ঢাকার মধ্যবিত্ত পরিবারের যুবক কায়কোবাদ আর তার স্ত্রীর মধ্যে কথোপকথন হচ্ছে। মোবাইল ফোনে।
স্ত্রী: ওগো শুনছো? তুমি কাউকে না বলে বের হয়ে গেলে সেই সকালে। পরে শুনলাম তুমি সাভার গেছো। এরপর আর তোমার কোনো খবর নেই!
(মোবাইল ফোনে স্ত্রী জারমিন আক্তারের অনুযোগ বাড়তেই থাকে)।
কায়কোবাদ: হ্যাঁ, বলে আসতে পারিনি তোমাকে, রাগ করো না। টিভিতে দেখলাম রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে বহু মানুষ আটকা পড়ছে, মানুষের আর্তচিৎকার। তাই আর ওই খবর শুনে স্থির থাকতে পারিনি। তোমাদের না বলেই চলে এসেছি। ভেবেছিলাম রক্তদান করব শুধু এরপর চলে আসব। কিন্তু পারলাম না। এ অবস্থায় বাসায় আসতে নিজের বিবেকে বাধছে। উদ্ধার অভিযান শেষ না হওয়ার আগে আমি হয়তো ফিরতে পারব না। ছোট্ট তিথি ও তিহাদকে দেখে রেখো। ওরা আমার জানের টুকরা।
স্ত্রী: ঠিক আছে, দেখেশুনে কাজ করো। তুমি কি খেয়ে নিয়েছ? তিথি ও তিহাদ তোমাকে ছাড়া খেতে চাচ্ছে না। .... কথা শেষ হয় না দুজনের। এবং ওই কথোপকথনই তাদের জীবনের শেষ কথোপকথন।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলের সেই মর্মান্তিক দিন। সাভারের রানাপ্লাজা ধসে পড়ার দিন সকালে এভাবেই কথা হচ্ছিল ঢাকার উত্তরায় সেক্টর ১০-এর ১২ নম্বর রোডের ২৮ নম্বর বাড়ির বাড়ির সপ্তম তলার ভাড়া বাসার বাসিন্দা কায়কোবাদ আর তার স্ত্রীর মধ্যে। স্ত্রী আর দুই সন্তান মারিয়া আক্তার তিথি (৬) ও তিহাদ চৌধুরীকে (৩) নিয়েই কায়কোবাদের সংসার চলছিল।
ওদিকে কায়কোবাদ আবারও ঝাঁপিয়ে পড়েন রানা প্লাজার হতাহতদের উদ্ধারের দুঃসাহসী অভিযানে। শেষতক কায়কোবাদ নিজ বাসায় ফিরে আসবার কথা রাখতে পারেননি। কথা ছিল সবাইকে উদ্ধার করে প্রিয় স্ত্রী, দুটি শিশুসন্তানের কাছে ফিরবেন তিনি। কিন্তু সেই কথা তিনি রাখতে পারেননি। তবে তিনি মানবতার কাছে যে ঋণ, সেই পরিশোধ করেছিলেন নিজের জীবন দিয়ে।
ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া পোশাকশ্রমিক শাহীনাকে উদ্ধার করতে গিয়ে রানা প্লাজার আটতলা থেকে সুড়ঙ্গ করে তৃতীয় তলা পর্যন্ত নেমেছিলেন কায়কোবাদ। সেখানে আটকে পোশাকশ্রমিক শাহীনাকে বোন ডেকেছিলেন। বাঁচানোর ওয়াদা দিয়ে এসেছিলেন তাকে। বোনের চলে যাওয়াটা যেন মেনে নিতে পারেননি এই মহাপ্রাণ (ব্রেভহার্ট) ইজাজ উদ্দিন কায়কোবাদ। উদ্ধারে গিয়ে নিজেও দগ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর তাৎক্ষণিক নির্দেশে আহত কায়কোবাদকে সিঙ্গাপুরও পাঠানো হয়েছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে কায়কোবাদ বোন হারানোর শোক ভুলতে নিজেও চলে যান না ফেরার দেশে। নিজ গৃহের প্রিয়তমা স্ত্রী, প্রিয় শিশুসন্তানদের চেয়ে বড় বেশি আপন করে নিয়েছিলেন রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া মানুষদের।
কায়কায়কোবাদের সঙ্গে উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া উদ্ধারকর্মীদের কাছে তখন জানা গিয়েছিল, তিনি কাজে অংশ নেওয়ার পর একাই বাঁচিয়েছিলেন অনেককে। সেই সংখ্যাটা ৩০-৩৫ জন তো হবেই। তিনি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন না; কিন্তু উদ্ধারকাজে তার পারদর্শিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। এটা দেখে কায়কোবাদ নজরে এসেছিলেন উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া সেনাবাহিনীর। এরপর সেনা কর্মকর্তারা তাকে উদ্ধারকাজে সঙ্গে নেন। কায়কোবাদ বলেছিলেন, একজনও যদি ভেতরে আটকা পড়ে থাকে, তিনি তাদের রেখে বাড়ি ফিরবেন না। উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাবেন। কায়কোবাদ কথা রেখেছিলেন।
২৪ এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ৮টা ৪৫ মিনিট। সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামের অভিশপ্ত বহুতল ভবনটি ধসে পড়ে। ভবনের কয়েকটি তলা নিচে দেবে যায়। কিছু অংশ পাশের একটি ভবনের ওপর পড়ে। এ দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়, যা বিশ্বের ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আপামর সাধারণ জনগণ, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধারকাজ শুরু করেন।
টেলিভিশনে ভবনধসের ঘটনায় চাপা পড়াদের আর্তনাদ শুনে স্থির থাকতে পারেননি কায়কোবাদ। রানা প্লাজা ধসের ঘটনার খবর শুনে তিনি সেই যে উদ্ধার অভিযানে যান, এরপর একবারও ঢাকায় ফেরেননি তিনি। চালিয়ে গেছেন উদ্ধার-তৎপরতা। পেশায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার কায়কোবাদ একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সেই উদ্ধার অভিযান এত এত মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার মতো আশাজাগানিয়া দৃশ্য স্বাধীনতা লাভের পর আর আমাদের সামনে খুব একটা আসেনি। কায়কোবাদের মতো বিশাল হৃদয়ের মানুষগুলো সেদিন নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। অনেকে নিজেদের জীবন দিয়ে গেছেন একেবারে কোনো কিছু চিন্তা না করেই।
সেই উদ্ধার অভিযানের একটি মুহূর্ত ছিল ‘সেই রুদ্ধশ্বাস ১১ ঘণ্টা’। দিনটি ছিল ২৮ এপ্রিল, রবিবার। উদ্ধারকর্মীরা তখন জীবন বাজি রেখে উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তখনই খবর মেলে শাহীনা নামের এক পোশাককর্মী ধ্বংসস্তূপের নিচে ১০০ ঘণ্টা ধরে লড়ছেন বাঁচার জন্য। তাকে জীবিত উদ্ধার করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন সেনা, ফায়ার সার্ভিস ও সাধারণ উদ্ধারকর্মীরা। কিন্তু শাহীনাকে উদ্ধারের শেষ মুহূর্তে এসে ড্রিল মেশিনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আর এতেই পুড়ে যায় সামনে আগুয়ান কায়কোবাদের শরীরের ৫০ শতাংশেরও বেশি অংশ। গুরুতর আহত কায়কোবাদকে উদ্ধার করে প্রথমে নিয়ে আসা হয়েছিল সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে।
ওদিকে সবার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ওপারে চলে যান শাহীনা। তার দেড় বছরের শিশুসন্তানের কাছে তাঁর আর ফেরা হয়নি। কায়কোবাদের আহত হওয়ার পর সরকারের খরচে উন্নত চিকিৎসার জন্য কায়কোবাদকে ওই দিনই সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু শনিবার স্থানীয় সময় রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান কায়কোবাদ নিজেও। সোমবার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে থাই এয়ারওয়েজের একটি বিমানে করে তার লাশ ঢাকায় এসে পৌঁছায়। এরপর সেনাবাহিনীর একটি পিকআপে তাঁর লাশ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হয়। মঙ্গলবার বাদ জোহর বনানী সেনানিবাস কবরস্থানে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর মৃত্যু সংবাদে গোটা দেশে হাহাকার পড়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লাখ লাখ কমেন্ট পড়ে। ব্লগগুলোতে লেখা হয় তাঁর বীরত্বগাথা। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ গভীর শোক প্রকাশ করেন।
উদ্ধারকর্মী কায়কোবাদ মানবতার জন্য যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন কোনো উপমাতেই, কোনো পুরস্কারেই তার সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তিনি জীবন দিয়ে মানবতার জয়গান গেয়ে গেছেন। দেশব্যাপী আমরা যখন হানাহানি, খুনোখুনি, নোংরা রাজনীতির পঙ্কিলতায় বারবার নিমজ্জিত হচ্ছি, ঠিক তখনই কায়কোবাদ যেন পথ দেখিয়ে গেলেন। হানাহানি নয়, মানুষের জন্যই মানুষ- সেই সত্যটা আবারও প্রতিষ্ঠা করে গেলেন তিনি।
ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে তাকে ১২ লাখ টাকার একটি অনুদান দেওয়া হয়। এ ছাড়া নিউজপোর্টাল ‘পরিবর্তন ডটকম’-এর পক্ষ থেকে দেওয়া হয় আরো পাঁচ লাখ টাকার অনুদান। এ-ই। এ ছাড়া তখন তাকে নিয়ে কোনো মিডিয়া কাভারেজ দেয়নি। শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলো তাকে নিয়ে দু-কলম লেখাও লেখেনি। অথচ সে সময় অনেক অহেতুক সংবাদ দিয়ে পাতা ভরিয়েছে শীর্ষ সার্কুলেশনের পেপারগুলো।
বাংলা মায়ের বীরসন্তান কায়কোবাদ আপনার জন্য মিডিয়া কাভারেজ লাগবে না। আপনি মানবতার জন্য যা করেছেন, সেই যথেষ্ট। যারা জানেন, তারা আপনাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন। আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন, আপনার আত্মা শান্তিতে থাকুক। আপনি আমাদের রানা প্লাজার গহ্বর থেকে উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন, সবাইকে হয়তো উদ্ধার করতে পারেননি। কিন্তু নিজের প্রাণ দিয়ে অনেককেই উদ্ধার করে গেছেন। এই দেশ যতদিন থাকবে, এ দেশে মানবতা যতদিন থাকবে, কেউ না কেউ আপনাকে স্মরণ করবেই। এ দেশের মিডিয়া আপনাকে স্মরণ করুক আর না করুক।
লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট।