নির্বাসন থেকে চিরনির্বাসনে সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৩, ০৮:১৯ এএম

নির্বাসন থেকে চিরনির্বাসনে সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ

অবশেষে পলাতক অবস্থায় নির্বাসিত এক জীবন নিয়ে প্রস্থান ঘটল পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফের। ৭৯ বছর বয়সী এই জেনারেল দীর্ঘ রোগভোগের পর দুবাইয়ের আমেরিকান ন্যাশনাল হাসপাতালে ৫ ফেব্রুয়ারি মারা যান। তার রোগটি ছিল খুবই জটিল প্রকৃতির। চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় রোগটির নাম অ্যামিলোডয়সিস। এ রোগে মানব শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে বিকল হয়ে যেতে থাকে। রোগের মতোই মোশাররফও ছিলেন জটিল প্রকৃতির এক সামরিক শাসক। একই সঙ্গে পাকিস্তানের দুর্ভাগা প্রেসিডেন্টদেরও অন্যতম তিনি। ক্ষমতায় থাকাকালে ছিলেন জনপ্রিয়, এবং এখন তার মৃত্যুকালে অল্পসংখ্যক উপকারভোগী ছাড়া কান্না করার মতো কেউ নেই!

দিল্লিতে জন্ম হলেও দেশভাগের পর পারভেজ মোশাররফের বেড়ে ওঠা পাকিস্তানের করাচিতে। একটা বড় সময় কাটান ইস্তাম্বুলেও। তত দিনে ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা দেশ হয়ে গেছে। তারুণ্যে যোগ দেন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে। একসময় তিনি দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। নওয়াজ অন্যদের ডিঙিয়ে তাকে সেনাপ্রধান করেন। সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়ার প্রায় এক বছর পর তিনি নওয়াজ শরিফকেই ক্ষমতাচ্যুত করেন।

 

প্রায় এক দশক তিনি পাকিস্তান শাসন করে গেছেন নানা কৌশলে। ক্ষমতায় যেতে ১৯৯৯ সালে লাহোর চুক্তিকে বানচাল করতে সেনাপ্রধান মোশাররফ কার্গিলে সেনা অনুপ্রবেশ ঘটান। এরপরই বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার চাপের মুখে পড়েন নওয়াজ। দাওয়াই হিসেবে জেনারেল মোশারফকে বরখাস্ত করার চেষ্টা করেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ। কিন্তু আমেরিকাপন্থি মোশাররফ উল্টো দাবার চাল দিয়ে নওয়াজকেই ক্ষমতাচ্যুত করে দেশের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেন। শরিফ তখন গৃহবন্দি হন এবং তাকে পাঠানো হয় রাওয়ালপিন্ডির সেন্ট্রাল জেলে। ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ সময়কালে ক্ষমতা ধরে রাখতে এমন কিছু নেই যা জেনারেল মোশাররফ করেননি। সংবিধান স্থগিত করা, জরুরি অবস্থা জারিসহ সবই করেছেন। অনেকে বলতেন, তিনি আমেরিকার কাছে দেশ বিক্রি করে দিয়ে ক্ষমতায় থাকা এক স্বৈরশাসক। কারণ, তার শাসনামলে আমেরিকা ও ব্রিটেনের কথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ পাকিস্তান নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে গেছে। পাকিস্তান তখন হয়ে উঠেছিল ন্যাটোর বাইরে আমেরিকা-ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় মিত্র।

এই তোষামোদির বিনিময়ে পারভেজ মোশাররফের পাকিস্তান পেয়েছে ডলারের পাহাড়। তবে দেশজুড়ে আর্থিক সচ্ছলতার ছিটেফোঁটাও ছিল না। কিন্তু ফি-বছর মার্কিন সহায়তার নামে ডলারের পাহাড় দিয়ে পাকিস্তান তার ভাঙা অর্থনীতি তখন সামাল দিয়েছে ভালোভাবেই। বিনিময়ে পারভেজ মোশাররফ দেখিয়ে দিয়েছেন তার দেশের কোথায় কোথায় কথিত জঙ্গিরা লুকিয়ে আছে। কখনো কখনো ধরিয়েও দিয়েছেন এমন অনেককে, যাদের জঙ্গি সম্পৃক্ততা ছিল না। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই তিনি জঙ্গিবাদের খেলা খেলে গেছেন। এসব কর্মকাণ্ডে স্বাভাবিকভাবেই জঙ্গি মদদদাতা দেশটির রাজনৈতিক-সামাজিক অঙ্গনের লোকজন যারপরনাই ক্ষেপে উঠেছিল। তার শাসনামলে বহুবার তাকে লক্ষ্য করে আততায়ীর হামলা হয়েছে, কিন্তু রক্ষা পেয়ে গেছেন তিনি। তাকে উৎখাতের বহু প্লটও ব্যর্থ হয়েছে বারবার। পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতা দখলের পর নিজের অবস্থান মজবুত করতে জনগণকে একটি ধারণা দিয়েছিলেন যে, তার কাছে পাকিস্তানের তাবৎ মুসিবত আসান করার তরিকা রয়েছে। দেশটিতে তখন জঙ্গিবাদের ফলন বাড়ন্ত। এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আলোচিত আত্মঘাতী হামলা হয়ে যায়। ওই হামলায় ২,৯৯৭ জন নিহত, ৬,০০০-এর অধিক মানুষ আহত হন এবং ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক অবকাঠামো ও সম্পদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

ওই হামলার এক মাসেরও কম সময় পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আফগানিস্তান আক্রমণ করেন আল-কায়দাকে নিশ্চিহ্ন করতে এবং ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে বের করতে। আমেরিকার নেতৃত্বাধীন এই অভিযানে যোগ দেয় আন্তর্জাতিক মিত্র জোট। ২০১১ সালে মার্কিন সৈন্যরা অবশেষে ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে পায় পাকিস্তানে এবং তাকে হত্যা করে। দীর্ঘ বছরব্যাপী ওই অভিযান নামের এসব হামলায় আমেরিকার বড় মিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। মার্কিনিরা তার সামনে তখন দুটি পথ খোলা রেখেছিল : হয় আমাদের সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে থাকো, না হয় তুমি আমাদের প্রতিপক্ষ।

পারভেজ মোশাররফ দ্বিতীয় পথটির দিকে আর যাননি। মার্কিনিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কথিত জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াইয়ে সর্বতোভাবে সহযোগিতা দিয়ে গেছেন তার পুরো শাসনকালে। সিদ্ধান্তটি ছিল তার জন্য অনেক কঠিন। কিন্তু তার পরও আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানকে প্রধান ন্যাটো মিত্র হিসেবে তুলে ধরে একটি লাভজনক অবস্থায় পৌঁছেছিলেন মোশাররফ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দিয়ে নিজ দেশের অর্থনীতিকে চাঙা রাখার এই কৌশলে সফল ছিলেন তিনি। মিত্ররাও খুশি ছিল তার সহযোগিতায়।

মোশাররফের এই কৌশলকে অনেকে বলতেন, তিনি সাপ হয়ে দংশন করেন আর ওঝা হয়ে ঝাড়েন। তিনি খরগোশের সঙ্গেও ছুটতেন, আবার যখন শিকারিরা এসে যেত, তিনি সেই শিকারিদের সঙ্গেও সেই খরগোশকেই শিকার করতেন। এভাবে পাকিস্তানের মাটিতে কথিত আল-কায়েদা জঙ্গিদের আমেরিকানদের হাতে তুলে দিতেন। মার্কিনিদের ড্রোন হামলার লক্ষ্যবস্তু কোথায়, তা-ও জানিয়ে দিত জেনারেল মোশাররফের প্রশাসন।

এসব কাজের জন্য, তিনি নিজ দেশে ধিক্কার পেতেন, পশ্চিমাদের কাছে পেতেন বাহবা। অনেকে বিশ্বাস করতেন যে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দেশটিকে বিক্রি করে দিয়েছেন। শুধু পশ্চিমাদের সঙ্গেই নয়, প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গেও দারুণ সখ্য গড়েছিলেন মোশাররফ। যদিও তিনি কার্গিল যুদ্ধের পরিকল্পক ছিলেন এবং সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে তার দ্বিচারী আচরণও ছিল। তা সত্ত্বেও মোশাররফকে তার প্রথম পাঁচ বছরের শাসনকালের জন্য বিশেষভাবে স্মরণ করা যাবে শুধু ভারতের সঙ্গে দারুণ সম্পর্কোন্নয়নের কারণে। কারণ তখন ভারত ও পাকিস্তান সবচেয়ে বেশি শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে ছিল। এ ছাড়া দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর পারভেজ মোশাররফের সরকার অনেকগুলো সংস্কার পদক্ষেপও নিয়েছিল। যেমন : নারীদের অধিকার রক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করা ও প্রথমবারের মতো পাকিস্তানে বেসরকারি মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেল চালুর অনুমতি দেওয়া।

জনপ্রিয় বেলুচ নেতা আকবর খান বুগতির হত্যার মাধ্যমে তার পতন শুরু হয় এবং প্রধান বিচারপতিকে বরখাস্ত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা তাকে খাদের কিনারে নিয়ে যায়। ২০০৭ সালেরে শেষদিকে এক আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন বিরোধী দলীয় নেতা বেনজির ভুট্টোও। ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা। বেনজির ভুট্টো নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানজুড়ে যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে তা সামাল দিতে পারেননি মোশাররফ। এ পরিস্থিতিতে তিনি জাতীয় নির্বাচন স্থগিত করে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। ২০০৮ সালে ১১ বছর পর পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মোশাররফের দল হেরে যায়। সংসদে অভিশংসনের মুখে পড়েন তিনি। অভিশংসন এড়াতে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেন তিনি।

যদিও এরপর দেশে ফিরেছিলেন মোশাররফ, কিন্তু তার অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধ হয়নি। এরই মধ্যে ২০১৩ সালে দেশে ফিরে সে বছর জাতীয় নির্বাচনে একটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে দেশটির নির্বাচন কমিশন তাকে ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করে। এরপর ২০১৬ সালে তিনি দুবাইয়ে যাওয়ার অনুমতি পান। জরুরি অবস্থা ঘোষণার দায়ে ২০১৯ সালে তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। যে মৃত্যুদণ্ডের রায়ে বলা হয়েছিল, যদি রায় কার্যকরের আগে তার স্বাভাবিক মৃত্যুও হয়, তার পরও ফাঁসির দড়িতে তিন দিন তাকে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। যদিও সেই দণ্ড পরে বাতিল করা হয়েছিল। আদালতের দৃষ্টিতে এতটাই গর্হিত অন্যায় করেছিলেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। সেই প্রতাপশালী জেনারেলকে নিজ দেশের মাটিতে নয়, বিদেশবিভুঁইয়ে অনেকটা নির্বাসিত পলাতক জীবন থেকেই মৃত্যুবরণ করতে হলো।

লেখক : সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট। ইমেইল: lutforrahmanhimel@gmail.com.

[লেখাটি প্রথমে দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত।]

Link copied!