ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও নাট্যকার তারাশঙ্কর আমাদের খুবই চেনা। এমনকি আমরা চিনি কবি বা গীতিকার তারাশঙ্করকেও। হয়তো বা প্রাবন্ধিক তারাশঙ্করকেও চিনি। কিন্তু সাংবাদিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের বড়ই অচেনা। অথচ জীবনের প্রায় শেষ পর্বে এই সাংবাদিকতার কাজ তাঁকে গ্রহণ করতে হয়েছিল কতকটা দায়ে পড়েই। কেমন ছিল তারাশঙ্করের সেই জীবন- এ নিয়েই আজকের প্রতিবেদন।
১৯৬৩ সালের কথা। তারাশঙ্করের জামাতা শান্তিশঙ্কর মারা গেছেন। তাঁর বিধবা স্ত্রী অর্থাৎ তারাশঙ্করের বড় মেয়ে গঙ্গা দেবী, তিনটি কন্যা ও একটি পুত্র, সকলের দায় তখন তারাশঙ্করের কাঁধে। এই অবস্থায় তারাশঙ্কর যুগান্তর পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজ নেন।
১৯৬৩ সালের ২৭ জুলাই থেকে ১৯৬৭ সালের জুন পর্যন্ত চার বছর ধরে প্রতি শনিবার যুগান্তরের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় তিনি গ্রাম বাংলার সংবাদ লিখতেন ‘গ্রামের চিঠি’ নামে। গ্রামের চিঠিতে তারাশঙ্কর লিখেছেন গ্রামের চাষবাস, জলহাওয়ার কথা, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা, গ্রামের ক্রমপরিবর্তনের কথা। এ-সব চিঠি যখন লিখছেন তারাশঙ্কর, তখন তিনি রাজ্যসভায় কংগ্রেস দলের সদস্য। অথচ কংগ্রেসের অন্তর্কলহ, দুর্নীতি সম্পর্কে সমালোচনায় তাঁর কুন্ঠাবোধ নেই। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিল্লির হাই কমান্ড পর্যন্ত পৌঁছেছিল বলে জানা যায়। কারণ সেসময় একটি চিঠিতে তারাশঙ্কর লিখছেন, ‘‘...আমার দিক থেকেও সত্যকে প্রকাশ করতে ভীত আমি কোনদিন হব না। কারণ লেখক এক সত্যের কমাণ্ড ছাড়া অন্য কোন কমাণ্ডের অধীন নন। আমিও নই।”
১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার আসার পর সারা রাজ্য জুড়ে যে বেনামী জমি উদ্ধার আন্দোলন শুরু হয়, সে সম্পর্কে আলোচনা পাওয়া যাবে এই সব চিঠির কয়েকটিতে। গ্রামের সমাজব্যবস্থাই শুধু নয়, তার কৃষি ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, শোষণের স্বরূপ সবই ছিল তারাশঙ্করের নখদর্পণে। বহু চিঠিতে উঠে এসেছে সেসব কথা।
সেই সময় চলতে থাকা পূর্ব-পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, উদ্বাস্তু সমস্যা, নেহরুর মৃত্যু, তীব্র খাদ্য সংকট, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সবই তাঁর চিঠির বিষয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও জীবনের শেষবেলায় কলম ধরেন তারাশঙ্কর বন্দ্যাপাধ্যায়। আবেগ ও বাস্তবতার মিশেলে তিনি রচনা করেন ‘১৯৭১’ উপন্যাস। এখানে তিনি লিখে গেছেন ঐতিহাসিক ঘটনার মুহূর্ত।
১৮৯৮ সালের বীরভূমে ২৩ জুলাই জন্ম নেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। কথাসাহিত্য, বিশেষ করে তাঁর রচিত ‘হীরকখন্ডতুল্য’ ছোটগল্পের কারণে পাঠকের মনজুড়ে থাকবেন অনন্তকাল।