ইন্দ্রজিত বাবু দশ বছর ধরে রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানে কবুতর কেনাবেচা করছেন। এই ব্যবসায় চলে তাঁর সংসার। কিন্তু বৈশ্বিক মন্দার ঢেউ বাংলাদেশেও আছড়ে পড়ায় অন্য পেশার ব্যবসায়ীদের মতো তার অবস্থা্ও এখন ‘নড়বড়ে অস্তিত্ব’ নিয়ে টিকে থাকার মতো। অর্থনৈতিক মন্দা তাকে জেঁকে বসেছে। আগে দৈনিক চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার কবুতর কেনাবেচা করতেন। বর্তমানে সারাদিনেও এক জোড়া কবুতর বিক্রি করতে পারছেন না। ব্যবসায় মন্দাভাবের কারণে তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই মেয়ে ও এক ছেলের পড়ালেখার খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
ইন্দ্রেজিত বাবু বারো লাখ টাকা জামানত দিয়ে দশ বছর আগে গুলিস্তানে দোকান ভাড়া নেন। এতোদিন ব্যবসা ভাল চলছিল, কিন্তু হঠাৎ মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। এখন দোকান ছেড়ে অন্যকোনো কাজেও যেতে পারছেন না। কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে, ব্যবসায় মন্দা হওয়ার পরও বুকের ভেতর চাপা কষ্ট নিয়ে চলছেন। তবে ইন্দ্রজিতের মতো এলিফ্যান্ট রোডের কবুতর ব্যবসায়ীরাও ভাল নেই। তাদেরও ব্যবসায় মন্দা আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে। এসব কবুতর ব্যবসায়ী বলছেন, খাবারের দাম বাড়ায় হাজারো কবুতর ব্যবসায়ী চরম বিপাকে পড়েছেন। দোকানে বেচাকেনা নেই বললে চলে-এমনটি দাবি তাদের।
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কবুতর ব্যবসায়ী ইন্দ্রজিত বাবু দ্যা রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘বাজারে সব পণ্যের দাম বাড়ছে শুধু কবুতরের দাম বাড়েনি। কারণ মানুষের কাছে কবুতর জরুরি কিছু নয়, যে দাম বাড়বে? এটা খাইতেই হবে কিংবা পালন করতেই হইবে এমনও নয়। শখ কখন করে মানুষ, যখন কারও সংসারে সুখ পরিপূর্ণ থাকে। কবুতর এমন একটি প্রাণী- যেটা মালিকের সুখ দেখে আসে, দুঃখ দেখে যায়। কবুতর শখের জিনিস। বর্তমানে বাজারে সব নিত্যপণ্যের দাম চড়া। মানুষ নিজের খাবার ঠিকমত কিনতে পারছেন না, সেখানে কবুতর পালন করে মরবে নাকি?’
কবুতর বেচাকেনা একদম নেই জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “ এক হাজার টাকার কবুতর দুইশ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।” ইন্দ্রজিত বাবু আরও বলেন, “কবুতরের সবচেয়ে সস্তা খাবার গম। সেই গমের কেজি ৫০ টাকা। সরিষা দামের কথা বাদেই দিলাম। সরিষা একশ থেকে দেড়শ টাকা কেজি। মানসে খাইবার পায় না, কবুতরকে খাওয়াইবে কিভাবে? ব্যবসা করতে এসে এবারের মতো কখনই অর্থনৈতিক মন্দায় পরতে হয়নি। আগে কবুতর বেচে মাসে ৪০ হাজার টাকা আয় করেছি। এখন দোকান ভাড়া ৭ হাজার টাকা বেচা যাচ্ছে না। “
রাজধানীর মিরপুর গোলচত্বরে সপ্তাহে শুক্রবার কবুতরের হাট বসে। দেশি-বিদেশি নানা জাতের কবুতর নিয়ে শৌখিন ও ব্যবসায়ীরা হাটে জড়ো হন। শুক্রবার সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত লালগলা, গিরিপাস, সিরাজী, হোমার, গোল্ডেন সুইট, লক্ষা, বুম্বাই ও চিলাসহ নানা জাতের কবুতর হাটে উঠেছে। কবুতরের পাশাপাশি হরেক রকমের পাখি রয়েছে। ইতালি, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের পাখি খাঁচায় পোষার জন্য বিক্রির জন্য আনা হয়েছে। এরমধ্যে আফ্রিকান ঘুঘু, পুনর, লাভ বার্ড আছে। হাটে সকাল থেকে বেলা গড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম বাড়তে থাকে। বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে পুরোদমে হাটে কেনাবেচা শুরু হয়। হাটে বাহারি রঙের শতশত কবুতর উঠলেও আগের মতো ক্রেতাদের ভিড় চোখে পড়েনি। কবুতর বিক্রি করতে প্রত্যেকে বলছেন- খাবারের দাম বাড়ায় পালন ব্যয় বেড়েছে। ফলে কম দামে হলেও কবুতর বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।
সাত বছর ধরে গুলিস্তান ও মিরপুর হাটে নিয়মিত আসছেন আলাউদ্দিন মোল্লা নামে এক কবুতর ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, “পাঁচ মাস আগেও হাটে বাজিগর কবুতর জোড়া ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা বিক্রি হয়েছে। এখন সেই জাতের কবুতর ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সিরাজীর জোড়া ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা, লক্ষা জোড়া ১২শ’ টাকা, বুম্বাই জোড়া ১৫শ’ যা আগে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা গেছে। এবার প্রত্যেক জাতের কবুতরের দাম কমেছে। কিন্তু কবুতরের খাবারের দাম দ্বিগুন হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ সখ করে কবুতর পালন করবে না। কবুতর ব্যবসায়ীদের জীবন বাঁচাতে বিকল্প পথ বেচে নিতে হবে।”
রাজধানীর কাঁটাবন রেড সিট এন্টারপ্রাইজে কুকুর কিনতে আসেন জোবায়ের চৌধুরী। তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, এর আগেও জার্মান শেফার্ড কিনেছি। এবার ক্যান কর্স ও ব্রিটিশ বুলডগ কিনতে এসেছি। দম বেশি চাচ্ছেন বিক্রেতারা। কুকুরের দাম বেশি হলেও কবুতরের দাম হাতের লাগালে রয়েছে বলে জানান তিনি।
একোয়া এন্ড পেটস এসোসিয়েশনের সভাপতি আতিয়ার রহমান রিপন দ্যা রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ডলারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কুকুর ও বিদেশি পাখি বেচাকেনা হয়। বর্তমানে ডলারের দাম বাড়ায় এসব প্রাণীর দাম বেড়েছে। কিন্তু কেনাবেচা কমেছে। বিশ্ববাজারে ডলারের দাম কমলে পশু-পাখির দাম কমবে। তখন বেচাকেনা বাড়বে।
কবুতরের খাবারসহ সব ধরনের পাখির খাবারের দাম বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “ সেজন্য অনেকে কবুতর বিক্রি করে দিচ্ছেন। কারণ মানুষের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ নেই, সৌখিন প্রাণী কেন কিনবে? নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় জীবন নির্বাহ করা যেখানে কঠিন, সেখানে সৌখিন পশু-পাখি কেনাকাটা কীভাবে করবে?
উত্তরা থেকে মিরপুর গোলচত্বরে কবুতর বিক্রি করতে এসেছেন তানভীর হাসান। তিনি দ্যা রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, “কয়েক মাস আগে শখ করে কবুতর কিনেছিলাম। কিন্তু এখন দেখি এসব পালন করার কোনো মানে নেই। আমার দশ জোড়া কবুতরের পেছনে প্রত্যেক মাসে কমপক্ষে দুই থেকে তিন হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। কিছুদিন পর বাচ্চা দিলেও তা মারা যায়। সেজন্য কবুতর বিক্রি করতে মিরপুরে এসেছি। কমবেশি যে দাম হোক কবুতর বিক্রি করে বাড়িতে যাব।”
তানভীরের মতো অনেকেই সখ করে কবুতর পালন করতে গিয়ে খাবারের দাম বাড়ায় পিছু হটছেন। সফল ব্যবসায়ী হওয়ার আশা নিয়ে যারা কবুতরের খামার দিয়েছেন তারাও লোকসানে আছেন। কবুতরের খাবারের মধ্যে রয়েছে ধান, সরিষা, গম, চাল, খুদ, ডাবলি, রেজা, বাজরা। এছাড়া মুরগীর তৈরি খাবারও কবুতর খায়।
কবুতরের খাবারের দাম
কবুতরের খাবারের মধ্যে রয়েছে ধান, সরিষা, গম, চাল, খুদ, ডাবলি, রেজা, বাজরা। এছাড়া মুরগীর তৈরি খাবারও কবুতর খায়। কবুতরকে খাওয়ানোর জন্য প্রতি কেজি ধান ২০ টাকায় কেনা যেত, এখন তা ৫০ টাকা কেজি কিনতে হচ্ছে। সরিষা কেজি ১২০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা, চাল ও খুদের কেজি ৬০ টাকা।
কবুতরের দাম
বিভিন্ন দোকানে কবুতরের দাম সিরাজী জোড়া মানা ভেদে ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চিলা লাল জোড়া ১৫শ’ থেকে ২ হাজার, চিলা কমলা জোড়া বিক্রি হচ্ছে দেড় হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা। বিউটি হোমা ১৬শ’ টাকা, মুকী ২ হাজার, কিং ১ হাজার থেকে দেড় হাজার, ভারতীয় লোটন বিক্রি হচ্ছে ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা।
শুধুমাত্র ইন্দ্রজিত বাবু, আলাউদ্দিন মোল্লা, আতিয়ার রহমান, কবুতর প্রেমি তানভীর হাসান নন, কবুতর সংশ্লিষ্ট এরকম হাজারো ব্যবসায়ী আছেন, যারা চলমান আর্থিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন ঠিক যেন অসীম সাহার ‘প্রতীক্ষা’ কবিতার মতো-‘প্রতীক্ষা আর কত করে যাব বল?/দিনের পর দিন মাসের পর মাস/সময়তো চলে যাচ্ছে সময়ের গতিতে/কতকাল আর চেয়ে থাকবো নিঃশব্দ নিরবে।’