জীবনযুদ্ধে যখন মামলার ভয়

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ২৩, ২০২১, ১২:৫৫ এএম

জীবনযুদ্ধে যখন মামলার ভয়

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা। প্রথমটি চালক কর্তৃক নিজের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা। যা প্রায় আমরা সবাই জানি। তবু ঘটনাটা সংক্ষেপে বলি। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালানো শুরু করেছিলেন রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম পাঠাওয়ের চালক শওকত আলী। ২৭ সেপ্টেম্বর সকাল পৌনে ১০টার দিকে বাড্ডা লিংক রোড এলাকায় একজন ট্রাফিক পুলিশ তার মোটরসাইকেল থামিয়ে মামলা দিতে গেলে ক্ষুব্ধ হন শওকত আলী এবং প্রকাশ্যে নিজের মোটরসাইকেলে নিজেই আগুন ধরিয়ে দেন। এ সময় আশপাশের মানুষ তার মোটরসাইকেলের আগুন নেভাতে এগিয়ে এলেও শওকত আলী তাদের সহায়তা নেননি। বরং ক্ষুব্ধ কণ্ঠে সবাইকে বলেছেন, ‘আমি আমার বাইক পোড়াইতেছি। আপনাদের দরদের প্রয়োজন নেই’।

শওকত আলী কেন তার বাইক পোড়ালেন?

এর ব্যাখ্যা তিনি নিজেই দিয়েছেন। শওকত বলেন, ‘আমি কেরানীগঞ্জে ব্যবসা করতাম। করোনার কারণে ব্যবসা বন্ধ। দেড় মাস ধরে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাই। কিন্তু এই স্বাধীন পেশারও দেখি অনেক যন্ত্রণা। পুলিশ যখন তখন মামলা দেয়। গত সপ্তাহেও আমাকে একটা মামলা দেওয়া হয়েছিল। অনেক কষ্টে মামলার টাকা জমা দিয়েছি। সপ্তাহ যেতে না যেতে আবারও মামলা। তার মানে আবারও জরিমানা। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। তাই নিজের বাইকে নিজে আগুন দিছি। এটা আমার প্রতিবাদ।‘

নিজেই নিজের বাইক জ্বালিয়ে দেন শওকত।

শওকত আলীর এই প্রতিবাদ কী যৌক্তিক?

রাস্তায় আইন অমান্য করলে ট্রাফিক পুলিশ গাড়িচালকদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়াটাই নিয়ম। শওকত আলী ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করায় ট্রাফিক পুলিশ মামলা দিয়েছিল। সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কোন পরিস্থিতিতে একজন চালক তার নিজের মোটরসাইকেলে আগুন দিতে পারে? এটি যদি হয় তার রুটি রুজির প্রধান অবলম্বন, তাহলে কী কারণ ছাড়াই সে তার মোটরসাইকেলে আগুন দিতে পারে? আসলেই কি কেউ ট্রাফিক পুলিশের উপর মামলা দেওয়ার কারণে রাগ দেখিয়ে নিজের এত টাকার মোটরসাইকেল প্রকাশ্যে জ্বালিয়ে দিবে?

এরপর দ্বিতীয় ঘটনাটি, ২১ অক্টোবর দুপুরে রাজধানীর পুরান ঢাকার পলাশী এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় বাইকে আগুন ধরিয়ে দেন আরো এক বাইকচালক। ট্রাফিক সার্জেন্ট মামলা দেওয়ার পর ইলিয়াস মিয়া (৩০) নামের ওই ব্যক্তি নিজের ডিসকোভার-১২৫ সিসি মডেলের মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন।

লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এম মোরশেদ দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, ‘পলাশী থেকে ব্যানবেইসের দিকে যাওয়ার সময় সার্জেন্ট তাকে থামান। তার কাগজের ডেট ফেল থাকায় সার্জেন্ট একটি মামলা দেন। মোটরসাইকেলের কাগজ প্রতিবছর রিনিউ করতে হয়। তার কাগজ রিনিউ করা ছিল না’।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এভাবেই বাইক নিয়ে যাত্রীর আশায় বসে থাকেন অনেক রাইডার। 

তিনি আরও জানান, ‘পাঠাও চালক ইলিয়াসের বিরুদ্ধে আগের দুটি মামলা ছিল। আজ আরও একটি মামলা দেয় সার্জেন্ট। তৃতীয় মামলার পর ঘটনাস্থল থেকে ১০০ গজ দূরে গিয়ে তিনি নিজের মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন’।

ওসি আরও বলেন, ‘ইলিয়াসের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, তিনি ১৩ বছর দেশের বাইরে ছিলেন। তার কাপড়ের ব্যবসা ছিল। করোনায় ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে দেড় মাস আগে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর থেকে তিনি ঢাকায় আসেন। যাত্রাবাড়ী মাতুয়াইল এলাকায় একটি মেসে থেকে রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরসাইকেল চালান’।

এই প্রসঙ্গে কথা হয়েছিল আলমগির নামের এক পাঠাও চালকের সাথে। যিনি তার জীবন জীবিকা নির্বাহ করে রাইড শেয়ারিং করে। তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘অনেক সময় তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য রং ওয়েতে গাড়ি ঢুকায় অনেকে, এতে সার্জেন মামলা দেয়। অনেক সময় সিগন্যাল বন্ধ করে দিছে কিন্তু ১০ গজ আগায় গেছি এতেও মামলা দেয়। সবারই দোষ আছে। অনেক সময় কাগজ পত্র ঠিক থাকে না। আবার দেখা যায় যে সব ঠিক আছে কিন্তু হেলমেট নাই। যার কারণে মামলা খেতে হয়’।

একই প্রসঙ্গে কথা হয় রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম পাঠাওয়ের চালক মীর মোশারফের সাথে। করোনায় চাকরি হারিয়ে, নিজের শখের মোটরসাইকেল দিয়ে শুরু করেন রাইড শেয়ারিং। পুলিশের মামলা দেওয়ার বিষয়ে তিনি জানান, ‘সবাই তো এক না। ভালো পুলিশ যেমন আছে তেমন আছে খারাপ পুলিশ। কেউ কাগজপত্র ঠিক থাকলে ছাইড়া দেয়, আবার কেউ হুদাই কেচাল করে মামলা দেয়। এখন আমার রুজি রুটি এটা, আমি কর্ম কইরা খাই। তাই মাঝে মাঝে রাগ হলেও সয়ে যায়’।

ট্রাফিক পু্লিশের ডেপুটি কমিশনার এম ডি সাহেদ আল মাসুদ দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, 'আইন করা হয়েছে জনগণের ভালোর জন্য। সড়কে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে আমরা কাজ করি। কেউ আইন না মানলেই মামলা দেওয়া হয়। অযথা তো দেওয়া হয় না’।

ট্রাফিকের লিমিটেশন আছে, রাস্তা ঠিক রাখতে হবে। তবে কতটা মামলা রেগুলার দেওয়া হয়, এটার কোন চাপ ট্রাফিক পুলিশদের উপর আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, ‘এটা অনেক বছর আগে ছিলো। কিন্তু এমনটা এখন আর নেই। এখন কেউ ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ করলেই তাকে আইনের আওতায় আনা হয়, অর্থ্যাৎ মামলা দেওয়া হয়’।

মামলা কেন হয়?

ট্রাফিক বিভাগের তথ্য মতে, রাজধানীতে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার মামলা দেয়া হয়। সার্জেন্টদের ভাষ্য, ট্রাফিক নির্দেশনা না মানা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, গাড়ির ফিটনেস-সংক্রান্ত কাগজপত্র নবায়ন না করা, ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন না করা, নির্ধারিত রুট পারমিট ব্যবহার না করা, নির্ধারিত গতিসীমা অতিক্রম করা, মোটরসাইকেলে দু’জনের বেশি যাত্রী বহন করা, হেলমেট না পরা, সঠিক জায়গায় গাড়ি পার্ক না করা, ওভারটেক করা, রাতে হেডলাইট না জ্বালিয়ে গাড়ি চালানো, সিটবেল্ট না বাঁধা, গাড়িতে নম্বর নবায়নকৃত নম্বর প্লেট না থাকা, মদ্যপান বা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো আরও কিছু অনিয়ম পেলে তারা মামলা-জরিমানা করেন। তবে অহেতুক কাউকে মামলা করেন না বলে অনেক চালক জানান।

মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বরত কয়েকজন সার্জেন্ট বলেন, বর্তমানে পরিচালিত অভিযানের মধ্যেও ট্রাফিক আইন ভাঙা অব্যাহত রয়েছে। তবে এর সংখ্যা আগের থেকে কিছুটা কমেছে। তারা আরও বলেন, মামলা ও জরিমানা করায় আইন ভাঙার সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কমতে থাকে।

১১ প্রতিষ্ঠানের রাইড শেয়ারিং আছে

দেশে ১১টি কোম্পানি মোবাইল অ্যাপস ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং করছে। কিন্তু কোম্পানিগুলো তাদের নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়ার তালিকা চালকদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে চালকদের ওপর অনেকটাই চাপ পড়ে যাচ্ছে। তাই ইচ্ছামতো বাড়া না বাড়িয়ে একটা নীতিমালা করা দরকার বলে মনে করেন রাইড শেয়ারিং করা মোটরচালকরা।

Link copied!