনসাল্টিং সার্ভিস (টিসিএসও) জানিয়েছে, তারা কনটেন্ট তৈরি, কোডিং, কপিরাইটিং এবং মার্কেটিংয়ে এআই ব্যবহার করছে।

এমন পরিস্থিতিতে ভারত সরকার ঘোষণা করেছে তারা এআই প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে কোনো আইন প্রণীত হবে না। ভারতের এ অবস্থান বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের চেয়ে ভিন্ন। 

গত এপ্রিল মাসে এক বিবৃতিতে ভারতের ইলেক্ট্রনিকস অ্যান্ড আইটি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘এআই ডিজিটাল অর্থনীতি এবং উদ্ভাবনী ইকোসিস্টেমকে আরও গতিময় করবে। সরকার এআই ব্যবহার করে ডিজিটাল পাবলিক প্ল্যাটফর্মে জনগণকে আরও ভালো সেবা কীভাবে দেওয়া যায়, সেই সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে।’

ভারতের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানগুলো এআই নিয়ে তাদের নিজস্ব উদ্ভাবনে ব্যস্ত না থাকলেও থেমে নেই। তুলনামূলক নতুন কিছু উদ্যোগ, যেমন- গ্যান, ট্রুফাউন্ড্রি ও কিউব এআই নিয়ে কাজ করছে।

সেকোয়া ক্যাপিটাল ইন্ডিয়ার কর্মকর্তা আনন্দময় রয়চৌধুরী বলেন, “ভারতের বেশিরভাগ স্টার্টআপ সাম্প্রতিক সময়ে জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বেশ আগে থেকেই এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে।”

তিনি আরও জানান, “চ্যাটজিপিটি চালু হওয়ার পর এআই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন প্রজেক্ট ও স্টার্টআপ যে গতিতে বাড়ছে, সেটি অভাবনীয়। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। সেকোয়া ইন্ডিয়া এই মিছিলে কিছুটা আগেই যোগ দিয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে ৭-৮টি এআই স্টার্টআপের সঙ্গে কাজ করছি।”

কয়েকজন ভারতীয় উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে শঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, এসব এআই স্টার্টআপ আদৌ নিজেদের তৈরি লার্জ ল্যাংগুয়েজ মডেল তৈরি করতে পারবে কিন ! এই শঙ্কার কারণ হিসেবে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে স্বল্পতা এবং বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের অভাব ও অবকাঠামোগত দুর্বলতার কথা উল্লেখ করছেন।

Link copied!