জাহানারা ইমাম: বাঙালির জোয়ান অফ আর্ক

নিজস্ব প্রতিবেদক

মে ৩, ২০২৩, ০৯:১২ পিএম

জাহানারা ইমাম: বাঙালির জোয়ান অফ আর্ক

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর নাড়িছেঁড়া ধনকে নিজ হাতে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। আর সেই তিনিই একাত্তরের ঘাতক সর্দারের মৃত্যুদণ্ড নিজেই ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর জীবন সার্থক। শুধু এ কারণেই না, তিনি আরও বহু কারণে বাঙালির জাতির হৃদয়মন্দিরে চির জাগরূক থাকবেন। তাঁর অমর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বাঙালি জাতির চিরকালীন মহাকাব্য।

j2-1

জাহানারা ইমাম ছিলেন বিংশ শতাব্দীতে বাঙালির জোয়ান অফ আর্ক। প্রীতিলতা, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, ড. নীলিমা ইব্রাহিম যে বিন্দু বিন্দু আন্দোলন করে বীজ রোপণ করেছিলেন, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সেই অঙ্কুরকেই মহীরুহে পরিণতি দিয়েছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান, তিনি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে। প্রতীকী অর্থে হলেও ঘাতক সর্দার গোলাম আযমকে তিনি চৌদ্দ কোটি মানুষের গণআদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন। এটা আর কারো দ্বারা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন কোনোদিন ম্লান হবে না, জাহানারা ইমামের গণআদালতের ইতিহাসও ম্লান হবে না।

১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে দলের আমীর ঘোষণা করে জামায়াতে ইসলাম। শুরু হয় জনবিক্ষোভ। সেই বিক্ষোভের অংশ হিসাবে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি গঠিত হয় ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি ৭২টি রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়।

j3-1

১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ গণ-আদালত-এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠান করে। গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দশটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।

একাত্তরে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শাফী ইমাম রুমী দেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এবং কয়েকটি সফল গেরিলা অপারেশনের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন এবং পরবর্তীতে নির্যাতনের ফলে মৃত্যুবরণ করেন। বিজয় লাভের পর রুমীর বন্ধুরা রুমীর মা জাহানারা ইমামকে সকল মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন। রুমীর শহীদ হওয়ার সূত্রেই তিনি শহীদ জননীর মযার্দায় ভূষিত হন৷

j6-1

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে  তাঁর স্বামী মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী শরীফ ইমামও মৃত্যুবরণ করেন।

দেশ স্বাধীনের পর ঘাতকদের বিচারে সোচ্চার হন শহীদ জননী। তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেশব্যাপি গণস্বাক্ষর, গণসমাবেশ, মানববন্ধন, সংসদ যাত্রা, অবস্থান ধর্মঘট, মহাসমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে আন্দোলন আরও বেগবান হয়। সরকার ৩০ জুন ১৯৯২ সালে সংসদে ৪ দফা চুক্তি করে।

84affee9-6de6-477d-9bab-df1a9f8089d7

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি বিদেশেও গঠিত হয় নির্মূল কমিটি এবং শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন। পত্র-পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম হয়ে উঠলে আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেন জাহানারা ইমাম। আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। বিভিন্ন দেশ থেকে সাংবাদিকরা তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে আসেন। জাপানের এনএইচকে গণআদালত ও জাহানারা ইমামের ওপর এক ঘন্টার প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। জার্মান, ফরাসি, ডাচ, সুইডিশ, স্প্যানিশ প্রভৃতি দেশ থেকে সাংবাদিকরা এসে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। মাত্র তিন বছরের সংগ্রামের মাধ্যমে সৃষ্টি করেন ইতিহাস।

0a5ecdcd-07f3-4bcc-b124-619a7aa63879

জাহানারা ইমাম ৩ মে ১৯২৯ সালের বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে বড়ঞা থানার অন্তর্ভুক্তসুন্দরপুর গ্রামে সম্ভ্রান্ত এক বাঙালি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সৈয়দ আবদুল আলী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা সৈয়দা হামিদা বেগম।

জাহানারা ইমাম নানা বিষয়ে লেখালেখি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ ছিল আরাধ্য। কথাসাহিত্য রচনাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন এই শিক্ষাবিদ। 

জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

Link copied!