নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যুর পর যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তা সপ্তাহ না ঘুরতেই সেটি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। মূল আন্দোলন দানা বেঁধেছিল নটরডেমের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে। পরে তারা দাবি-দাওয়া পূরণের আশ্বাস পেয়ে রাজপথ ছেড়ে দেয়। পরে নতুন করে আরও এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘটলে আন্দোলন শুরু হয় শাহবাগ ও রামপুরাকেন্দ্রীক।
দুটি আন্দোলনের শীর্ষনেতারা এখন দাবির ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত। শাহবাগকেন্দ্রীক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্টেট কলেজের শিক্ষার্থী এনজামুল হক রামিম। রামপুরাকেন্দ্রীক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন খিলগাঁও মডেল কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া। এরমধ্যে শাহবাগ আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা দিয়েছেন ৯ দফা। এবং রামপুরার আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা দিয়েছেন ১১দফা।
সড়ক ২০১৮ সালে যখন নিরাপদ সড়কের জন্য উত্তাল সারাদেশ, ২০২১ সালে এসে সেই আন্দোলন বিভক্তিতে রূপ নিয়েছে। হাফ পাসের দাবিতে অন্দোলন শুরু হলেও নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যুর পর হাফ পাসের পাশাপাশি তা নিরাপদ সড়কের দাবিতে পরিণত হয়।
গুলিস্তান, সাইন্সল্যাব, ধানমন্ডী-২৭সহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে শিক্ষার্থীরা। সেই সময় শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালের পুরনো ৯ দফা দাবি পেশ করেন। এরইমধ্যে ২৯ নভেম্বর রামপুরাতে বাসের ধাক্কায় নিহত হন রামপুরা একরামুন্নেসা বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাঈন উদ্দিন ইসলাম দুর্জয়। তারপর থেকেই ঢাকার অন্য প্রান্তের মতো উত্তাল হয়ে উঠে রামপুরার আন্দোলন। কিন্তু তারা প্রথমে শিক্ষার্থীদের দেওয়া ৯ দফা দাবির সাথে সংহতি না জানিয়ে নিজেরাই ১১ দফা দাবি পেশ করেন।
রামপুরায় আন্দোলন করা শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ’নিরাপদ সড়ক আন্দোলন আজকের নয়। ২০১৮ সাল থেকেই এই আন্দোলন চলছে। সেই সময় থেকেই বিভিন্ন গ্রুপ হয়েই আমরা আন্দোলন করে আসছি। তখন থেকেই কারো সাথে কারো আলোচনা ছিল না। এই বিভাজনটা সেই সময় বুঝা না গেলেও এখন বুঝার কারণ হচ্ছে দফা দুই রকম হওয়ার কারণে। এই মুহুর্তে সবচেয়ে বড় আন্দোলন হচ্ছে রামপুরাতে। আমরা এখানে সকল শিক্ষার্থীর মতামত নিয়ে ১১ দফা দাবি পেশ করেছি। কারণ আমাদের মনে হয়েছে ৯ দফা দাবির মধ্যে কিছু অসংগতি ও কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। আমরা সেই ঘাটতি গুলো সংযোজন ও বিয়োজন করে ১১ দফা দাবিতে পরিনত করেছ ‘।
শাহবাগকেন্দ্রীক আন্দোলনের নেতা এনজামুল হক রামিম দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ’আমরা প্রথম থেকেই হাফ পাস ও নিরাপদ সড়কের আন্দোলন করে আসছি। আর এই ৯ দফা দাবি আমাদের আজকের না, এই দাবি আমরা ২০১৮ সাল থেকেই দিয়ে আসছি। হুট করে তারা যখন ১১ দফা দাবি দিলো তখন আমাদেরকে অনেক বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হয়। ওদের দাবিগুলোর মধ্যে অনেকগুলো অযোক্তিক দাবিও রয়েছ ‘।
তাদের সাথে এ বিষয়ে কোন আলাপ হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে রামিম বলেন, ’আমরা কথা বলতে চেয়েছি। তারা আমাদের সাথে বসতে রাজি হয়নি। আমরা দেখছি, মিডিয়াতে তারা বলতেছে যে তারা আমাদের সাথে একত্রিত হয়ে আন্দোলন করবে, কিন্তু আমরা বললে তারা আর কোন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তারা যদি এই আন্দোলনে কোন ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটায়, আমরা কখনোই তার দায় নেব না’।
তবে সোহাগী সামিয়া দাবি করেন, ‘আমরা তাদেরকে সব সময় আন্দোলনে আহবান করছি। তারা আন্দোলনে না এসে উল্টা আমাকে ফোন দিয়ে চার্জ করে বলে, আমরা কিসের ভিত্তিতে ১১ দফা দাবি পেশ করেছি। এখানে আমি দায়ভার নেওয়ারও কেউ না। কারণ আন্দোলন আমি একা করছি না, আন্দোলন এখানে যারা আছে সবাই করতেছে। ফলে এখানে দায়ভার নেওয়ার কিছু নেই।’
নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের আন্দোলন শুরু করেন নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা। টানা দুইদিনের আন্দোলনের মাথায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঘেরাও করে তারা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চাপে এক পর্যায়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপস তাদের সামনে গিয়ে কথা বলেন। তিনি শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করেন যে, শিক্ষার্থীদের সকল দাবি মেনে নেওয়া হবে। মেয়রের কথায় আশ্বস্ত হয়ে রাজপথ ছাড়েন নটরডেমের শিক্ষার্থীরা।
নটরডেমের শিক্ষার্থীরা সরে গেলেও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
রামপুরায় সোহাগী সামিয়াদের ১১ দফা:
এক.
সড়কে বাসচাপায় নাঈম ও মাইনুদ্দিনের হত্যার বিচার করতে হবে এবং তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। গুলিস্তান-রামপুরা সেতুসংলগ্ন এলাকায় ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে।
দুই.
সারাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য সব গণপরিবহনে হাফ পাস চালুর সরকারি প্রজ্ঞাপন দিতে হবে। হাফ পাসের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যাবে না। সব রুটে বিআরটিসির বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
তিন.
গণপরিবহনে শিক্ষার্থী ও নারীদের প্রতি সৌজন্যমূলক ব্যবহার এবং তাদের অবাধ যাত্রা নিশ্চিত করতে হবে।
চার.
ফিটনেস ও লাইসেন্সবিহীন গাড়ি এবং লাইসেন্সবিহীন চালককে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এবং বিআরটিএর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
পাঁচ.
সব রাস্তায় ট্রাফিক লাইট, জেব্রা ক্রসিং নিশ্চিত করাসহ ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
ছয়.
সব রুটে যানবাহনের প্রতিযোগিতা বন্ধে এক গ্রুপ বা কোম্পানির মাধ্যমে সব বাস চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বাস অনুযায়ী মালিকদের মধ্যে লাভের টাকা বণ্টনের নিয়ম করতে হবে।
সাত.
শ্রমিকের নিয়োগপত্রে তার পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে। বাসচালক ও হেলপারদের চুক্তির পরিবর্তে সব গণপরিবহণ টিকিট পদ্ধতিতে চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিকদের জন্য বিশ্রামাগার ও টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হবে।
আট.
গাড়ি ও চালকের কর্মঘণ্টা এক নাগারে ছয় ঘণ্টার বেশি হতে পারবে না। বাসে দুজন চালক ও দুজন সহকারী থাকতে হবে। পর্যাপ্ত বাস টার্মিনাল তৈরি করতে হবে। শ্রমিকদের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
নয়.
যাত্রী-পরিবহন শ্রমিক ও সরকারের প্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে সড়ক পরিবহন আইন সংস্কার করতে হবে এবং এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
দশ.
ট্রাক, ময়লার গাড়িসহ অন্যান্য ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে।
এগারো.
মাদকাসক্তি নিরসনে গোটা সমাজে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। চালক-সহকারীদের জন্য নিয়মিত ডোপ টেস্টের ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
শাহবাগে এনজামুল হক রামিমদের ৯ দফা
এক.
দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে শিক্ষার্থীসহ সব সড়ক হত্যার বিচার করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
দুই.
ঢাকাসহ সারা দেশে সব গণপরিবহনে (সড়ক, নৌ, রেলপথ ও মেট্রোরেল) শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিশ্চিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।
তিন.
গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং জনসাধারণের চলাচলের জন্য যথাস্থানে ফুটপাত, ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপত্তা ব্যবস্থা দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে।
চার.
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত যাত্রী এবং পরিবহন শ্রমিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে।
পাঁচ.
পরিকল্পিত বাস স্টপেজ ও পার্কিং স্পেস নির্মাণ এবং এগুলোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
ছয়.
দ্রুত বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এবং যথাযথ তদন্তসাপেক্ষে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের দায়ভার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা মহলকে নিতে হবে।
সাত.
বৈধ ও অবৈধ যানবাহন চালকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বৈধতার আওতায় আনতে হবে এবং বিআরটি এর সব কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
আট.
আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে ঢাকাসহ সারা দেশে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অবিলম্বে স্বয়ংক্রিয় ও আধুনিকায়ন এবং পরিকল্পিত নগরায়ণ নিশ্চিত করতে হবে।
নয়.
ট্রাফিক আইনের প্রতি জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিষয়টিকে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে।