রোমান আব্রামোভিচ। রুশ ব্যবসায়ী ও ধনকুবের। ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তাঁর নাম ঘুরেফিরে আসছে।
ইউক্রেনে হামলার জেরে রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। আব্রামোভিচও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় পড়েছেন।
রাজনীতিক নন, তবু ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত মোকাবিলা করতে হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী ব্যক্তি এই রোমান আব্রামোভিচকে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে ইউক্রেনে রুশ হামলার পর আব্রামোভিচের নাম নতুন করে আলোচনায় আসে। ব্রিটিশ ফুটবলের অন্যতম প্রভাবশালী এই ব্যক্তি এখন বেশ প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।
২০০৩ সালে ব্রিটিশ ফুটবল ক্লাব চেলসি কেনেন আব্রামোভিচ। ক্লাবটি কেনার মধ্য দিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে আগামী তিন বা চার দিন আমাকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ থাকবে। তারপর তা কেটে যাবে।’
আব্রামোভিচ আরও বলেছিলেন, ‘আমি কে, তা তারা (মানুষ) ভুলে যাবে। আর আমি সেটাই পছন্দ করি।’
মাত্র তিন বছর বয়সে মা-বাবা হারান আব্রামোভিচ। তারপর নানা চড়াই–উতরাই পেরিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী হন।
রোমান আব্রামোভিচের পুরো নাম রোমান আরকাদেয়েভিচ আব্রামোভিচ। তাঁর জন্ম ১৯৬৬ সালে রাশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সারাতোবে। ইউক্রেন সীমান্ত থেকে কয়েক শ মাইল দূরে অবস্থিত এই সারাতোবে।
আব্রামোভিচের মা ইরিনা। আব্রামোভিচের বয়স যখন এক বছর, তখন তাঁর মা রক্তের বিষক্রিয়ায় মারা যান। মায়ের মৃত্যুর দুই বছর পর ক্রেন দুর্ঘটনায় বাবাকে হারান তিনি।
মা-বাবাহারা আব্রামোভিচকে লালন–পালন করেন তাঁর কাছের আত্মীয়স্বজন। তিনি রাশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর কোমিতে বেড়ে ওঠেন। তাঁর তখনকার জীবন এখনকার মতো সচ্ছল ছিল না।
তবে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আব্রামোভিচ বলেছিলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, আমি আমার শৈশবকে খারাপ বলতে পারি না।’
আব্রামোভিচ আরও বলেছিলেন, শৈশবে বিষয়গুলোর মধ্যে তেমন একটা পার্থক্য করা যায় না। কেউ গাজর খায়, কেউ খায় ক্যান্ডি। দুটিই খেতে মজা। এর মধ্যে পার্থক্য কী, তা শিশুরা বলতে পারে না।
আব্রামোভিচের পড়াশোনা বেশি দূর এগোয়নি। ১৬ বছর বয়সে স্কুল ছাড়েন তিনি। কাজ করেন মেকানিক হিসেবে। ছিলেন রেড আর্মিতে। এমনকি মস্কোর সড়কে প্লাস্টিকের খেলনাও বিক্রি করেন তিনি।
একপর্যায়ে আব্রামোভিচ সুগন্ধির ব্যবসা শুরু করেন। সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভের সময় আব্রামোভিচের কপাল খুলে যায়। উদ্যোক্তা হিসেবে বেশ কিছু বিষয়ে ছাড় পাওয়ায় তাঁর ব্যবসা ও সম্পদ দুটোই দ্রুত বাড়ে।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। খনিজসম্পদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ উঠে যায়। নতুন এই পরিস্থিতি আব্রামোভিচের জন্য বড় সুযোগ হয়ে আসে। তরুণ বয়সে তিনি দারুণ ব্যবসা গড়ে তুলতে সক্ষম হন।
১৯৯৫ সালে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি সিবনেফট বাগিয়ে নেন আব্রামোভিচ। এ-সংক্রান্ত নিলামে কারচুপির অভিযোগ ওঠে। ২০০৫ সালে একই কোম্পানি ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে আবার সরকারের কাছে বিক্রি করে দেন তিনি।
আব্রামোভিচ অবৈধভাবে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। তবে তাঁর আইনজীবী দাবি করেন, এই অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। তবে, ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যের একটি আদালতে আব্রামোভিচ স্বীকার করেন, সিবনেফটের মালিকানা পেতে তিনি দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ‘অ্যালুমিনিয়াম যুদ্ধে’ জড়ান আব্রামোভিচ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ায় যেসব ব্যক্তি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক প্রভাব–প্রতিপত্তির অধিকারী হন, সেসব অলিগার্কের মধ্যে আব্রামোভিচও ছিলেন। অ্যালুমিনিয়াম খাতের নিয়ন্ত্রণ নিতে ‘যুদ্ধে’ জড়ান তিনি।
২০১১ সালে আব্রামোভিচ বলেছিলেন, সে সময় প্রতি তিন দিনে একজন খুন হতেন। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় পড়েন তিনি। তবে জীবন নিয়ে শঙ্কার মুখেও ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে পিছু হটেননি। বরং এই পরিস্থিতি তাঁকে অনড় ও বলিষ্ঠ করে। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও তিনি লাখ লাখ ডলার আয় করেন।
ব্যবসাজগতে ভালো করার পর রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হন আব্রামোভিচ। তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। তিনি ইয়েলৎসিনের অন্যতম সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হন। এভাবে সোভিয়েত-পরবর্তী মস্কোর রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত হন। এমনকি কিছু সময়ের জন্য তিনি ক্রেমলিনে একটি অ্যাপার্টমেন্টও পেয়েছিলেন।
১৯৯৯ সালে ইয়েলৎসিন পদত্যাগ করেন। ইয়েলৎসিনের পদত্যাগের পর তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন রুশ গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির সাবেক সদস্য ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন। তাঁকে যাঁরা সমর্থন দেন, তাঁদের একজন আব্রামোভিচ।
ক্ষমতা পোক্ত করার অংশ হিসেবে পুতিন তাঁর দেশের অলিগার্কদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে তৎপর হন। এ সময় যাঁরা পুতিনের প্রতি আনুগত্য দেখাননি, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ জেলে যান, অন্যরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
আব্রামোভিচকে অবশ্য এ ধরনের কোনো পরিণতি বরণ করতে হয়নি। ২০০০ সালে তিনি রাশিয়ার সুবিধাবঞ্চিত চুকোৎকার অঞ্চলের গভর্নর নির্বাচিত হন। অঞ্চলটির সামাজিক সেবায় নিজের পকেটের অর্থ ব্যয় করে তিনি স্থানীয় লোকজনের কাছে জনপ্রিয়তা পান। ২০০৮ সালে তিনি গভর্নরের পদ ছাড়েন।
আব্রামোভিচ রাজনীতিতে যুক্ত থাকার পুরো সময় তাঁর নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করে চলেন। তিনি সম্পদের পাহাড় গড়তে থাকেন। দামি বাড়ি-গাড়ি-পেইন্টিং কিনতে থাকেন।
বিস্ময়করভাবে ২০০৩ সালে ১৪০ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে পশ্চিম লন্ডনের সবচেয়ে বড় ফুটবল ক্লাব চেলসি কিনে নেন আব্রামোভিচ। এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে তিনি ফুটবলজগতে নাম কুড়ান।
দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে আব্রামোভিচ বলেছিলেন, পেশাদার দল গড়ে তোলা তাঁর সারা জীবনের দর্শন। চুকোৎকায় তাঁর একটি পেশাদার দল ছিল। এখান তিনি যুক্তরাজ্যে তা তৈরি করবেন।
শুধু ফুটবল ক্লাবেই নয়, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন খাতে আব্রামোভিচ অর্থ ছড়িয়েছেন। পশ্চিম লন্ডনের কেনসিংটন প্যালেস গার্ডেনে তাঁর ১৫ বেডরুমের একটি ম্যানশন আছে, যার মূল্য ১৫০ মিলিয়ন পাউন্ড।
চেলসিতে আব্রামোভিচের একটি ফ্ল্যাট আছে। যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোতে আছে একটি র্যাঞ্চ। ফ্রান্সের ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরাতে তাঁর একটি অবকাশযাপন কেন্দ্র আছে।
দ্য সোলারিস ও দ্য একলিপস নামের দুটি প্রমোদতরি আছে আব্রামোভিচের, যা বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম প্রমোদতরি। তাঁর একটি ব্যক্তিগত উড়োজাহাজও রয়েছে। ২০০৬ সালে দ্য গার্ডিয়ান আব্রামোভিচের কাছে জানতে চেয়েছিল, অর্থ একজন মানুষের জন্য কী করতে পারে? জবাবে তিনি বলেছিলেন, অর্থ দিয়ে সুখ কেনা যায় না। তবে কিছুটা স্বাধীনতা পাওয়া যায়।
আলোচিত এই ধনকুবেরের স্বাধীনতা কেনা অর্থবিত্তের প্রকাশিত পরিমান সম্পর্কে জানা যায়, তাঁর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার।
সূত্র: বিবিসি