ছবি: সংগৃহীত
১৯৪৭ সাল –উপমহাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। ভারত বিভাগের ঠিক পরপরই শুরু হয় কাশ্মীর নিয়ে রক্তাক্ত সংঘাত, যার প্রভাব আজও ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি নির্ধারণ করে। কাশ্মীর বিভক্তির সেই প্রেক্ষাপট একদিকে ছিল উপমহাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্যদিকে ছিল একটি রাজ্যকে দুই দেশের মধ্যে টেনে নেয়ার জন্য পাল্টাপাল্টি প্রচেষ্টা।
কীভাবে শুরু হয় কাশ্মীর সংকট?
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শেষে ভারত ও পাকিস্তান দুইটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। তখন কাশ্মীর ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য, যার অধিপতি ছিলেন মহারাজা হরি সিং – এক হিন্দু শাসক, কিন্তু তাঁর রাজ্যের প্রায় ৭৫% জনসংখ্যা ছিল মুসলিম। তিনি প্রাথমিকভাবে ভারত বা পাকিস্তান – কোনো দেশেই যোগ দেননি। বরং চেয়েছিলেন নিজ রাজ্যকে স্বাধীন রাখতে এবং উভয় দেশের সাথে আলাদা সম্পর্ক স্থাপন করতে।
উপজাতীয় আক্রমণ ও বিভক্তির সূচনা
অক্টোবর মাসে পাকিস্তান সীমান্তবর্তী উপজাতীয় যোদ্ধারা হঠাৎ করে কাশ্মীর উপত্যকায় আক্রমণ চালায়। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলেও তারা ছিল অনুশাসনহীন। কাশ্মীরের বারামুল্লা শহরে প্রবেশ করে তারা চালায় লুটপাট, নারী নির্যাতন এবং গণহত্যা। হাসপাতাল, কনভেন্ট, মিশনারি প্রতিষ্ঠান – কোনোটিই রক্ষা পায়নি। এই আক্রমণ কেবল সশস্ত্র হামলা ছিল না, বরং ছিল একটি সুপরিকল্পিত কৌশল – রাজ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করে মহারাজাকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পছন্দ করতে বাধ্য করা।
ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও অন্তর্ভুক্তি
শ্রীনগরের বিদ্যুৎ কেন্দ্র দখল হওয়া এবং রাজধানীর নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়ে। ফলে আক্রমণের মুখে মহারাজা হরি সিং দিল্লির দিকে সহায়তার জন্য হাত বাড়ান। তিনি ভারতের সাথে ‘Instrument of Accession’ স্বাক্ষর করেন, যার মাধ্যমে কাশ্মীর ভারতের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। তারপর ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে এবং পাকিস্তান-সমর্থিত উপজাতীয়দের প্রতিহত করে।
দশদিন অবরোধের পর ভারতীয় বাহিনী আক্রমণকারীদের শহর ছেড়ে যেতে বাধ্য করলো। পুরো কাশ্মীর উপত্যকা দখল করে নিলো ভারতীয় বাহিনী।
সাংবাদিকরা বলেন, শ্রীনগরের ছোট রানওয়েতে এত বিমানের ওঠানামা সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। একের পর এক বিমান আসছিল - আরো বেশি শিখ যোদ্ধাদের নিয়ে।
কিন্তু কাশ্মীরের অন্য কিছু অংশ পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণেই রয়ে গেল।
প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং বিভক্ত কাশ্মীর
কয়েক মাসের মধ্যেই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেল। রাজ্যটি দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেল - যে বিভক্তি এখনো আছে।
এর ফলেই জন্ম নেয় ‘লাইন অফ কন্ট্রোল’ বা নিয়ন্ত্রণ রেখা, যা কাশ্মীরকে ভারত ও পাকিস্তান-শাসিত দুই ভাগে ভাগ করে দেয়:
ভারত-শাসিত জম্মু ও কাশ্মীর (বর্তমানে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল – জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ)
পাকিস্তান-শাসিত আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিত-বালতিস্তান
ইতিহাসের ভিন্নমত ও বিতর্ক
ভারতের মতে, উপজাতীয় আক্রমণ পাকিস্তান সরকারের প্রত্যক্ষ মদদপুষ্ট ছিল। অনেক পাকিস্তানি অফিসার সাদা পোশাকে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।
অপরদিকে, পাকিস্তান দাবি করে, এটি ছিল কাশ্মীরি মুসলমানদের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ।
অনেক কাশ্মীরি নেতা আবার বলেন, উপজাতীয় আক্রমণ না হলে রাজনৈতিকভাবে মহারাজা হরি সিংয়ের সিদ্ধান্তকে প্রতিহত করা যেত এবং কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ ভিন্ন হতে পারত।
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
১৯৪৭-পরবর্তীকালে জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ নামে পরিচিত এক আইন অনুযায়ী বিশেষ মর্যাদা, নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার অধিকার দেযা হয়।
কয়েক বছর আগে ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর ২০১৯ সালের ৫ই অগাস্ট কাশ্মীরের সেই বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করে।
পূর্বতন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য পুরোপুরি মুছে ফেলে একে রূপান্তরিত করা হয় লাদাখ এবং জম্মু-কাশ্মীর নামে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে। এতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়। আজ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে সৃষ্টি হওয়া কাশ্মীরের সেই বিভক্তি জোড়া লাগেনি।
১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের বিভক্তি ছিল শুধু একটি ভৌগোলিক বিভাজন নয় – কাশ্মীরের ইতিহাস রক্তপাত, রাজনৈতিক বিভাজন এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির এক জটিল অধ্যায়। আজও এই বিভাজন সমাধান হয়নি। বরং সাত দশকের বেশি সময় ধরে তা পরিণত হয়েছে সহিংসতা, যুদ্ধ এবং হাজার হাজার মানুষের জীবনের ট্র্যাজেডিতে। সেই বিভক্তি আজও উপমহাদেশের দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মাঝে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তার প্রধান উৎস হয়ে আছে।