দিনটি ছিল বুধবার। সেদিন ছিল ১৯৮৪'র ৩১শে অক্টোবর। ৩৩টা গুলি ছোঁড়া হয়েছিল তাকে লক্ষ্য করে! ২৩টি গুলি তার শরীর ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। সাতটি গুলি শরীরে আটকে ছিল! দুপুর ২.২০ নাগাদ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এশিয়ার আয়রন লেডি বাংলাদেশের মুক্তিবন্ধু, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী।
তিনি তখন ব্রিটিশ অভিনেতা `পিটার_আস্তিনভ 'কে সাক্ষ্যাৎকার দিতে যাচ্ছিলেন । তখনই বিশ্বস্ত দেহরক্ষী বেয়ান্ত সিং ও সাতওয়ান্ত সিং -এর গুলিতে ঝাঁঝরা হন শ্রীমতি গান্ধী !
এ ঘটনা ভারতের ইতিহাসে ইন্দিরা হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। সেদিন প্রিয়দর্শিনীকে তারই দুই শিখ দেহরক্ষী সতবন্ত সিং ও বিয়ন্ত সিং অপারেশন ব্লু স্টার চলাকালীন স্বর্ণমন্দির শিখদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের প্রতিশোধ নিতেই হত্যা করে। পরে শিখবিরোধী দাঙ্গা শুরু হয় দেশজুড়ে।
উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বর শহরেই তার বাবা জওহরলাল নেহরু প্রথমবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৬৪ সালের মে মাসে তিনি মারা যান।
ইন্দিরা গান্ধীর জীবনীকার ইন্দর মালহোত্রা বলেন, গোয়েন্দা এজেন্সিগুলো আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, ইন্দিরা গান্ধীর ওপর এরকম একটা হামলা হতে পারে।
তারা সুপারিশ পাঠিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর আবাস থেকে শিখ নিরাপত্তাকর্মীদের যেন সরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু সেই ফাইল যখন ইন্দিরা গান্ধীর টেবিলে পৌঁছে, তখন ভীষণ রেগে তিনি নোট লিখেছিলেন, ‘আমরা না ধর্মনিরপেক্ষ দেশ?’ এরপরে ঠিক করা হয়-একসঙ্গে দুজন শিখ নিরাপত্তাকর্মীকে প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি ডিউটি দেয়া হবে না।
৩১ অক্টোবর সতবন্ত সিং বলেছিলেন, তার পেট খারাপ। তাই তাকে শৌচালয়ের কাছাকাছি যেন ডিউটি দেয়া হয়। এভাবেই বিয়ন্ত আর সতবন্ত সিংকে একই জায়গায় ডিউটি দেয়া হয়েছিল। যার পরিণতিতে স্বর্ণ মন্দিরে সেনা অপারেশন অর্থাৎ অপারেশন ব্লুস্টার-এর বদলা নেয় তারা।
১৯৮৪ সালের ৩০ অক্টোবর ভুবনেশ্বর শহরেই জীবনের শেষ ভাষণ দেন ইন্দিরা গান্ধী। ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমি আজ এখানে রয়েছি। কাল নাও থাকতে পারি। এটা নিয়ে ভাবি না যে আমি থাকলাম কী না। অনেকদিন বেঁচেছি। আর আমার গর্ব যে- আমি পুরো জীবনটাই দেশের মানুষের সেবায় কাজে লাগাতে পেরেছি। আর শেষ নিঃশ্বাসটা নেয়া পর্যন্ত আমি সেটাই করে যাব। আর যেদিন মরে যাব, আমার রক্তের প্রতিটা ফোঁটা ভারতকে আরও মজবুত করার কাজে লাগবে।’
সেই রাতেই দিল্লি ফিরে যান ইন্দিরা গান্ধী। খুব ক্লান্ত ছিলেন। সারা রাত প্রায় ঘুমাননি। পরদিন সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যে তৈরি হয়ে যান ইন্দিরা গান্ধী। কালো পাড় দেয়া একটা গেরুয়া রঙের শাড়ি পরেন সেদিন। ৮০ বছর বয়সেও তার মাথার বেশির ভাগ চুল কালোই রয়েছে।
রোদ ঝলমলে দিনটা। তবুও রোদ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে আড়াল করতে সেপাহি নারায়ণ সিং একটি কালো ছাতা নিয়ে পাশে হাঁটছিলেন। কয়েক পা পেছনেই ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ান। তারও পেছনে ব্যক্তিগত পরিচারক নাথু রাম।
সবার পেছনে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার সাব ইন্সপেক্টর রামেশ্বর দয়াল। ঠিক সেই সময়েই সামনে দিয়ে এক কর্মচারী হাতে একটা চায়ের সেট নিয়ে পেরিয়ে যান। ওই চায়ের সেটে তথ্যচিত্র নির্মাতা পিটার উস্তিনভকে চা দেয়া হয়েছিল।
ওই কর্মচারীকে ডেকে ইন্দিরা বলেন, উস্তিনভের জন্য যেন অন্য আরেকটা চায়ের সেট বের করা হয়। বাসভবনের লাগোয়া দফতর ছিল আকবর রোডে। দুটি ভবনের মধ্যে যাতায়াতের একটা রাস্তা ছিল। সেই গেটের সামনে পৌঁছে ইন্দিরা গান্ধী তার সচিব আর কে ধাওয়ানের সঙ্গে কথা বলেন।
ধাওয়ান তাকে বলেন, ইন্দিরার নির্দেশমতো ইয়েমেন সফররত রাষ্ট্রপতি গিয়ানী জৈল সিংকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে তিনি সন্ধ্যা ৭টার মধ্যেই দিল্লি চলে আসেন।
হঠাৎই পাশে দাঁড়ানো নিরাপত্তাকর্মী বিয়ন্ত সিং রিভলবার বের করলেন। গুলি করলেন। প্রথম গুলিটা ইন্দিরা গান্ধীর পেট ভেদ করে বেরিয়ে যায়। ইন্দিরা গান্ধী ডান হাতটা উপরে তুলেছিলেন গুলি থেকে বাঁচতে। তখন একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে বিয়ন্ত সিং আরও দু’বার গুলি চালান। সে দুটি গুলি তার বুকে আর কোমরে লাগে। ওই জায়গার ঠিক ৫ ফুট দূরে নিজের টমসন অটোমেটিক কার্বাইন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সতবন্ত সিং।
ইন্দিরা গান্ধীকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে সতবন্ত ঘাবড়ে যান। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখনই বিয়ন্ত চিৎকার করে সতবন্তকে বলেন-গুলি চালাও। সতবন্ত সঙ্গে সঙ্গে নিজের কার্বাইন থেকে চেম্বারে থাকা ২৫টা গুলিই ইন্দিরা গান্ধীর শরীরে গেঁথে দেন। বিয়ন্ত সিং প্রথম গুলিটা চালানোর পরে প্রায় ২৫ সেকেন্ড কেটে যায়।
সতবন্ত সিং গুলি চালানো শুরু করতেই একদম পেছনে থাকা নিরাপত্তা কর্মকর্তা রামেশ্বর দয়াল দৌড়ে আসেন। সতবন্ত তখন একনাগাড়ে গুলি চালিয়ে যাচ্ছেন। দয়ালের উরু আর পায়েও গুলি লাগে। সেখানেই পড়ে যান তিনি।
ইন্দিরা গান্ধীর আশপাশে থাকা অন্য কর্মচারীরা ততক্ষণে একে অন্যকে চিৎকার করে নির্দেশ দিচ্ছেন।
ওদিকে এক নম্বর আকবর রোডের ভবন থেকে পুলিশ অফিসার দিনেশ কুমার ভাট এগিয়ে আসছিলেন শোরগোল শুনে। বিয়ন্ত সিং আর সতবন্ত সিং তখনই নিজেদের অস্ত্র মাটিতে ফেলে দিয়েছে। বিয়ন্ত বলেন, ‘আমাদের যা করার ছিল, সেটা করেছি। এবার তোমাদের যা করার করো।’
ইন্দিরার আরেক কর্মচারী নারায়ণ সিং লাফিয়ে পড়ে বিয়ন্ত সিংকে মাটিতে ফেলে দেন। পাশের গার্ডরুম থেকে বেরিয়ে আসা ভারত-তিব্বত সীমান্ত পুলিশ বা আইটিবিপির কয়েকজন সদস্য এগিয়ে এসে সতবন্ত সিংকেও ঘিরে ফেলে। সবসময়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স রাখা থাকত ওখানে। ঘটনাচক্রে সেদিনই অ্যাম্বুলেন্সের চালক কাজে আসেননি।
ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা মাখনলাল ফোতেদার চিৎকার করে গাড়ি বের করার নির্দেশ দেন। মাটিতে পড়ে থাকা ইন্দিরাকে ধরাধরি করে সাদা অ্যাম্বাসেডর গাড়ির পেছনের আসনে রাখেন আর কে ধাওয়ান আর নিরাপত্তা কর্মী দিনেশ ভাট। সামনের আসনে ড্রাইভারের পাশে বসে পড়েন ধাওয়ান আর ফোতেদার।
রক্তে ভেসে যাচ্ছিল ইন্দিরা গান্ধীর শরীর। সোনিয়া তার মাথাটা নিজের কোলে তুলে নেন। ইন্দিরা গান্ধীর রক্তের গ্রুপ ছিল ও নেগেটিভ। ওই গ্রুপের রক্ত মজুত ছিল হাসপাতালে। কিন্তু সফদরজং রোডের বাসভবন থেকে কেউ ফোন করে হাসপাতালে খবরও দেয়নি- ইন্দিরা গান্ধীকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জরুরি বিভাগের দরজা খুলে গাড়ি থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে নামাতে মিনিট তিনেক সময় লেগেছিল।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডাক্তার গুলেরিয়া, ডাক্তার এম এম কাপুর আর ডাক্তার এস বালারাম পৌঁছে যান। ইসিজি করা হয়। কিন্তু তার নাড়ির স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছিল না। চোখ স্থির হয়ে যায়। বোঝাই যাচ্ছিল যে মস্তিষ্কে আঘাত লেগেছে। ৮০ বোতল রক্ত দেওয়া হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীকে। শরীরে যে পরিমাণ রক্ত থাকে এটা ছিল তার প্রায় ৫ গুণ।
ডাক্তার গুলেরিয়া বলেন, ‘আমি তো দেখেই বুঝে যাই- উনি আর নেই। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার জন্য ইসিজি করতে হয়। তারপরে আমি ওখানে হাজির স্বাস্থ্যমন্ত্রী শঙ্করানন্দকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এখন কী করণীয়? ঘোষণা করে দেব আমরা যে উনি মৃত? তিনি ‘না’ বলেছিলেন। তখন আমরা ইন্দিরাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাই।
চিকিৎসকরা হার্ট অ্যান্ড লাং মেশিন লাগিয়েছিলেন ইন্দিরার শরীরে। ধীরে ধীরে তার শরীরে রক্তের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি থেকে কমে ৩১ ডিগ্রি হয়ে গেল। তিনি যে আর নেই, সেটা সবাই বুঝে নেন। তবুও অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।
চিকিৎসকরা দেখেছিলেন, যকৃতের ডানদিকের অংশটা গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বৃহদান্ত্রের বাইরের অংশটা ফুটো হয়ে গেছে। ক্ষতি হয়েছে ক্ষুদ্রান্ত্রেরও। ফুসফুসের একদিকে গুলি লেগেছিল আর পাঁজরের হাড় ভেঙে গিয়েছিল গুলির আঘাতে। তবে হৃৎপিণ্ডতে ক্ষতি হয়নি। দেহরক্ষীদের গুলিতে ছিন্নভিন্ন হওয়ার প্রায় ৪ ঘণ্টা পর দুপুর ২টা ২৩ মিনিটে ইন্দিরা গান্ধীকে মৃত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সরকারি প্রচারমাধ্যমে সেই ঘোষণা করা হয় সন্ধ্যা ৬টায়।
ইন্দিরা গান্ধীর ময়নাতদন্ত দলের নেতৃত্ব দেন ডা. টি ডি ডোগরা। তিনি জানিয়েছিলেন, কমপক্ষে ৩০টি বুলেট বিদ্ধ হয় ইন্দিরার শরীরে। বুলেট ছোড়া হয় স্টেনগান ও পিস্তল থেকে। খুনিরা ৩১টি বুলেট ছুড়লেও একটি গুলি তার গায়ে লাগেনি। আর ৩০টি গুলির মধ্যে ২৩টি গুলি শরীরের এক পাশে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ৭টি গুলি দেহের ভেতরেই থেকে যায়।
ডা. ডোগরা ইন্দিরার দেহ থেকে বের করে আনা বুলেটগুলোর ব্যালিস্টিক পরীক্ষার মাধ্যমে বুঝতে পারেন এগুলো কী ধরনের অস্ত্র থেকে ছোড়া হয়েছে। এই বুলেটগুলো সিএফসিএল দিল্লির সংশ্লিষ্ট অস্ত্রের সঙ্গে মিলে যায়। পরবর্তী সময়ে ডা. ডোগরা একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে হাজির হন মহেশ চন্দ্রের আদালতে। কয়েকটি অধিবেশনে তার সাক্ষ্য নেয়া হয়। তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের উকিল পি এন লেখি।
৩ নভেম্বর মহাত্মা গান্ধীর সমাধিস্থল রাজঘাটের নিকটস্থ শক্তিস্থল নামক স্থানে তার সৎকার সম্পন্ন হয়। তবে এ হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী চারদিন ব্যাপক হিংসাত্মক ঘটনায় প্রাণ হারান বেশ কয়েক হাজার শিখ। এ ঘটনা ঘটে দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে।
ইন্দিরা-হত্যার তদন্তের জন্য গঠিত জাস্টিস ঠক্কর কমিশন ষড়যন্ত্রের জন্য পৃথক তদন্তের পরামর্শ দেয়। তবে সৎবন্ত সিংহ ও ষড়যন্ত্রকারী কেহার সিংহ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯৮৯ সালের ৬ জানুয়ারি তাদের দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়।