মার্চ ১৪, ২০২৩, ০৮:৩০ পিএম
আবারো ঢাকা ও চট্রগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভূক্ত সব কোম্পানির শেয়ারে 'ফ্লোর প্রাইস' বা সর্বনিন্ম মূল্যস্তরসীমা আরোপ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। শেয়ারবাজারের ওই ব্যবস্থাকে বিনিয়োগকারীরা বলছেন ‘গলার কাঁটা।’ এই ব্যবস্থায় শেয়ারের মূল্য বেঁধে দেওয়া সীমার নীচে নামবে না। এর মানে হলো, শেয়ার বিক্রি করতে চাইলেও ক্রেতা থাকবে না এবং শেয়ার বিক্রিও হবে না। ফলে একজন বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে জরুরী আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে চাইলে তা পারবেন না।
সম্প্রতি 'ফ্লোর প্রাইস' এর শিকার একজন বিনিয়োগকারীর দুর্দশার চিত্র বেরিয়ে এসেছে। ওই বিনিয়োগকারী তার অসুস্থ সন্তানের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে না পেরে ব্রোকারেজ হাউজে এসে কান্নাকাটি করেও তার শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি।
ওই বিনিয়োগকারী সেই ব্রোকারেজ হাউজে আ্যাকাউন্ট পরিচালনা করেন। কিন্তু ফ্লোরপ্রাইসের কারণে তিনি শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি। এদিকে চিকিৎসার অভাবে তাঁর সন্তানও মৃত্যুপথযাত্রী। কিন্ত কমপ্রোমাইজড প্রাইসে শেয়ার বিক্রি করার ইচ্ছে থাকা সত্বেও তা তিনি করতে পারছেন না।
এর মানে হলো টাকা থাকা সত্বেও তিনি তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে পারছেন না। এ কষ্টেই তিনি কেঁদেছেন দেশের একটি নামকরা ব্রোকারেজ হাউজে গিয়ে।
ব্রোকারেজ হাউজটির কোনও কর্মকর্তা এ নিয়ে অফিসিয়ালি কোনও মন্তব্যও করতে চাননি নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভয়ে। শেয়ারের মূল্যে ধারাবাহিক পতন ঠেকাতে বিরল এ 'ফ্লোর প্রাইস' নামের ব্যবস্থা প্রথম চালু করা হয় গত বছরের ২৯শে জুলাই। এরপর একই বছর ২১শে ডিসেম্বর ১৬৯ কোম্পানির শেয়ারে 'ফ্লোর প্রাইস' তুলে নেওয়া হয়।
গতকাল ১ মার্চ আবারো নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ নির্দেশ প্রত্যাহার করে সব শেয়ারকে সর্বনিম্ন মূল্যস্তরসীমার আওতায় নিয়ে এলো।
অনেকে বিনিয়োগকারীর প্রশ্ন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কেনো মূল্য নিয়ন্ত্রণের এই ব্যবস্থা? এর একটা কুফল হলো মানবিক সংকট বা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যা উপরের ঘটনা থেকেই বুঝা যাচ্ছে।
আরেকটা কুফল হলো, শেয়ারবাজারে প্রাত্যহিক লেনদেনের সাথে যুক্ত আছে ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংক এর অসংখ্য কর্মচারী কর্মকর্তা। এখন ফ্লোর প্রাইস থাকায় বেচাকেনা নেই। লেনদেনও নেই।
ব্রোকারেজ হাউজের মূল আয় হলো শেয়ার কেনাবেচা থেকে কমিশন প্রাপ্তি। যেহেতু কেনাবেচা নেই তাই তাদের আয়ও নেই। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন দিতে পারছে না ব্রোকারেজ হাউজগুলো। দীর্ঘদিন এ অবস্হা চলমান থাকায় তারা কর্মচারী ছাটাই শুরু করছে। সুতরাং ফ্লোর প্রাইস যত দীর্ঘ সময় থাকবে তত শেয়ারবাজার ও একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা গুটিয়ে নেবে। তাহলে ফলাফল হলো বাজার ধ্বংস হয়ে যাওয়া।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশে একটি সফল মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনন্য দৃষ্টান্ত। আপাতত সরকারের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরিসংখ্যান তাই বলে। তাহলে কেনো শেয়ারবাজারে ফ্লোর প্রাইস দিয়ে মূল্য আটকে রাখার এ আয়োজন? অনেকেরই প্রশ্ন এই বিষয়ে।
এ প্রশ্নটাই এখন শেয়ারবাজারে সাধারন বিনিয়োগকারীদের মনে বেশী করে নাড়া দিচ্ছে। কিন্ত শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বলছে ভিন্ন কথা।
সাধারন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার লক্ষ্যে এ ফ্লোর প্রাইস দেওয়া হয়েছে বলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা দাবি করছে। আসলে সাধারন বিনিয়োগকারীর স্বার্থ কতটুকু রক্ষা হয়েছে বা হচ্ছে?
সাধারন বিনিয়োগকারী সেজে বিক্ষোভ প্রকাশ ও বিবৃতিদাতাদের কয়জনের বিনিয়োগ আছে শেয়ারবাজারে? নাকি তারা আসলে ভাড়াটে হিসেবে একটা বিশেষ গোষ্ঠীর দ্বারা নিযুক্ত হয়ে সাধারন বিনিয়োগকারীদের পুঁজি লুটপাটের লক্ষ্যকে বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে?
প্রকৃত চিত্র কি?
একজন সাধারণ বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে পূঁজি খাটায় স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদে মূনাফা অর্জন করার টার্গেট নিয়ে। একইসাথে প্রয়োজনের সময় শেয়ার বিক্রি করে টাকা উত্তোলনের সহজ প্রক্রিয়াও তাকে এ বিনিয়োগে উৎসাহিত করে। কিন্ত ফ্লোর প্রাইস দেওয়ার কারণে বিনিয়োগকারী তার শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না বা অতি প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্বেও টাকা উত্তোলন করতে পারছে না।
তার মানে একজন বিনিয়োগকারী 'ইজি এক্সেস টু লিকুইডিটি' থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে শেয়ারবাজারের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে শাকিল রিজভী বলেছেন, এটি বিনিয়োগকারীর মৌলিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা তো সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আওতায় নই। তবে কেনো এ ফ্লোর প্রাইস?
এর ব্যাখ্যায় রিজভী বলেন, শেয়ারবাজার তার নিজস্ব গতিতে চলবে। দাম বাড়বে, কমবে। এটা বাজারের অংশ। এটি মেনে নিয়েই একজন বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করেন। আইনগতভাবেও এটা স্বীকৃত। যদি একজন বিনিয়োগকারী আগে থেকে জানতো রেগুলেটর ফ্লোর প্রাইস বসিয়ে বিনিয়োগ আটকে দিতে পারে তাহলে সে হয়তো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ না করে ব্যাংক বা লিজিং কোম্পানিতে, সঞ্চয়পত্র বা অন্য কোনও মাধ্যমে টাকা বিনিয়োগ করতো। তাহলে তো অন্তত টাকাটা প্রয়োজনে তুলতে পারতো।
শেয়ারবাজারের অংশীজনদের অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান বিএসইসি নির্বাহী কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশে একটা ভেস্টেড ইন্টারেস্ট গ্রুপ বা স্বার্থবাদী মহল এ ফ্লোর প্রাইস বসিয়ে লুটপাটের এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র করেছে।
ফ্লোরপ্রাইস দিয়ে শেয়ারবাজারে অচলাবস্থা তৈরি করে একটা পর্যায়ে ফ্লোর প্রাইস তুলে দেবে। আর হতাশাগ্রস্হ সাধারন বিনিয়োগকারী স্ব স্ব আ্যাকাউন্টে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে অন্তত যা পাওয়া যায় তা উদ্ধারে শেয়ার বিক্রির হিড়িক বা সেল প্রেসার তৈরী করবে। আর এ সময় শেয়ারের মূল্য ক্রমাগত পড়তে থাকবে। একটা পর্যায়ে ক্রেতা হারিয়ে শেয়ার বিক্রি করতে চাওয়া বিনিয়োগকারী প্রাইস কম্প্রোমাইজ করে ক্রয়কৃত শেয়ার থেকে বেরুতে চেষ্টা করবে। সুযোগ বুঝে এই পড়তি বাজারে শেয়ার কিনতে অপেক্ষা করছে লুটেরারা।
অর্থসূচক এর সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, ফ্লোর প্রাইস ছিলো চরম ভুল সিদ্ধান্ত। ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো আয় হারিয়ে কর্মী ছাটাই শুরু করেছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে এসব ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংক রেকর্ড পরিমান কর্মী ছাটাই করবে।
বিনিয়োগকারী কি করবে?
এমন প্রশ্নের জবাবে জিয়াউর রহমান বলেন, ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানি সুদ দেয় কিন্ত লিজিং কোম্পানির সুদ ব্যাংকের তুলনায় বেশী হলেও তা একজন বিনিয়োগকারীর প্রত্যাশা ও নিরাপত্তা কোনটাই দিতে পারে না। তাই বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে আসে। এখন শেয়ারবাজারের যা অবস্থা তাতে বিনিয়োগকারী আস্থা হারিয়ে সরে যাবে।
তিনি বলেন, বিদেশী বিনিয়োগকারী আসবে না এ মার্কেটে। কারণ এ মার্কেটে নিয়ন্ত্রক সংস্থার উপর ভরসা করতে পারবে না তারা। তিনি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, বিএসইসি রোড শো করলো বিদেশে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে আসলো। কিন্ত কোনও ইতিবাচক সাড়া নেই। বরং ফ্লোরপ্রাইস দেওয়ার পর রেকর্ড পরিমান বিদেশী বিনিয়োগ হারিয়েছে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার।
তিনি জানান, বিএসইসি চেষ্টা করছে একটি ফান্ড ম্যানেজ করার জন্য যাতে ফোর্সড সেল বা সেল প্রেসার সামলানো যায় এবং ব্যাক্তিগত বা সিন্ডিকেট কোনও ফায়দা লুটতে না পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে বিএসইসি কথা বলছে, কিন্ত আশাব্যাঞ্জক সাড়া পাচ্ছে না তারা। সত্যিকার অর্থে সুশাসনের ঘাটতি বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের দূরাবস্থা ও লক্ষ লক্ষ বিনিয়োগকারী পূঁজি হারানোর জন্য দায়ী।